স্বামী প্রৌঢ়ানন্দ
আমাদের ভারত, ১২ মার্চ: গঙ্গোত্রী ধাম যখন পৌঁছলাম তখনও সূর্যের অস্তমিত আলোয় চারিদিক পরিস্কার দেখাযাচ্ছে। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি আটটা বাজে।প্রকৃতির কি আশ্চর্য খেলা। আমাদের পূবের দেশে যখন রাত গভীর হয়ে গেছে তখন এখানে এখনও সূর্যের আলো রয়েছে। যাইহোক এসে তো পড়লাম কিন্তু এখানেতো কোনও জনমানব চোখে পড়ছে না! এখন রাতে কোথায় আস্তানা পাব? ইতিমধ্যেই ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করেছে, মাঝে মাঝে কোল্ডওয়েভের মতন এসে হাঁড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে।
সকলে মিলে দাঁড়িয়ে এই রকম সাতপাঁচ ভাবছি হঠাৎ দেখি নদীর অপর পার থেকে একজন সন্ন্যাসী আমাদের দিকে আসছেন। আমাদের কাছে এলে আমরা সকলে তাঁকে প্রনাম করলাম, তিনিও হাত তুলে আমাদের আশীর্বাদ করলেন। বললেন তোমাদের ওপর গঙ্গা মাঈয়ের অশেষ কৃপা যে তোমরা হেঁটে এখানে আসতে পেরেছ। এখন গঙ্গোত্রী ধাম জনমানবশূন্য, কেবলমাত্র আমরা দুজন সন্ন্যাসী–ঐযে ওপারে দেখছ দণ্ডীক্ষেত্র, ওখানে থাকি। খুব প্রয়োজন না পড়লে আমরা ওখান থেকে বেরোই না।কিছুক্ষণ আগে মৌনীবাবা আমাদের জানালেন কয়েকজন এখানে আসছেন তাই আমি এখানে খোঁজ নিতে এলাম, এই ঠান্ডায় রাতে আশ্রয় না পেলে তোমরা বিপদে পড়বে। অবাক হয়ে সন্ন্যাসী মহারাজের কথা শুনে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মৌনীবাবার সাথে তো দেখা হয়ে ছিল এক কিলোমিটার আগে, তারপর তো ওঁনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা এখানে এসেছি! উনি কীভাবে এঁনাদের কাছে আমাদের খবর দিলেন বুঝতে পারছি না। সন্ন্যাসী মহারাজ বোধহয় আমার মনের কথা বুঝতে পেরে হেসে বললেন, এ জগৎসংসারে এমন অনেক কিছু ঘটে যার সাধারন বুদ্ধিতে ব্যাখ্যা মেলে না। যাক এখন তোমরা চলো দেখি তোমাদের কোথায় থাকার ব্যবস্থা করা যায়।
সন্ন্যাসী মহারাজ কাছেই একটি ঘরে নিয়ে গেলেন। ওঁনার কাছ থেকে একটি চাবি দিয়ে ঘরটি খুলে বললেন, এখানেই আজকের মতন রাত্রিবাস কর, তোমাদের জন্য আমি রাতের কিছু খাবারের ব্যবস্থা করছি।
ডাল রুটি খেয়ে সকলে যে যার জায়গা নিলাম। অসম্ভব ঠান্ডা। শোয়েটার, টুপি, মোজা আর তার উপর লেপ, কম্বল চড়িয়েও ঠান্ডা কাটতে চাইছে না। এর মধ্যেই অরুণবাবু হনুমান চালিশা পাঠ করতে শুরু করলেন। গঙ্গোত্রীর ঐ নিঝুম নিস্তব্ধতার মাঝে এই পাঠ এক অদ্ভুত মায়াময় পরিবেশ সৃষ্টি করল। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য যেন পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।আবার ঐ শব্দ গুলোও নিজেদের মধ্যে মিলে মিশে যেন ওম নাদ সৃষ্টি করছে।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল নেই। ঘুম ভেঙে গেল দরজার শব্দে। কেউ যেন জোরে জোরে দরজায় আঘাত করছে। হাত ঘড়িতে দেখলাম রাত দুটো। তাহলেকী আমাদের একলা পেয়ে কেউ যথাসর্বস্ব লুঠ করতে এসেছে?কিন্তু আমাদের কাছ থেকে তারা পাবেইবা কি। সামান্য কিছু টাকা আর মলিন শীত বস্ত্র ছাড়া আমাদের আর কিছুই নেই। দরজা না খুলে আমরা ভিতরে বসে রইলাম। কিন্তু দরজার আঘাতের শব্দ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, মনে হচ্ছে এবার দরজা ভেঙ্গে পড়ে যাবে। ঠাকুরমশাই বললেন, না এভাবে বাঁচা যাবে না, যা থাকে কপালে দরজা খুলেই দেখাযাক। আমি আর ঠাকুর মশাই একসাথে গিয়ে দরজা খুলেদিলাম।
দরজা খুলে বাইরে এসে দেখি কেউ কোথাও নেই! প্রচণ্ড জোরে বাতাস বইছে আর তার ধাক্কায় আমাদের দরজা আওয়াজ করছে। চারিদিক বরফে ভর্তি হয়ে গেছে আর সেই বরফের উপর তারার আলো পড়ে ঠিকরে উঠে এক অপূর্ব সুন্দর মায়াময় আলোর সৃষ্টি করেছে। আমরা স্থান কাল পাত্র ভুলে গিয়ে স্থানুবৎ দাড়িয়ে রইলাম। একেই কি বলে স্বর্গ, যতদূর দৃষ্টি যায় একই দৃশ্য। মনেহয় স্বর্গের অপ্সরীরা নেমে এসেছেন। জানি না কোন পুন্যবলে এইরকম অপরূপ দৃশ্য আমরা অবলোকন করলাম।কতক্ষণ এইভাবে ছিলাম খেয়াল নেই, যখন হুঁশ এল দেখলাম সকলেই বাইরে এসে এই দৃশ্য উপভোগ করছেন।এই দৃশ্য মনের মণিকোঠায় আজও সযত্নে রক্ষিত আছে।বর্তমানে বহু অনুষ্ঠানে বিচিত্র রকমের আলোকসজ্জা চোখে পড়ে, যার মধ্যে অনেকগুলিই প্রশংসার দাবি রাখে কিন্তু ঐ রাতে হিমালয় পর্বতের চূড়ায় যে আলোকদৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছিলাম তার কাছে এগুলি কিছুই নয়। আমরা যারা এই দৃশ্যের সাক্ষী ছিলাম তাদের মধ্যে অনেকেই গত হয়েছেন কিন্তু আমি আর ঠাকুরমশাই দুজনে এই ঘটনার এখনও জীবন্ত সাক্ষী।
ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই প্রাতঃকৃত্য সেরে আমরা চললাম গঙ্গা মাঈয়ের মন্দির দর্শন করতে। মন্দিরের পাশেই স্নান করার জন্য পাথরের সিঁড়ি নেমে গেছে গঙ্গায়। সেটি দিয়ে নেমে গঙ্গার জলে পা ডোবাতেই মনে হল পা অবশ হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে উপরে উঠে এলাম। সকলে ঠিক করলাম স্নান করা এই বরফ জলে সম্ভব নয়, মাথায় শুধু জল ছিটিয়ে নেব। কিন্তু বাধ সাধল দিল্লি থেকে আসা অরুণবাবু। বললেন, আমার বয়স হয়েছে, আর কোনও দিন এখানে আমি আসতে পারব না, আর আজ বাদে কাল মারাও যেতে পারি, আমি একবার অবগাহন স্নান করে নিই।এই বলে তিনি জামা কাপড় ছেড়ে একটি গামছা পরে সটান গিয়ে গঙ্গায় ডুব দিলেন। এই রকম একজন বয়ঃজ্যেষ্ঠ মানুষকে স্নান করতে দেখে আমাদেরও রক্ত গরম হয়ে গেল। আমরাও ওঁনার পদাঙ্ক অনুসরণ করে সকলেই একে একে ডুব দিলাম। আশ্চর্যের ব্যাপার স্নান করার পর ঠান্ডার অনুভূতি যেন উধাও হয়ে গেল, গা গরম হয়ে শরীর যেন তরতাজা হয়ে উঠলো।