ভোট পরবর্তী হিংসার দহনে দগ্ধ হয়েছিল, দু’বছর পর আজও আতঙ্কে সিঁটিয়ে, থমথমে আউশগ্রামের কাঁকোড়া আদিবাসী পাড়া ও প্রেমগঞ্জ

জয় লাহা, আমাদের ভারত, দুর্গাপুর, ৩ মে: ভোটের ফলাফল ঘোষণা হতেই অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল, হিংসার আগুনে দগ্ধ হয়েছিল গোটা গ্রাম। ভাঙ্গচুর, তছনছ করা হয় বাড়ির জিনিসপত্র। উদ্ধার হয় বোমা। আতঙ্কে প্রাণ বাঁচাতে আস্তানাহীন জঙ্গলে পালিয়েছিল গ্রামের শিশু থেকে মহিলারা। অভিযোগের আঙ্গুল উঠেছিল তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীদের দিকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে নামলো র‍্যাফ, কমব্যাট ফোর্স। দু’বছর পরও সেদিনের ঘটনার আতঙ্কে সিঁটিয়ে গোটা গ্রাম। স্মৃতির স্মরণে আজও থমথমে আউশগ্রামের দেবশালার কাঁকোড়া আদিবাসী পাড়া। 

২০২১ সালের ২ মে রাজ্য বিধানসভার ফল ঘোষণায় তৃণমূল জয়ী হয়। আর ওই ফল ঘোষণা হতে দুর্গাপুর, পানাগড় সহ আউশগ্রামে হিংসার অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে। হিংসার ঘটনায় আক্রান্ত হয় আউশগ্রামের দেবশালা পঞ্চায়েতের কাঁকোড়া আদিবাসী পাড়া ও প্রেমগঞ্জ গ্রাম। অভিযোগ, দুবছর আগে এদিন সকালে তৃণমূলের বিজয় উচ্ছ্বাস হচ্ছিল। ওই সময় আদিবাসীদের মারধর করা হয়। শুধু তাই নয়, গোটা গ্রামে বাড়ি বাড়ি ঢুকে ভাঙ্গচুর ও তান্ডব চালানো হয়। বাড়ির জিনিস পত্র ভাঙ্গচুর ও লুটপাট করা হয়। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় বাড়িতে। রান্না করা খাবার নষ্ট করে দেওয়া হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় পড়ুয়াদের বই খাতা। বাড়ির উঠানে ফেলে দেওয়া হয় ড্রাম ও বস্তা ভর্তি চাল। বোমাবাজি করা হয় বলে হয় বলে অভিযোগ। প্রাণ বাঁচাতে আতঙ্কে অসহায়, নিরন্ন হয়ে গ্রাম ছেড়ে ঠিকানাহীন জঙ্গলে দৌ়ঁড়তে শুরু করে শিশু থেকে গ্রামের মহিলারা। জঙ্গল দিয়ে পার্শ্ববর্তী কাঁকসা থানার মুরগাবনি গ্রামে আশ্রয় নেয় তারা।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছায় ডিসি অভিষেক গুপ্তার নেতৃত্বে বুদবুদ ও কাঁকসা থানার বিশাল পুলিশ বাহিনী। নামে র‍্যাফ, কমব্যাট ফোর্স। দমকলের দুটি ইঞ্জিন গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রনে আনে। ঘটনাস্থল থেকে একটি বোমা উদ্ধার করে।

সেদিনের ওই দুষ্কৃতী তান্ডব ও নৃশংসতা দু’বছর পরও গ্রামবাসীদের কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। দু’বছর আগে তৃণমূল সরকার গঠন করে, কিন্তু বদলে যায়নি কাঁকোড়া গ্রামের জীবন জীবিকা। এখনও ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আতঙ্কে সিঁটিয়ে গোটা গ্রাম। দু’বছর পর আজও থমথমে গোটা গ্রাম। যদিও ঘটনায় দু’পক্ষই মামলা দায়ের করে। গ্রামে পরিদর্শনে আসে কেন্দ্রীয় এসটি কমিশনের প্রতিনিধি দল। দু’বছর পর পোড়া বাড়ি সারাই হয়েছে। নিজেদের কাজে যোগ দিয়েছে বাসিন্দারা। তবে তৃণমূলের দায়ের করা মামলায় এখনও পলাতক গ্রামের কয়েকজন যুবক। ১৬টি পরিবারের বসবাস হলেও বদলায়নি গ্রামের রাস্তাঘাট, হয়নি কংক্রিট। এমনকি মোরামও পড়েনি রাস্তায়। পানীয় জলের অবস্থা তথৈবচ। সজলধারা প্রকল্পের জলের পাইপ গ্রামের কাছাকাছি এসেই থমকে পড়েছে। ক্ষয়ক্ষতির ক্ষতিপূরণ বাবদ কিছু টাকা জুটলেও, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় হাতেগোনা কিছু বাসিন্দার নাম তালিকায় এসেছে। অভিযোগ, সক্রিয় বিজেপি করায় তিনটি পরিবার ক্ষতিপূরণও পায়নি। এবার আসা যাক প্রেমগঞ্জ গ্রামের আক্রান্তদের অবস্থায়। 
দু’বছর আগে ২ মে’র রাতে রাজ্য বিধানসভার ফলাফল ঘোষণার পর অমানবিক অত্যাচারের শিকার হয় আউশগ্রামের প্রেমগঞ্জের বিজেপি কর্মী ও তাদের পরিবার। রাতের অন্ধকারে প্রাণ ভয়ে গ্রাম ছাড়তে হয়। রাজনৈতিক হিংসার আক্রামনে ভাঙ্গচুর হয় ঘরবাড়ি। লুট হয় বাড়ির সামগ্রী। সংসারে বেঁচে থাকার রশদটুকুও নেই। উধাও গবাদি পশু থেকে মাঠের সাবমার্শিবল। পচে নষ্ট হয়েছিল মাঠের পাকা ধান। প্রায় একমাস পর পার্শ্ববর্তী ভাতকুন্ডা গ্রামে ত্রিপল টাঙিয়ে থাকতে শুরু করে ১৫টি পরিবার।

সেদিনের ঘটনা বলতে গিয়ে আজও চোখ ভিজে আসে সুভাষ বাগদী, ধর্মদাস বাগদীদের। স্মৃতি বলতে গিয়ে গলা জড়িয়ে পড়ছিল। তারা জানান, “রাতে বৃষ্টি হচ্ছিল, রান্না করা যায়নি। ত্রিপলের ওপর বসে কেউ মুড়ি, কেউ চিঁড়ে খেয়ে রাত কাটিয়েছি। বাচ্চাদের সেরকম কিছু খাবার জোটেনি। তার ওপর সাপের উপদ্রব। বৃষ্টির জলে ভেসে আসছে বিষধর সাপ। রাতভর আতঙ্কে কেউ ঘুমোতে পারেনি। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা লাটে উঠেছিল। সেই আতঙ্কে আজও সিঁটিয়ে।” তবে এখনও বিজেপি করে ওইসব পরিবার।

সুভাষ বাগদী বলেন, “গ্রামে বিজেপি করায় এখনও ১০-১২ জনের প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় নাম ওঠেনি। জোটেনি স্বচ্ছ ভারত মিশনের শৌচাগার। গ্রামে ফিরলেও, চরম বঞ্চনার শিকার।” যদিও ওই সময় প্রেমগঞ্জের আক্রান্ত  বিজেপি কর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছিল সিপিআইএমএল (রেডস্টার) সংগঠনের বর্ধমান জেলা সম্পাদিকা ফতেমা বেগম। অসহায় পরিবারের পাশে পৌঁছে দিয়েছিল খাদ্য সামগ্রী ও ত্রান। দুবছর পর এদিন সুভাষ বাগদী জানান, “এখনও বিজেপি করি। সম্মানের সঙ্গে বিজেপি করবো।”

এদিন আউশগ্রাম -২ নং পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি হায়দার আলি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আউশগ্রাম -২ নং ব্লকে সব গ্রামে উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। কাঁকোড়া আদিবাসী পাড়ার বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হচ্ছে।”  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *