ফোনেই করোনার সংক্রমণ, বিরক্ত গ্রাহকরা

চিন্ময় ভট্টাচার্য
আমাদের ভারত, ১৫ মার্চ: নামী সংবাদপত্রের কবিতার পাতার দায়িত্বে থাকা সহকর্মী একটা কবিতা চেয়েছিল। অন্যান্য সপ্তাহের মতো উত্তম এবারও কথা ফেলতে পারেনি। কবিতাটা লিখে শোনানোর জন্য ফোন করেছিল অন্য এক সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিক সোনা দা-কে। রসালো ব্যক্তিত্ব সোনাদার থেকে উত্তম ভুলত্রুটি শোধরানো-সহ খুঁটিনাটি, নানা বিষয়ের রসদ পায়। কিন্তু, ফোনে কবিতা শোনাবে কী, ফোন করতেই মোবাইল সার্ভিস প্রোভাইডারের রেকর্ড থেকে ভেসে এল করোনা ভাইরাস নিয়ে নানা সতর্কবাণী, সঙ্গে সরকারের টোল ফ্রি নম্বর- সব মিলিয়ে প্রায় মিনিটখানেকের গল্প। এসব শেষে যেই না কবিতার দুটো লাইন পড়া শেষ করেছে, অমনি ফোনের মধ্যেই শুনতে পেল, সোনাদার স্ত্রী স্বামীকে ডাকছে। তিনি অফিসে বেরিয়ে যাচ্ছেন, সোনাদা বেলায় বেরোবেন। তাই এই সময়ে কী কী কাপড় সোনাদাকে কাচতে হবে, তা দেখানোর জন্য। সোনাদার অনুরোধ মেনেই উত্তম তাই ১০ মিনিটের জন্য ফোনটা রাখতে বাধ্য হল। ফের ফোন করতেই আবার সেই করোনা ভাইরাসের সতর্কবাণী। আবার সেই একমিনিটের গল্প। বিরক্ত উত্তম শেষ পর্যন্ত এবারের মতো সোনাদাকে কবিতা শোনানোর আশা ত্যাগ করে ফোনটাই রেখে দিল।

উত্তমের মতোই ভুক্তভোগী জগাছার আক্কা মামা। এক মিডিয়া হাউসের শীর্ষকর্তা। নবান্নে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক সেরে ফিরে এসেছিলেন বাড়িতে। রাজ্যের এক মন্ত্রীকে ফোন করে তাঁর সঙ্গেই অন্য এক জায়গায় যাওয়ার কথা। শিস দিয়ে আক্কা মামার বাড়ির দরজাটা খুলতে হয়। শিস দেওয়ার আগে ফোন করছিলেন ওই মন্ত্রীকে, বেরনোর সময়টা ঠিক করার জন্য। কথা বলবেন কী, আক্কা মামার ফোনে তখন করোনা বাজছে। সেসব শেষে কথা বলার আগেই মন্ত্রীর ফোনে ঢুকে গেল নবান্নের ১৪তলা থেকে ফোন। মন্ত্রীর ফোন তখন ব্যস্ত। আক্কা মামা তখনও দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। সময় হিসেব করে ফের নবান্নের ফোন কাটতেই মন্ত্রীর মোবাইলে ফোন করলেন। কিন্তু, তখনও একমিনিট ধরে বেজে গেল করোনা। এর মধ্যেই স্থানীয় এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় বেরিয়ে যেতে বাধ্য হলেন মন্ত্রী। আক্কা মামা ফের মন্ত্রীর ফোন পেলেও মন্ত্রী তখন নতুন গন্তব্যে বেরিয়ে গেছেন। বাধ্য হয়ে বিরক্ত আক্কা মামা বাড়িতে কিছুক্ষণ কাটিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে কথা কাটাকাটি করে অফিসের পথ ধরলেন।

শুধু সাংবাদিককুলই নয়। ফোনে করোনার এই হানাদারিতে চূড়ান্ত সমস্যায় পড়েছেন সব পেশার মানুষই। যেমন অভিরূপ ভট্টাচার্য, পেশায় হিসেবরক্ষক। নীরস হিসেবশাস্ত্র মেনে কাজ শুধু তাঁর নেশাই নয়, পেশাও। চাকরি ছেড়ে হিসেবরক্ষার ব্যবসা খুলে বসেছেন। কলকাতা শহরের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি তাঁর ‘ক্লায়েন্ট’। হিসেবের কাজ করতে গিয়ে তাঁদের কাউকে ফোন করতেই শুধু করোনা বাজছে। যার জেরে হিসেবের ঘোরে মশগুল অভিরূপ ভুলেই যাচ্ছেন, ‘ক্লায়েন্ট’-এর কাছে কী জিজ্ঞাসা করতে চাইছিলেন। তাঁরা সব বিশিষ্ট ব্যক্তি, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত থাকেন। একই বিষয়ের জন্য বারবার ফোন করে তাঁদের বিরক্ত করাও মুশকিল। যার জেরে মহাফ্যাসাদে পড়েছেন অভিরূপ। সেসব কথা ঘনিষ্ঠ মহল ছাড়া কাউকে বলতেও পারছেন না। কারণ, ভালো করেই জানেন, বলতে গেলেই পালটা পরামর্শ শুনতে হবে- ‘এই সময়টা একটু সহ্য করতেই হবে।’ তার পর তো, হু থেকে শুরু করে চিন-ইতালি, সব গল্পও শুনতে হবে মুখ বুজে। এই সব কারণেই মুখ খুলছেন না অভিরূপরা। তাঁদের শুধু একটাই প্রশ্ন, করোনার এই ‘ফোনে জ্বালাতন’ কবে বন্ধ হবে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *