কলকাতার মত যোদ্ধা গ্যালারি করতে চায় চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব

অশোক সেনগুপ্ত
আমাদের ভারত, কলকাতা, ২০ মার্চ:
“এত সুন্দর একটা জিনিস, ওঁরা করে দিলেন। আমরা পারলাম না!” স্বগতোক্তির মত বললেন চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের কর্তাব্যক্তিরা। রবিবার ওঁরা এসেছিলেন দক্ষিণ কলকাতায় ‘বিপ্লবতীর্থ চট্টগ্রাম স্মৃতি সংস্থা’-র সূর্য সেন ভবনে ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা’ ছায়াছবি প্রদর্শন এবং সংশ্লিষ্ট আলোচনায়। সেখানেই বিপ্লবীদের গ্যালারি দেখে মোহিত চট্টগ্রামের প্রতিনিধিরা। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক দেবদুলাল ভৌমিক এই প্রতিবেদককে বলেন, “এই ভাবনা আমাদেরও এরকম একটা স্মৃতি সংরক্ষণের চেষ্টা উস্কে দিল।“

দেবদুলালবাবু এই প্রতিবেদককে বলেন, “কলকাতার এই গ্যালারি দেখে আমাদের মন ভরে গেল। এর পিছনে যেটা বড় অবদান তা হল নিষ্ঠা, আন্তরিকতা। দেশপ্রেম না থাকলে এ কাজ করা যায় না। এটা একটা আবেগের বিষয়। মুক্ত ভারত না পেলে তো মুক্ত বাংলাদেশ হত না! অতীতকে ভুলে গেলে চলবে না। চট্টগ্রামের স্বাধীনতা সংগ্রাম এভাবে যে কলকাতার বুকে লুকিয়ে থাকতে পারে, আমাদের তা জানা ছিল না। এখনও সেই সংগ্রামের পরশ ধরে রেখেছেন উদ্যোক্তারা। বিষয়টা আমাদের নাড়া দিয়েছে। ভাবিয়েছে। চট্টগ্রামে এ রকম একটা ভাবনা কীভাবে রূপায়িত করা যায়, তা ভাবতে শুরু করেছি।“

রবিবার সন্ধ্যায় ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা’-র বিশেষ প্রদর্শনী উপলক্ষে অনুষ্ঠানের সমাবেশে এসে যোদ্ধা গ্যালারি দেখে প্রীত ছবির পরিচালক প্রদীপ ঘোষ, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ডঃ সাজ্জাদ হোসেন, তাঁর স্ত্রী তথা চলচ্চিত্রের সহযোগী প্রযোজক শারমিনা চৌধুরী, প্রযোজক ডা. মং ঊষা থোয়াই মারমা, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সভাপতি সালাহউদ্দিন মোঃ রেজা এবং অনুষ্ঠানে আসা ক্লাবের কার্যনির্বাহী পরিষদের আরও পাঁচ সদস্য। মুঠোফোনে ধরে রাখলেন তাঁদের স্মৃতি।

প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডে তালতলার মাঠের পাশে সূর্য সেন ভবনে এই গ্যালারিতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের আন্দোলনের যোদ্ধাধের বিভিন্ন সময়ের সংগৃহিত ছবি বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে। ‘বিপ্লবতীর্থ চট্টগ্রাম স্মৃতি সংস্থা’-র অন্যতম যুগ্ম সম্পাদক তপন বিকাশ দত্ত এই প্রতিবেদককে জানান, “চট্টগ্রামের সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত বেশ কিছু সামগ্রি আমরা সংগ্রহ করেছি। এগুলো নিয়ে ওই গ্যালারির পাশেই একটা ছোট সংগ্রহশালা তৈরি করব।“

যোদ্ধা পরিবারের উত্তরসূরী তথা সংগঠনের আর এক যুগ্ম সম্পাদক অজয় সেন জানান, “১৯৩০-এর ১৮ এপ্রিল থেকে চার দিন স্বাধীন ভারতের পতাকা উড়েছিল চট্টগ্রামে। আজ সেই ইতিহাস লোকে ভুলতে শুরু করেছে। অনেক ভুল তথ্য অন্তর্জালে ছড়াচ্ছে। এতে বিকৃত হচ্ছে ইতিহাস। এদিক থেকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।”

১৯৩২-এর ২৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের ইওরোপীয়ান ক্লাবে আক্রমণ হানে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নেতৃত্বে একদল যোদ্ধা। এর অনেক আগে থেকেই সেখানে শুরু হয়েছে বিপ্লবীদের যুদ্ধ। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার সেই বিপ্লবীদের রাষ্ট্রীয় সফরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিেন। প্রায় সদ্য বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা হয়ে যোগ দেওয়া স্বাগতা সেন (দত্ত) ছিলেন সেই দলে। গিয়েছিলেন তাঁর বাবা বিধুভূষণ সেনের সঙ্গে। এই ৭৬ বছর বয়সেও স্বাগতাদেবীর সেই স্মৃতি যেন অটুট।

তাঁর কথায়, জালালবাদ পাহাড়ে ’৭২-এর সেই সফরে বাবাকে সহযোদ্ধা শচীন সেন (মানদা) বললেন, ওই ঠিক এ জায়গায় গুলিলেগে পড়ে গিয়েছিল নির্মল। তখন ওর বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর ৯ মাস। মাস্টারদা (সূর্য সেন), ফুটুদার (তারকেশ্বর দস্তিদার) পরেই ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির তৃতীয় সেনাধ্যক্ষ ছিলেন বিনোদ দত্ত। সেই বিনোদ দত্ত আমাদের মামা, সফরসঙ্গী আর এক যোদ্ধা সরোজকান্তি গুহকে বলছেন, সরোজ সরোজ এখানে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন মধুদা (দত্ত)। ওনার পাশে ছিলেন সহযোদ্ধা নরেশ দত্ত। মধুদা চিরনিদ্রায় যাওয়ার আগে উনি বলে গেলেন, ‘নরেশ তুমি এস। আমি চললাম।’আমার আজও চোখে ভাসে সফরসঙ্গী বড়দের, মানে বাবা-মামাদের চোখে তখনও যেন জ্বলছে সেই আগুন।

বিধুভূষণ সেনের পুত্র অজয় সেন এই প্রতিবেদককে বলেন, “১৯৭৫ সালে আমি চট্টগ্রামের ওই জালালবাদ পাহাড়ে গিয়েছিলাম রাষ্ট্রীয় সফরে। তখনও সামান্য কিছুটা অবশিষ্ট ছিল। এর পর সব লূঠ হয়ে গিয়েছে। যুদ্ধের সব স্মৃতি আজ বিলুপ্ত। সব ধ্বংশ হয়ে গিয়েছে। ফিরিয়ে আনার আর উপায় নেই। অতীতের সঠিক কথা কেবল ধরে রাখলেই চলবে না, পাঁচজনকে জানাতে গিয়ে কী অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষার (সহিষ্ণুতা) মধ্যে দিয়ে এসেছিল ভারতের স্বাধীনতা।”

দেবদুলাল ভৌমিক বলেন, “জীবনমৃত্যু পায়ের ভৃত্য করে এগিয়ে যাওয়া চট্টগ্রামের সেই অকুতোভয় সেনানীদের পরবর্তী প্রজন্মের এই অনুভবকে আমরা সম্মান জানাই। সম্মিলিতভাবে একটা বড় জনগোষ্ঠীর অবচেতনের অন্দরে যদি সেই আকুতি ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তবেই আমরা সার্থক হব।“

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *