তীর্থে তীর্থে পথে পথে, গঙ্গোত্রী ধাম দর্শন (দ্বাদশ পর্ব)

স্বামী প্রৌঢ়ানন্দ
আমাদের ভারত, ১৯ মার্চ: স্নান সেরে উঠে পোশাক পরিবর্তন করে আমরা গঙ্গোত্রী মায়ের মন্দিরে এলাম ।এখন মায়ের মন্দির বন্ধ তাই বাইরে থেকেই মাকে প্রনাম জানালাম। মন্দিরের অদূরেই ভাগীরথী শিলা। কথিত আছে এখানে বসেই ভাগীরথ মা গঙ্গার তপস্যা করে মাকে তুষ্ট করে মর্তে নিয়ে যাবার অনুমতি পেয়েছিলেন। সমগ্র গঙ্গোত্রী ধাম এখন ফাঁকা, এরপর আমরা গেলাম সূরয কুণ্ড দর্শন করতে। মা গঙ্গা অনেকটা উঁচু থেকে এখানে নীচে পড়ছেন, বিশাল তার গর্জন, অন্য কোনো আওয়াজ আর শোনা যায় না। সূরয কুণ্ড দর্শন করে চললাম দণ্ডীক্ষেত্রে। এখান থেকে ফিরে যাবার আগে সন্ন্যাসী মহারাজদের সাথে একবার দেখা করে যাব এই আমাদের মনোবাসনা। আমরা যাওয়া মাত্রই মহারাজ আমাদের কাছে ডেকে বসতে বললেন।তারপর আমাদের প্রত্যেককে গরম রুটি আর আলুর তরকারি খাওয়ালেন। আগে থেকেই তৈরী করা ছিল, যেন উনি জানতেন আমরা এখনই ওঁনার কাছে আসব। খাওয়া শেষ হলে ওঁনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা নীচের দিকে নামতে শুরু করলাম। উপরে ওঠার সময় যেমন দমের কষ্ট হয়েছিল এবার কিন্তু নীচে নামার সময় পায়ে টান ধরতে লাগল। একে পায়ের তলায় ফোস্কা তার উপর আবার পায়ে টান দুয়ে মিলে আমাদের খুবই করুন অবস্থা, তারই মাঝে ধীরে ধীরে নেমে চলা। নামার সময় যেখানে মৌনীবাবার সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম সেখানে অনেক খোঁজাখুঁজির পরও আর বাবার দর্শন পেলাম না। তাই আমাদের গঙ্গোত্রী ধাম পৌঁছানোর খবর উনি কীভাবে আগে দিয়ে দিয়ে ছিলেন সে রহস্য আজও আমাদের কাছে অধরা রয়ে গেল। চলতে চলতে যখন আমরা নীচে আবার ধরালু গ্রামে পৌছলাম তখন প্রায় দুপুর দুটো। উত্তর কাশি যাবার শেষ বাস আজকের মতন চলে গেছে, তাই আজকে আমাদের এখানেই রাত্রিবাস করতে হবে। জায়গাটা অবশ্য ছবির মতন সুন্দর, তাই মনের আনন্দেই আমরা সেখানে থেকে গেলাম।

পরদিন খুব সকালে উঠেই মুখ হাত ধুয়ে আমরা সকলে বাসে এসে বসলাম। যথাসময়ে বাস ছেড়ে দিল, আমরা নেমে চললাম উত্তরকাশির উদ্দেশ্যে। বেলা তখন প্রায় বারোটা, আমরা কালী কমলি ধর্মশালায় এসে পৌছলাম।আমাদের দেখামাত্রই ধর্মশালার কয়েকজন আমাদের প্রায় জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, আপনারা কোথায় গিয়েছিলেন।আমরা বাস আড্ডায় আপনাদের খবর নিতে গিয়ে শুনেছিলাম আপনারা গঙ্গোত্রী ধামের দিকে রওনা দিয়েছেন। তারপরও আপনারা না ফেরায় আমরা ভাবলাম আপনারা বুঝি ঐ বিপদসঙ্কুল পথে হারিয়ে গেছেন, আর বোধহয় ফিরতে পারবেন না।
আমাদের কথা সব ওঁনাদের খুলে বললাম। সব কিছু শুনে তারা অত্যন্ত অবাক হয়ে গেলেন। বললেন, গঙ্গা মাঈএর আপনাদের উপর অসীম কৃপা, উনি আপনাদের কাছে ডেকেছেন। এই বলেই তারা সকলেই আমাদের পায়ে প্রনাম করতে শুরু করলেন, আমরা অপ্রস্তুত অবস্থার মধ্যে পড়ে গেলাম। ধর্মশালার যিনি প্রধান তিনি অফিসের লোকেদের বলে দিলেন, এই মহারাজদের কাছ থেকে কোনও ঘর ভাড়া বাবদ টাকা নেবে না আর ওঁনাদের ভোজনও আমাদের এখানে ব্যবস্থা করে দেবে। আমরা বিস্ময়ে হতবাক, সবই গঙ্গা মাঈএর কৃপা, না হলে যারা প্রথমে এক পয়সাও কমাতে রাজি হচ্ছিলেন না তারাই কীভাবে আমাদের এত সুযোগ দেবেন।

খাওয়া দাওয়া করে দুপুরে আমরা সকলেই টানা ঘুম দিলাম কারন এই কয়দিন আমাদের সকলের উপর বেশ ধকল গেছে। কিন্তু এতে হল হীতে বিপরীত। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে মাথা সকলের অত্যন্ত ধরে গেল। বেশ বুঝতে পারলাম ঐ ঠান্ডা জলে স্নান আর এতটা পথ অতিক্রম করার ফলেই এই মাথা যন্ত্রণা। মাথায় হাত দিয়ে সকলে বসে আছি এমন সময় ঠাকুর মশাই বললেন, চলুন এই ধর্মশালায় সাধুদের আস্তানা রয়েছে, সেখানে গিয়ে সাধুসঙ্গ করা যাক। আমরা সকলে এক বাক্যে রাজি।

সাধুদের আখড়ায় গিয়ে দেখি অনেক সাধু সেখানে রয়েছেন। এঁনাদের মধ্যে একজনকে দেখে সাধুদের প্রধান বলে মনে হল। ওঁনাকে গিয়ে প্রনাম করে বসতেই উনি হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন। আমাদের সব কথা উনি শুনলেন, আমরা গঙ্গোত্রী ধাম দর্শন করে নেমে এসেছি শুনে উনি খুব খুশী হলেন। বললেন, মায়ের করুনা তোরা পেয়েছিস, এর ফল এখন বুঝতে না পারলেও পরে বুঝতে পারবি। কথায় কথায় সাধুবাবাকে আমাদের অসহ্য মাথা যন্ত্রণার কথা জানালাম। সাধুবাবা স্মিত হেসে একজন অন্য সাধুবাবাকে ডাকলেন। উনি আসতেই সাধুবাবা বললেন ইনি হচ্ছেন জড়িবুটি বাবা, হিমালয়ের প্রান্তরে যে দুষ্প্রাপ্য জড়িবুটি আছে তা নিয়ে ইনি গবেষণা করেন, এঁনার কাছে তোদের সমস্যার কথা বল। আমরা আমাদের সমস্যার কথা জড়িবুটি বাবাকে জানালাম। সব শুনে উনি ঝোলা থেকে একটি শিকড় বের করে ছোট ছোট তিনটি টুকরো করে আমাদের তিনজনকে দিলেন। বললেন, এই শিকড়টা শুধু দাঁতে কেটে ফেলে দিবি খাবি না। এই শিকড়ের গুনে তোরা ভালো হয়ে যাবি। কিন্তু এখন তোরা কোনও খাবারের স্বাদ পাবি না, জিভে শুধু এই শিকড়ের স্বাদ থাকবে, তবে কাল সকাল দশটার পর এটা কেটে গিয়ে আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আমরা শিকড়গুলি দাঁতে কেটে ফেলে দিলাম। আর সত্যিই খাবারের আর কোনও স্বাদ পেলাম না, শুধুই জিভে চিন চিন করা ঐ শিকড়ের স্বাদ। রাতে শোবার পর নাক দিয়ে শুরু হল জলের ধারা, এক নাগাড়ে জল বেরিয়ে চলেছে, এত জল কোথায় যে জমে ছিল ভাবতেও অবাক লাগে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার কয়েক ঘণ্টা পর মাথাটা সম্পূর্ণ ছেড়ে গেল আর আমিও আরামে নিদ্রা গেলাম।

সকালে ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে গেলাম। আজকেই আমরা হরিদ্বারের উদ্দেশ্যে রওনা দেব। জিভ এখনও চিন চিন করছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে জিভটা ঠিক হবেতো।জড়িবুটি বাবা বলেছেন, সকাল দশটা পর্যন্ত এই রকম থাকবে, তাই তাঁর কথার উপরেই ভরসা রেখে বসে আছি।সকাল সাতটায় উত্তরকাশি বাস আড্ডা থেকে বাস ছাড়ল।বাস নেমে চলেছে, দুপাশের প্রকৃতির রূপসূধা পান করতে করতে আমরাও চলেছি। কি জানি আবার কবে দেখা হবে, কভুকি আর আসতে পারব এই পথে। তাই এই সুযোগেই মনের মধ্যে যতটা সম্ভব ভরে নিয়ে যাই এই রূপ সূধা ।
“ভরা থাক স্মৃতি সূধায়।
হৃদয়ের পাত্র খানি।।”
বারে বারে হাত ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছি, এখন প্রায় নটা বাজে। জিভ এখনও চিন চিন করছে, দেখাই যাক না আরতো মাত্র এক ঘন্টা, দশটা বাজলেই বোঝা যাবে জড়িবুটিবাবা ঠিক বলেছেন কিনা। নটা বেজে দশ, নটা বেজে কুড়ি, সাড়ে নটা বেজে গেল, না এখনও জিভে চিনচিনে ভাবটা আছে। দশটা বাজতে আর আধঘণ্টা আছে, দেখি কি হয়। দুপাশের প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম। খানিকক্ষণ পরে হঠাৎ খেয়াল করলাম জিভের সেই চিনচিনে ভাবটা আর নেই, সঙ্গে সঙ্গে ঘড়ির দিকে তাকালাম দেখলাম দশটা বেজে দশ মিনিট। অবাক হয়ে গেলাম, পৃথিবীতে এমন কোনও ডাক্তার আছেন কিনা জানি না যিনি এই রকম ঘড়ি ধরে বলে দিতে পারেন রোগ কখন সারবে। আমরা আধুনিক বিজ্ঞান নিয়ে বড়াই করি কিন্তু আমাদের অগোচরে যে কত রকম বিশেষ জ্ঞান রয়েছে তার খবর আমরা কেউ রাখি না। সাধুদের আমরা শুধু ভাবি ঈশ্বরের সাধনা করেন, কিন্তু লোকচক্ষুর অন্তরালে এঁনারা যে কীভাবে মানব জাতির সেবায় নিয়োজিত সে খবর আমরা কজন রাখি। তীর্থের দেবতার টানে পথে পথে ঘুরলে তবেই পাওয়া যায় এই অমৃতের স্বাদ। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই রয়েছে অফুরন্ত শক্তি, বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে এই শক্তির প্রকাশ ঘটে, কিন্তু সংসারের মায়াকাজল চোখে পড়ে আমরা নিজেদের স্বরূপ ভুলে বসে আছি। গঙ্গামা কৃপা করে আমাদের এই পথে ডেকে যে সমস্ত অভিজ্ঞতার সাক্ষী আমাদের করলেন তা এই জীবনের পাথেয় হয়ে রইল। গঙ্গা মাতার উদ্দেশ্যে জানাই আমাদের শতকোটি প্রনাম।

দেবী সুরেশ্বরী ভগবতী গঙ্গে, ত্রিভুবনতারিণি তরল তরঙ্গে।
শঙ্করমৌলীনিবাসিনি বিমলে মম মতিরাস্তাং তব পদকমলে।।
ভাগীরথী সুখদায়িনি মাতস্তব জল মহিমা নিগমে খ্যাতঃ। নাহং জানে তব মহিমানং ত্রাহি কৃপাময়ি মামজ্ঞানম।। সুরেশ্বরী, ভগবতী, ত্রিভুবনতারিণী, তরলতরঙ্গযুক্তা। শংকর-মৌলি-বিহারিণী, নির্মলা, দেবী গঙ্গা।।
তোমার পাদপদ্মে আমার সুমতি হোক। ভাগীরথী সুখদায়িনী মা, তোমার জলের মহিমা বেদাদিতে খ্যাত, আমি তোমার মহিমা জানি না, হে কৃপাময়ী, অজ্ঞ আমাকে ত্রাণ করো।
সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *