বাংলা বানান, শব্দের উৎস, প্রবাদের নানা কথা, সংকলন তৃতীয় পর্ব – অশোক সেনগুপ্ত

সূচি
৫১। টাকা-পয়সা-ডলার
৫২। কোণ, কোন ও কোনো
৫৩। বলিনি, বলি নি, বলেনি
৫৪। ‘পরশু ও পরশুরাম’
৫৫। মুর্মূ, মূর্মু, মুর্মু
৫৬। বিপৎ, বিপদ
৫৭। আইন ও আদালত
৫৮। উপর/ ওপর
৫৯। পটল তোলা
৬০। ধর্মে আছো, জিরাফেও আছো
৬১। দায়ি বা দায়ী
৬২। কষ্ট, স্ট্যাটাস
৬৩। উঁয়ো
৬৪। কে এবং -কে’ এর ব্যবহার
৬৫। ষ ব্যবহার
৬৬। ও-কার
৬৭। ৎ (খণ্ড ত)
৬৮। সাধু থেকে চলিত রূপের শব্দসমূহ
৬৯। কি বনাম কী
৭০। কি না কী
৭১। ম-ফলা
৭২। দরিদ্র, দারিদ্র্য/ সরল, সারল্য
৭৩। সহকারী কিন্তু সরকারি, কেন?
৭৪। ঠাকুর (পদবি) এল যেভাবে
৭৫। ভাতার

৫১।
টাকা-পয়সা-ডলার

মূল সংস্কৃত ‘টঙ্ক’ শব্দ থেকে অপভ্রংশ ঘটে টাকা শব্দটি এসেছে। টঙ্ক>টক্ক>টাকা। আর সংস্কৃত রৌপ্য (মুদ্রা) থেকে অপভ্রংশের ফলে এসেছে রুপিয়া শব্দটি। গ্রিক ড্রাকমা থেকে দাম।

কিন্তু বিশ্বের গোটা কুড়ি দেশের প্রচলিত মুদ্রা হল ডলার। কথাটা এল কোথা থেকে? ১৫২০-র ১৫ জানুয়ারি বোহেমিয়া রাজ্য জোয়াচিমস্থালে স্থানীয়ভাবে খননকৃত রৌপ্য থেকে মুদ্রা তৈরি করা শুরু করে। বোহেমিয়ান সিংহের ছবি তাতে চিহ্নিত ছিল। শহরের নামানুসারে মুদ্রার নাম দেওয়া হয় জোআচিমস্ট্যালার। লোকে ছোট করে বলতেন থ্যালার বা ট্যালার। জার্মান ওই শব্দ চেক, স্লোভাক এবং  স্লোভেনিয়ায় পরিচিত ছিল টোলার, স্লোভাকে টোলিয়ার, নিম্ন জার্মানিতে ডালার, ড্যানিশ এবং নরওয়েতে রিগসডালার, ইংরেজিতে ডলার।
***

৫২।
কোণ, কোন ও কোনো

‘কোণ, কোন ও কোনো’-এর ব্যবহার—
কোণ : ইংরেজিতে Angle/Corner (∠) অর্থে।
কোন : উচ্চারণ হবে কোন্। বিশেষত
প্রশ্নবোধক অর্থে ব্যবহার করা হয়।
যেমন— তুমি কোন দিকে যাবে?
কোনো : ও-কার যোগে উচ্চারণ হবে।
যেমন— যেকোনো একটি প্রশ্নের উত্তর দাও।

* ও-কার: অনুজ্ঞাবাচক ক্রিয়া পদ এবং বিশেষণ ও অব্যয় পদ বা অন্য শব্দ যার শেষে ও-কার যুক্ত না করলে অর্থ অনুধাবনে ভ্রান্তি বা বিলম্ব সৃষ্টি হতে পারে এমন শব্দে ও-কার ব্যবহার হবে।
যেমন— মতো, হতো, হলো, কেনো (ক্রয় করো), ভালো, কালো, আলো ইত্যাদি।

বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া ও-কার ব্যবহার করা যাবে না।
যেমন— ছিল, করল, যেন, কেন (কী জন্য), আছ, হইল, রইল, গেল, শত, যত, তত, কত, এত ইত্যাদি।
***

৫৩।
বলিনি, বলি নি, বলেনি

ব্যাকরণবিদদের কেউ কেউ মনে করেন, নঞর্থক পদগুলো (নাই, নেই, না, নি) আলাদা করে লিখতে হবে। যেমন— বলে নাই, বলে নি, আমার ভয় নাই, আমার ভয় নেই, হবে না, যাবে না।
অনেকে মনে করেন নি আলাদা বসবে কারণ নি–র আলাদা করে মানে নেই।

আনন্দবাজার পত্রিকার প্রাক্তন উপ বার্তা সম্পাদক শম্ভু সেনেরও সেই মত। তাঁর মতে, “যে পদের অর্থ নেই, তা আলাদা করে লেখা যায় না। যে পদের অর্থ আছে, তা আলাদা করে লিখতে হয়। নাই, নেই, না – এই সব পদ অর্থযুক্ত শব্দ। এদের আলাদা ব্যবহার আছে। তাই এগুলো আলাদা করে লিখতে হয়। কিন্তু ‘নি’ – এটা একটা অর্থহীন পদ। শুধু ‘নি’ বললে কোনো অর্থ প্রকাশ করা হয় না। তাই ‘নি’ সব সময় জুড়ে লিখতে হবে। বলিনি, বলেনি, খায়নি, খাইনি, যায়নি, ইত্যাদি। অর্থাৎ, নি কথাটা কখনোই আলাদা বসবে না। না কথাটা সব সময়ই আলাদা বসবে।
***

৫৪।
‘পরশু ও পরশুরাম’

কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় লিখেছেন, “আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার”

পরশু মানে কুঠার। ঋষি পরশুরামের মূল নাম ছিল রাম। তিনি ভগবান শিবের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। কঠোর তাপস্য ও সাধনার পুরস্কার হিসেবে ভগবান শিব তাঁকে একটি পরশু উপহার দেন, যা দিয়ে তিনি পরবর্তীতে ক্ষত্রিয়দের পরাজিত করে পৃথিবী জয় করেন। তাই তাঁর নাম হয়ে যায় পরশুরাম।

বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরাম পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন। তাঁর পিতা ছিলেন জমদগ্নি এবং মাতা রেণুকা। ক্রোধী ঋষি পরশুরামের খ্যাতি ছিল। তিনি পিতার আদেশে তাঁর মাতাকে হত্যা করেন। পরে অবশ্য পিতৃ আজ্ঞা পালনের জন্য যে বর পান তাতে মাতার পুনর্জীবন, নিজের পাপের স্খালন এবং মাতৃহত্যার স্মৃতি ভুলে যাবার বর প্রার্থনা করে নেন।

পরশুরামের প্রধান অস্ত্র ছিল কুঠার। এই কুঠারকে কঠোর বলার কারণ, তিনি কুঠার দিয়ে অনেক নৃশংস হত্যা করেছিলেন। প্রধানত ক্ষত্রিয় বংশ নির্মূল করার কাজে এই কুঠার ব্যবহৃত হয়েছিল। জনশ্রুতি, এই কুঠারের প্রথম বলি রাজা কার্তবীর্য। পরশুরামের পিতা জমদগ্নি ও মাতা রেণুকা। জমদগ্নি ব্রাহ্মণ হলেও রেণুকা ছিলেন ক্ষত্রিয়কন্যা। জমদগ্নি ঋষির অনুপস্থিতিতে একবার কার্তবীর্য তাঁর আশ্রমে আসেন। রেণুকা যথাবিহিত আপ্যায়ণে কার্তবীর্য এবং পুত্রদের সন্তুষ্ট করলেও কার্তবীর্য হোমধেনুর রস হরণ এবং আশ্রমের অনেক ক্ষতি করেন। পরশুরাম এই সংবাদ পেয়ে কার্তবীর্যের সহস্র বাহু ছেদ করে তাঁকে হত্যা করেন।

পরে অবশ্য কার্তবীর্যের পুত্ররা এর প্রতিশোধ নেয়। তাদের হাতে জমদগ্নি নিহত হন। প্রচণ্ড রোষে ক্ষিপ্ত হয়ে পরশুরাম প্রতিজ্ঞা করেন ক্ষত্রিয় বংশ তিনি নির্মূল করবেন। তাঁর সবল হাতের বলিষ্ঠ কুঠারে শুধু যে কার্তবীর্যের পুত্ররা এবং তাদের অনুচরেরা মারা যান তাই নয়, পৃথিবীকে একশোবার তিনি ক্ষত্রিয়শূন্য করেন। সমস্ত ক্ষত্রিয়ের রক্তে পঞ্চক প্রদেশে যে পাঁচটি রক্তময় হ্রদ সৃষ্টি হয় তাতে তিনি তাঁর পিতৃপুরুষদের তর্পণ করেন। পৃথিবীকে ক্ষত্রিয়শূন্য করবার কাজে তাঁর প্রধান সহায়ক ছিল এই কুঠার, তাই তাঁর কুঠারকে বলা হয়েছে কঠোর।
(সূত্র—মিলিয়নকন্টেন্টডটকম, ১৫ নভেম্বর ২০২১)।
***

৫৫।
মুর্মূ, মূর্মু, মুর্মু

পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মূ ছিলেন ভাষাতত্ত্ববিদ, লেখক, নাট্যকার ও সাঁওতালি ভাষায় ব্যবহৃত ‘অলচিকি’ লিপির উদ্ভাবক ছিলেন। উইকিপিডিয়াতে তাঁর পদবীর বানান লেখা মুর্মূ। উইকিপিডিয়া ভারতের ভাবী রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদীর পদবীর বানান হিন্দিতে লিখেছে মুর্মূ। কিছু প্রচারমাধ্যমে মূ ও মু-এর মিশ্রন দেখা যাচ্ছে।

কিন্তু আনন্দবাজার পত্রিকা, একদিন প্রভৃতি কিছু দৈনিক দুটোই উ কার ব্যবহার করে লিখছে মুর্মু।

বিজেপি বিধায়ক জুয়েল তাঁর নিজের পদবীর বাংলা বানান লিখেছেন মুর্মু।

প্রাক্তন উপাচার্য, অধ্যাপক ডঃ পবিত্র সরকারকে জিজ্ঞাসা করায় উনি জানালন, “এটা সংস্কৃত নয়, তাই দুটোই হ্রস্ব উ-কার হবে।“ প্রাক্তন উপাচার্য তথা বাঙলার অভিজ্ঞ অধ্যাপক ডঃ অচিন্ত্য বিশ্বাস এই প্রতিবেদককে জানালেন, “মুর্মু লেখাই ঠিক।“ ওডিয়া সমাজের অন্যতম কর্তাব্যক্তি, পূর্ব রেলের প্রাক্তন মুখ্য জনসংযোগ অফিসার রবি মহাপাত্রকে প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি কী বলেন? তাঁর চটজলদি জবাব, “পদবীর দুটোই উ-কার।”
***

৫৬।
বিপৎ, বিপদ

প্রাক্তন উপাচার্য, দীর্ঘকালের বাংলার শিক্ষক-গবেষক ডঃ অচিধ্ত্য বিশ্বাস জানিয়েছেন, বিপৎ বিপদ একই শব্দ। সন্ধি যোগ্য শব্দ পরে থাকলে ৎ বদল হয়। বিপৎ+আপন্ন= বিপদাপন্ন, বিপজ্জনক, বিপদোদ্ধার। সন্ধি না হলে বিপৎ।

অনেকের বানানবোধ সংস্কৃত ব্যাকরণ- বিচ্ছিন্ন, ইচ্ছাকৃত এবং অজ্ঞতাপ্রসূত!

ফেসবুকে শুদ্ধ বাংলা চর্চা গ্রুপে ফকরুল ইসলাম ‘বিপৎ এবং বিপদ’ শিরোনামে লিখেছেন, ব্যাকরণগত নিয়মে সন্ধি ও সমাসের মারপ্যাঁচে বিপদ বিপৎ হয়ে যায়। যেমন—
বিপথকাল- বিপদের সময়।
বিপৎকালীন- বিপদের সময় ঘটিত বা উদ্ভূত।

বিপৎচিহ্ন- আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সাবধান করার সংকেত।
বিপৎসংকেত- আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সতর্কবার্তা।
বিপৎপাত- বিপদ সংঘটন।
বিপৎসংকুল- বিপদবহুল।
বিপৎসীমা- জলধারের জলস্ফীতি যে সীমা অতিক্রম করলে বিপদ ঘটতে পারে।

বিপদগর্ভ- বিপজ্জনক।
বিপদগ্রস্ত- বিপদে পড়েছে এমন।
বিপদবহুল- সংকটপূর্ণ।
বিপদভঞ্জন- যে বিপদ নাশ করে।
বিপদাত্মক- যা বিপদ ঘটাতে পারে।
বিপদাপদ- নানাবিধ বিপদ।
বিপদাপন্ন- সংকটাপন্ন।

বিপদুদ্ধার- বিপদ থেকে রক্ষা।
বিপদ্দশা- সংকটময় অবস্থা।
***

৫৭।
আইন ও আদালত

দায়রা আদালত, দায়রা জজ শব্দগুলির সঙ্গে আমরা প্রায় সকলেই পরিচিত। খররের কাগজের রিপোর্টে প্রায়শ শব্দগুলি দেখা যায়। যেমন ”দায়রায় সোপর্দ করা হয়েছে।” তার মানে দায়রা আদালতে খুনোখুনি/ মারামারির বিচার হয় এবং দায়রা জজ এই ধরনের অপরাধের বিচার করেন।

ইংরেজিতে দায়রা আদালতকে sessions court আর দায়রা জজকে sessions judge বলা হয়। আগে একটা বৈঠকেই বা সেশনে অভিযোগের শুনানি ও রায় ঘোষণা করা হতো (এমন এখন হয় না)। এ থেকেই নাম হয়েছে sessions court আর sessions judge।

আইন আদালত সংক্রান্ত অধিকাংশ শব্দ আরবি থেকে এসেছে। আইন এসেছে আরবি ‘আঈন’ থেকে।

মুনসেফ আরবি মুন্সিফ থেকে। কানুন ও দায়রা-ও আরবি। এর অর্থ ক্ষতি, আঘাত, অনিষ্ট ইত্যাদি। দায়রা আদালতে জঘন্য ধরনের অপরাধের বিচার হয় – যার মধ্যে শারীরিক ক্ষতি ঘটার বিষয় থাকে।

এ ছাড়াও তামাদি আরবি শব্দ।
বাংলা শব্দে মিশে থাকা আরবি শব্দ নিয়ে পরে আবার আলোচনা করব।
***

৫৮ ।
উপর/ ওপর

“অক্ষর শুদ্ধ বানান ও ভাষাচর্চা’ ফেসবুক গ্রুপের বিশেষজ্ঞ ‘বানানের টিপস্’ শিরোনামে স্বপন ভট্টাচার্য লিখেছেন, “প্রায়ই একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, ‘উপর’ না ‘ওপর’ কোনটা লেখা সমীচীন?

অনেকে মনে করেন যে ‘উপর’ শব্দটা বোধ হয় তৎসম অর্থাৎ সংস্কৃত শব্দ। তা কিন্তু নয়। সংস্কৃত শব্দ ‘উপরি’ থেকে এসেছে ‘উপর’ > ‘ওপর’ শব্দ। ‘উপর’ শব্দের কথ্য রূপ ‘ওপর’। আর এই দুটোর কোনোটাই ভুল নয়। যে কোন‌ও একটা লেখা যেতে পারে। তবে অনেকে একটু গম্ভীর চালে লিখলে ‘উপর’ আর হালকা চালে লিখলে ‘ওপর’ লেখা পছন্দ করেন।

এই ‘উপর’/’ওপর’ শব্দের কিন্তু অনেক অর্থ হয়। যেমন কেউ বলতে পারেন যে ‘এই লেখাটা মাথার উপর/ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল।’ এখানে উপর/ওপর মানে ঊর্ধ্ব। কিন্তু যদি বলি, ‘একে জ্বর তার উপর/ওপর পেট খারাপ’। এখানে শব্দটার মানে অতিরিক্ত। রাজারা মানুষের উপর/ওপর
অত্যাচার করত‌ (প্রতি)। উপর‌ওয়ালার কথা শুনে চলতেই হবে (ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ)। সে উপরপড়া হয়ে অনেক কথা শুনিয়ে গেল (অযাচিতভাবে)। উপরচালাকি না করাই ভালো (অতিরিক্ত চালাকি)। এছাড়াও উপরচড়াও, উপর‌উপর, উপরচাল এই সব শব্দে‌ও এই শব্দটির ব্যবহার আছে।“
***

৫৯।
পটল তোলা

‘নিউজ ১৮’ (২৫/৬/২০২২) লিখেছে, “পটল ভাজা খান, পটলের দোলমা খান, পটল কীমা খান, আলু-পটল, দই-পটল, সর্ষে পটল সবই খান কিন্তু পটল তুলতে যাবেন না মোটেও।

বাংলায় পটল সুস্বাদু হলেও অভিধান বলছে পটল তোলা মানে মারা যাওয়া। পটল তোলার ইংরেজি প্রতিশব্দ Die, Kick the bucket, Croak- সবগুলোর অর্থই মারা যাওয়া।

আসলে কোনও ফলদায়ী পটল গাছের সবগুলো পটল তুলে ফেললে গাছটি মারা যায়, সেই থেকেই এই বাগধারার প্রবর্তন। অন্যদিকে, চোখের অপর নাম অক্ষিপটল, মৃত্যু হলে চোখ বা অক্ষিপটল উপরের দিকে উল্টে যায়; তাই পটল তোলা শব্দের দ্বারা মৃত্যুকেই বোঝায়।

আবার কেউ কেউ বলেন মৃত ব্যক্তির পট বা পরিধেয় বস্ত্র তুলে রাখতে হয়; সেই পট তোলা কালক্রমে পটল তোলায় রূপান্তরিত হয়েছে।
***

৬০।
‘ধর্মে আছো, জিরাফেও আছো’

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটা কাব্যগ্রন্থের নাম ‘ধর্মে আছো, জিরাফেও আছো’। কথাটির অর্থ কী?

জনশ্রুতি আছে, জয়পুরের মহারাজ একদা জাহাজে করে আফ্রিকা থেকে একটি জিরাফ নিয়ে আসেন। এমন বিশালাকৃতির কোনো প্রাণী জয়পুরবাসী আগে দেখেনি। তাই, অনেকেই সেই জিরাফ দেখার জন্য রাজার চিড়িয়াখানায় ভিড় জমায়। অন্যদিকে, রাজার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে ধর্মগুরুরা প্রচার করতে লাগলো, এই প্রাণী ঈশ্বরের সৃষ্ট কোনো প্রাণী নয়, এটা নিশ্চয়ই শয়তানের সৃষ্টি। তাদের এমন মতবাদ প্রচারের ফলে, ধর্মপ্রাণ মানুষ জিরাফ দেখা থেকে বিরত থাকে। কিন্তু, মহারাজও কম নয়। তিনি বুদ্ধি খাটিয়ে রাতেও চিড়িয়াখানা উন্মুক্ত রাখার ব্যবস্থা করেন। এদিকে, স্বয়ং ধর্মগুরুরা কৌতূহলী হয়ে রাতের আঁধারে গোপনে সেই জিরাফ দেখতে যায়, যা পরে জানাজানি হয়ে যায়।

সেই থেকে এই প্রবাদের প্রচলন। অর্থাৎ, সুবিধাবাদী মানুষ, যারা নিজের স্বার্থে দুই পক্ষ অবলম্বন করে তাদেরকে নিয়ে এই প্রবাদ; “ধর্মে আছো, জিরাফেও আছো”।

‘শুদ্ধ বানান চর্চা’ ফেসবুক গ্রুপে ফকরুল ইসলাম একথা জানিয়ে লিখেছেন, “আমি গুগলে পেয়েছি। কেউ প্রামান্য অন্য তথ্য দিতে পারেন।”

সন্দিহান হয়ে প্রাক্তন উপাচার্য বাংলার অধ্যাপনায় ৩৮ বছরের অভিজ্ঞ ডঃ অচিন্ত্য বিশ্বাসের কাছে এটির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। তাঁর উত্তর, “ধর্ম আর জিরাফ তুলনায় আসে না, এমন দুটি বস্তর মধ্যেই আছি। অর্থাৎ সার্বিক বিশ্বাসহীন এক সময়ের ইঙ্গিত। শক্তি চট্টোপাধ্যায় যে মৌহূর্তিক মজা বা মৌজের জন্য ‘প্লতেরো’ বা ‘নৈরাকার’ লিখেছেন, এই ধর্ম- জিরাফও তেমনি। জয়পুরী কহানির অন্য মুদ্রিত প্রমাণ আছে কি?“

আর এক প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক, ভাষাবিদ ডঃ পবিত্র সরকারও অবশ্য এই ঘটনার সত্যতায় একমত হতে পারেননি। তাঁর মতে, “শক্তি ওই গল্প জানত বলে আমার মনে হয় না। এটা একটা চমকপ্রদ কথা ও উদ্ভাবন করেছে। এ বইয়ের সঙ্গে সুবিধাবাদের কোনও সম্পর্ক তো দেখি না।”
***

৬১ ।
দায়ি বা দায়ী

অক্ষর, শুদ্ধ বানান ও ভাষা চর্চা গ্রুপে ‘বানানের টিপস্’-এ স্বপন ভট্টাচার্য লিখেছেন, “ইদানীং লক্ষ্য করেছি আমরা অনেক সময়ই ‘দায়ি’ বা ‘দায়ী’ কোনটা লিখব তা বুঝে উঠতে পারি না।

এই ‘দায়ী’ শব্দের একটি অর্থ দায়ক বা প্রদানকারী। যেমন: জীবনদায়ী, কষ্টদায়ী, আনন্দদায়ী ইত্যাদি। আর একটি অর্থ দায় আছে যার (দায়+ইন্)। যেমন: এই কাজের জন্য আমি দায়ী নই। প্রথম অর্থে ‘দায়ী’ শব্দটি ব্যবহারের সময় আমরা সাধারণত ভুল বানান লিখি না। কিন্তু আমাদের বেশি ভুল হয় দ্বিতীয় অর্থে এই শব্দের ব্যবহারে।

আমরা এই শব্দের ভুল বানান লিখি কেন? সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম অনুযায়ী ‘ইন্’ প্রত্যয় যোগ হলে অ-কারান্ত শব্দের শেষে দীর্ঘ ঈ হয়। যেমন: মান+ইন্ = মানী, জ্ঞান+ইন্ = জ্ঞানী, দায়+ইন্ = দায়ী ইত্যাদি। কিন্তু এই শব্দের সঙ্গে ‘ত্ব’ এবং আরও কয়েকটি প্রত্যয় যোগ হলে শব্দশেষের দীর্ঘ ঈ, হ্রস্ব ই হয়ে যায়। যেমন: মন্ত্রী+ত্ব = মন্ত্রিত্ব, ঠিক তেমনি দায়ী+ত্ব = দায়িত্ব। আর এই শব্দটা আমাদের মাথায় থাকে বলেই আমরা লিখে ফেলি ‘দায়ি’। আবার এর উল্টোটাও হয়। দায়ী শব্দের সঙ্গে ‘ত্ব’ জুড়ে আমরা অনেক সময় ‘দায়ীত্ব’ লিখে ফেলি।

তবে মনে রাখতে হবে যে ঈ-কারান্ত সব শব্দই কিন্তু ‘ইন্’ প্রত্যয়ান্ত শব্দ নয়। তাই সেগুলোর সঙ্গে অন্য শব্দের সমাস হলেও সেই ঈ-কার বদলে ই-কার হয়ে যাবে না। যেমন: স্বামী (স্ব+আ+মিন্) + ত্ব = স্বামীত্ব অথবা সুধী (সু+ধী) + জন = সুধীজন।

এছাড়াও মনে রাখতে হবে যে দায়ক অর্থে দায়ী শব্দকে স্ত্রীলিঙ্গ করলে হয়ে যাবে দায়িনী। যেমন: আনন্দদায়ী থেকে আনন্দদায়িনী। সুতরাং আমরা লিখব ‘দায়ী’, ‘দায়িত্ব’, ‘জীবনদায়ী’, ‘জীবনদায়িনী’‌, স্বামীত্ব, সুধীজন।
***

৬২।
কষ্ট, স্ট্যাটাস

‘স্ট’ এবং ‘ষ্ট’ ব্যবহার: বিদেশি শব্দে ‘স্ট’ ব্যবহার হবে। বিশেষ করে ইংরেজি st যোগে শব্দগুলোতে ‘স্ট’ ব্যবহার হবে।

যেমন—পোস্ট, স্টার, স্টাফ, স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, স্ট্যাটাস, মাস্টার, ডাস্টার, পোস্টার, স্টুডিও, ফাস্ট, লাস্ট, বেস্ট ইত্যাদি।

ষত্ব-বিধান অনুযায়ী বাংলা বানানে ট-বর্গীয় বর্ণে ‘ষ্ট’ ব্যবহার হবে। যেমন— বৃষ্টি, কৃষ্টি, সৃষ্টি, দৃষ্টি, মিষ্টি, নষ্ট, কষ্ট, তুষ্ট, সন্তুষ্ট ইত্যাদি।

‘পূর্ণ’ এবং ‘পুন’ (পুনঃ/পুন+রেফ/
পুনরায়) ব্যবহার ‘পূর্ণ’ (ইংরেজিতে Full/Complete অর্থে) শব্দটিতে ঊ-কার এবং র্ণ যোগে ব্যবহার হবে।
যেমন— পূর্ণরূপ, পূর্ণমান, সম্পূর্ণ, পরিপূর্ণ ইত্যাদি।

‘পুন’ (পুনঃ/পুন+রেফ/পুনরায়— ইংরেজিতে Re-অর্থে) শব্দটিতে উ-কার হবে এবং অন্য শব্দটির সাথে যুক্ত হয়ে ব্যবহার হবে।
যেমন— পুনঃপ্রকাশ, পুনঃপরীক্ষা, পুনঃপ্রবেশ, পুনঃপ্রতিষ্ঠা, পুনঃপুন,
পুনর্জীবিত, পুনর্নিয়োগ, পুনর্নির্মাণ, পুনর্মিলন, পুনর্লাভ, পুনর্মুদ্রিত, পুনরুদ্ধার, পুনর্বিচার, পুনর্বিবেচনা, পুনর্গঠন, পুনর্বাসন ইত্যাদি।

পদের শেষে’-গ্রস্থ’ নয় ‘-গ্রস্ত’ হবে।
যেমন— বাধাগ্রস্ত, ক্ষতিগ্রস্ত, হতাশাগ্রস্ত, বিপদগ্রস্ত ইত্যাদি।
***

৬৩।
উঁয়ো

উঁয়ো (ঙ) ব্যবহার যোগে কিছু শব্দ। এক্ষেত্রে অনুস্বর (ং) ব্যবহার করা যাবে না।
যেমন— অঙ্ক, অঙ্কন, অঙ্কিত, অঙ্কুর, অঙ্গ, অঙ্গন, আকাঙ্ক্ষা, আঙ্গুল/আঙুল, আশঙ্কা, ইঙ্গিত, উলঙ্গ, কঙ্কর, কঙ্কাল, গঙ্গা, চোঙ্গা/চোঙা, টাঙ্গা, ঠোঙ্গা/ঠোঙা, দাঙ্গা, পঙ্ক্তি, পঙ্কজ, পতঙ্গ, প্রাঙ্গণ, প্রসঙ্গ, বঙ্গ, বাঙালি/বাঙ্গালি, ভঙ্গ, ভঙ্গুর, ভাঙ্গা/ভাঙা, মঙ্গল, রঙ্গিন/রঙিন, লঙ্কা, লঙ্গরখানা, লঙ্ঘন, লিঙ্গ, শঙ্কা, শঙ্ক, শঙ্খ, শশাঙ্ক, শৃঙ্খল, শৃঙ্গ, সঙ্গ, সঙ্গী, সঙ্ঘাত, সঙ্গে, হাঙ্গামা, হুঙ্কার।

অনুস্বার (ং) ব্যবহার যোগে কিছু শব্দ।
এক্ষেত্রে উঁয়ো (ঙ) ব্যবহার করা যাবে না।
যেমন— কিংবদন্তী, সংজ্ঞা, সংক্রামণ, সংক্রান্ত, সংক্ষিপ্ত, সংখ্যা, সংগঠন, সংগ্রাম, সংগ্রহ, সংগৃহীত।
[দ্রষ্টব্য: বাংলা ও বাংলাদেশ শব্দ দুটি অনুস্বার (ং) দিয়ে লিখতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানে তাই করা হয়েছে।]

বাংলা ভাষায় চন্দ্রবিন্দু একটি গুরুত্বপূর্ণ বর্ণ। চন্দ্রবিন্দু যোগে শব্দগুলোতে চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার করতে হবে; না করলে ভুল হবে। অনেক ক্ষেত্রে চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার না করলে শব্দে অর্থের পরিবর্তন ঘটে। এ ছাড়া চন্দ্রবিন্দু সম্মানসূচক বর্ণ হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। যেমন— তাহাকে>তাঁহাকে, তাকে>তাঁকে ইত্যাদি।
***

৬৪।
‘কে’ এবং -কে’ এর ব্যবহার

প্রশ্নবোধক অর্থে ‘কে’ (ইংরেজিতে Who অর্থে) আলাদা ব্যবহার হয়। যেমন— হৃদয় কে? এখানে প্রশ্ন করা হচ্ছে। বা, কে আপন কে পর। আবার প্রশ্ন বোঝায় না এমন শব্দে ‘-কে’ এক সাথে ব্যবহার হবে। যেমন—হৃদয়কে আসতে বলো।

* বিদেশি শব্দে ণ, ছ, ষ ব্যবহার হবে না।
যেমন— হর্ন, কর্নার, সমিল (করাতকল), স্টার, ইনসান, বাসস্ট্যান্ড ইত্যাদি।

* অ্যা, এ ব্যবহার: বিদেশি বাঁকা শব্দের উচ্চারণে ‘অ্যা’ ব্যবহার হয়। যেমন— অ্যান্ড (And), অ্যাড (Ad/Add), অ্যাকাউন্ট (Account), অ্যাম্বুলেন্স(Ambulance), অ্যাসিস্ট্যান্ট(Assistant), অ্যাডভোকেট (Advocate), অ্যাকাডেমিক (Academic), অ্যাডভোকেসি (Advocacy) ইত্যাদি। অবিকৃত বা সরলভাবে উচ্চারণে ‘এ’ হয়। যেমন—এন্টার (Enter), এন্ড (End), এডিট (Edit) ইত্যাদি।

* ইংরেজি বর্ণ S-এর বাংলা প্রতিবর্ণ হবে ‘স’ এবং sh, -sion, -tion শব্দগুচ্ছে ‘শ’ হবে।
যেমন— সিট (Seat/Sit), শিট, (Sheet), রেজিস্ট্রেশন (Registration), মিশন (Mission) ইত্যাদি।
***

৬৫ ।
ষ ব্যবহার

* শ ষ স তৎসম শব্দে ষ ব্যবহার হবে। খাঁটি বাংলা ও বিদেশি শব্দে ষ ব্যবহার হবে না। বাংলা বানানে ‘ষ’ ব্যবহারের জন্য অবশ্যই ষত্ব-বিধান, উপসর্গ, সন্ধি সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। বাংলায় অধিকাংশ শব্দের উচ্চারণে ‘শ’ বিদ্যমান। এমনকি ‘স’ দিয়ে গঠিত শব্দেও ‘শ’ উচ্চারণ হয়। ‘স’-এর স্বতন্ত্র উচ্চারণ বাংলায় খুবই কম।

‘স’-এর স্বতন্ত্র উচ্চারণ হচ্ছে— সমীর, সাফ, সাফাই। যুক্ত বর্ণ, ঋ-কার ও র- ফলা যোগে যুক্তধ্বনিতে ‘স’-এর উচ্চারণ পাওয়া যায়। যেমন— সৃষ্টি, স্মৃতি, স্পর্শ, স্রোত, শ্রী,
আশ্রম ইত্যাদি।

* সমাসবদ্ধ পদ ও বহুবচন রূপী শব্দগুলোর মাঝে ফাঁক রাখা যাবে না। যেমন— চিঠিপত্র, আবেদনপত্র, ছাড়পত্র (পত্র), বিপদগ্রস্ত, হতাশাগ্রস্ত (গ্রস্ত), গ্রামগুলি/গ্রামগুলো (গুলি/গুলো), রচনামূলক (মূলক), সেবাসমূহ (সমূহ), যত্নসহ, পরিমাপসহ (সহ), ত্রুটিজনিত, (জনিত), আশঙ্কাজনক, বিপজ্জনক (জনক),

অনুগ্রহপূর্বক, উল্লেখপূর্বক (পূর্বক), প্রতিষ্ঠানভুক্ত, এমপিওভুক্ত, এমপিওভুক্তি (ভুক্ত/ভুক্তি), গ্রামভিত্তিক, এলাকাভিত্তিক, রোলভিত্তিক (ভিত্তিক), অন্তর্ভুক্তকারণ, এমপিওভুক্তকরণ, প্রতিবর্ণীকরণ (করণ),

আমদানিকারক, রফতানিকারক (কারক), কষ্টদায়ক, আরামদায়ক (দায়ক), স্ত্রীবাচক (বাচক), দেশবাসী, গ্রামবাসী, এলাকাবাসী (বাসী), সুন্দরভাবে, ভালোভাবে (ভাবে), চাকরিজীবী, শ্রমজীবী (জীবী), সদস্যগণ (গণ), সহকারী, আবেদনকারী, ছিনতাইকারী (কারী), সন্ধ্যাকালীন, শীতকালীন (কালীন), জ্ঞানহীন (হীন), দিনব্যাপী, মাসব্যাপী, বছরব্যাপী (ব্যাপী) ইত্যাদি।

এ ছাড়া যথাবিহিত, যথাসময়, যথাযথ, যথাক্রমে, পুনঃপুন, পুনঃপ্রকাশ, পুনঃপরীক্ষা, পুনঃপ্রবেশ, পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বহিঃপ্রকাশ শব্দগুলো একত্রে ব্যবহার হয়।
***

৬৬।
ও-কার

* অনুজ্ঞাবাচক ক্রিয়া পদ এবং বিশেষণ ও অব্যয় পদ বা অন্য শব্দ যার শেষে ও-কার যুক্ত না করলে অর্থ অনুধাবনে ভ্রান্তি বা বিলম্ব সৃষ্টি হতে পারে এমন শব্দে ও-কার ব্যবহার হবে।

যেমন— মতো, হতো, হলো, কেনো (ক্রয় করো), ভালো, কালো, আলো ইত্যাদি। বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া ও-কার ব্যবহার করা যাবে না।

যেমন— ছিল, করল,যেন, কেন (কী জন্য), আছ, হইল, রইল, গেল, শত, যত, তত, কত, এত ইত্যাদি।

* নঞর্থক পদগুলো (নাই, নেই, না) আলাদা করে লিখতে হবে।
যেমন— বলে নাই, আমার ভয় নাই, আমার ভয় নেই, হবে না, যাবে না।
***

৬৭।
ৎ (খণ্ড ত)

* ‘ৎ’-এর সাথে স্বরচিহ্ন যোগ হলে ‘ত’ হবে।
যেমন— জগৎ>জগতে জাগতিক, বিদ্যুৎ>বিদ্যুত বৈদ্যুতিক, ভবিষ্যৎ>ভবিষ্যতে, আত্মসাৎ>আত্মসাত সাক্ষাৎ>সাক্ষাত ইত্যাদি।

* ইক প্রত্যয় যুক্ত হলে যদি শব্দের প্রথমে অ-কার থাকে তা পরিবর্তন হয়ে আ-কার হবে।
যেমন— অঙ্গ>আঙ্গিক, বর্ষ>বার্ষিক,
পরস্পর>পারস্পরিক, সংস্কৃত>সাংস্কৃতিক, অর্থ>আর্থিক, পরলোক>পারলৌকিক, প্রকৃত>প্রাকৃতিক, প্রসঙ্গ>প্রাসঙ্গিক, সংসার>সাংসারিক, সপ্তাহ>সাপ্তাহিক, সময়>সাময়িক, সংবাদ>সাংবাদিক, প্রদেশ>প্রাদেশিক, সম্প্রদায়>সাম্প্রদায়িক ইত্যাদি।
***

৬৮।
সাধু থেকে চলিত রূপের শব্দসমূহ

আঙ্গিনা>আঙিনা, আঙ্গুল>আঙুল, ভাঙ্গা>ভাঙা, রাঙ্গা>রাঙা, রঙ্গিন>রঙিন, বাঙ্গালি>বাঙালি, লাঙ্গল>লাঙল, হউক>হোক, যাউক>যাক, থাউক>থাক, লিখ>লেখ, গুলি>গুলো, শুন>শোন, শুকনা>শুকনো, ভিজা>ভেজা, ভিতর>ভেতর, দিয়া>দিয়ে, গিয়া>গিয়ে, হইল>হলো, হইত>হতো, খাইয়া>খেয়ে, থাকিয়া>থেকে, উল্টা>উল্টো, বুঝা>বোঝা, পূজা>পুজো, বুড়া>বুড়ো, সুতা>সুতো, তুলা>তুলো, নাই>নেই, নহে>নয়, নিয়া>নিয়ে, ইচ্ছা>ইচ্ছে ইত্যাদি।

* হয়তো, নয়তো বাদে সকল তো আলাদা হবে।
যেমন— আমি তো যাইনি, সে তো আসেনি ইত্যাদি।
[দ্রষ্টব্য: মূল শব্দের শেষে আলাদা তো
ব্যবহারের ক্ষেত্রে এ বিধান প্রযোজ্য হবে।]

* ঙ, ঞ, ণ, ন, ং বর্ণের পূর্বে ঁ হবে না।
যেমন— খান (খাঁ), চান, চন্দ (চাঁদ), পঞ্চ, পঞ্চাশ (পাঁচ) ইত্যাদি।
***

৬৯ ।
কি বনাম কী

ক. ‘কি’ প্রশ্নবোধক অব্যয়। যেসব প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ শব্দের মাধ্যমে কিংবা কেবল অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমেও সন্তোষজনকভাবে দেওয়া যায় সেসব প্রশ্নবোধক বাক্যে ‘কি’ লিখবেন। যেমন: আমি কি খাব? (Shall I eat?), আমি কি আসতে পারি? টাকা আছে কি? তুমি কি জান? (Do you know?)

খ. যেসব প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যাঁ‘ বা ‘না‘ দিয়ে কিংবা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে সন্তোষজনকভাবে দেওয়া সম্ভব নয় সেসব প্রশ্নবোধক বাক্যে ‘কী’ লিখবেন। যেমন : আমি কী খাবো? ( What will Ieat?), তুমি কী চাও? (Waht do you want?), কী করে এতদূর এলে? তোমার বাবা কী করেন? তুমি কী জানো? (What do you know?)

গ. ‘কী’ বিস্ময়সূচক পদ। তবে বিস্ময় ছাড়াও অনিশ্চয়তা, অবজ্ঞা, সম্মান গৌরব, প্রশংসা প্রভৃতি প্রকাশেও ‘কী’ ব্যবহার করা হয়। যেমন: বিস্ময় : কী দারুণ! অনিশ্চয়তা: কী জানি কী হয় না হয়।
অবজ্ঞা: সে আবার কীসের গরিব? প্রশংসা: কী ধনী তিনি জান? ছেলেটি যে কী সাহসী জানলে তুমি হতবাক হয়ে যাবে।

ঘ. কোনভাবে, কেন, কী কারণে, কার মধ্যে, কেমন করে, কী প্রকারের, কেমন প্রভৃতি বুঝালে প্রশ্নজ্ঞাপক মূল বাক্যটির আগে ‘কী’ লিখতে হয়। যেমন: কীভাবে যাবে? কীজন্য এসেছ? কীরকম লোক তুমি? কীসে তোমার আগ্রহ? এত তাড়া কীসের? কীরূপ দেখতে সে? কী উপায়ে তোমাকে সাহায্য করতে পারি?

প্রসঙ্গত, ‘কিভাবে’ বানানটি ভুল। কারণ, এই পদযুক্ত প্রশ্নসূচক বাক্যের উত্তর ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ শব্দে কিংবা অঙ্গভঙ্গিতে দেওয়া যায় না। তাই লিখবেন ‘কীভাবে’। ‘কিভাবে’ লিখবেন না। তেমনি লিখবেন, কীজন্য, কীদৃশ্য, কীসে, কীসের, কীরূপ প্রভৃতি।
***

৭০।
কি না কী

গতকাল কি না কী নিয়ে সংক্ষেপে একপ্রস্থ আলোচনা করেছি। বিষয়টা নিয়ে আজ আর একপ্রস্থ আলোকপাত করলেন আনন্দবাজার পত্রিকার প্রাক্তন উপ বার্তা সম্পাদক শম্ভু সেন। আদতে পদার্থবিদ্যার ছাত্র শম্ভুদা প্রায় ৪৭ বছর ধরে বাংলার শব্দভান্ডার নিয়ে গভীরভাবে ভাবনাচিন্তা করেন।

তাঁর মতে, (১) প্রশ্নবোধক অব্যয় ছাড়াও কথার লব্‌জে যখন ‘কি’ আসে তখনও হ্রস্ব ই-কার হবে। যেমন – ‘চাই-কি তোমার সঙ্গে আমি যেতে পারি’, কিংবা ‘আমি তোমার সঙ্গে যাব বই-কি!’ কথার লব্‌জে আসা ‘কি’ বলহীন অর্থাৎ stress নেই। তাই চাই-কি, বই-কি, এমনকি ইত্যাদি।

এ ভাবেই অর্থ ভেদে ‘এমনকি’ বা ‘এমন কী’-র প্রয়োগ আছে। যেমন – ‘এমনকি আমিও সেখানে চলে গিয়েছিলাম’; অথবা ‘এমন কী কথা বললাম যে তুমি রাগ করলে?’ প্রথম বাক্যে দেখুন, ‘এমনকি’ উচ্চারণে কোনো বল বা stress নেই, দ্বিতীয় বাক্যটির ক্ষেত্রে ‘এমন কী’-র উপর জোর আছে।

(২) এ ভাবেই তফাত করতে হবে ‘সে কী’ আর ‘সে কি’-এর মধ্যে। প্রথম ‘সে কী’-তে জোর আছে – ‘সে কী? কখন এ সব ঘটল?’ এই ‘সে কী’ বিস্ময়বাচক শব্দ। আর দ্বিতীয় ‘সে কি’ হ্যাঁ-না প্রশ্নের কি – ‘সে কি এল?’

(৩) বাংলায় ‘কি’ আর ‘না’ বিচ্ছিন্ন ভাবে প্রয়োগ হয় আবার সংযুক্ত ভাবেও প্রয়োগ হয়। – যেমন, প্রথম ক্ষেত্রে ‘তুমি বলবে কি না, বলো’; অর্থাৎ বলবে কি বলবে না, বলো। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কথার মাত্রা হিসাবে – ‘তুমি বলবে কিনা তাই ছটফট করছ’- অর্থাৎ বলবে বলে ছটফট করছে – দু’টি ক্ষেত্রেই ক-এ হ্রস্ব ই-কার।

(৪) ‘কি’-এর এই প্রয়োগ ভিন্ন বাকি সব ক্ষেত্রেই ক-এ দীর্ঘ ঈ-কার।
বিশেষণের বিশেষণে– ‘কী চমৎকার!’
প্রশ্নমূলক সর্বনামে – ‘কী গাব আমি, কী শুনাব।’
বিকল্পাত্মক বিশেষণে – ‘কী যদু কী মধু, দুটোই সমান পাজি।
কীসে, কীসের, কী ভাবে, কী রকম, কী জন্য, কী রে, কী হে – এগুলিতেও ক-এ দীর্ঘ ঈ-কার।

‘কেমন করে’ বোঝাতে ‘কী’ ব্যবহার হলে তখনও ক-এ দীর্ঘ ঈ-কার। যেমন – ‘যাব কী, যা ভয়ংকর জায়গা’; কিংবা ‘খাব কী, যা বিশ্রী খেতে’ ইত্যাদি।“
***

৭১। ম-ফলা

গ, ঙ, ট, ণ, ন, বা ল বর্ণের সঙ্গে ম-ফলা যুক্ত হলে, ম-এর উচ্চারণ বজায় থাকে। যুক্ত ব্যঞ্জনের প্রথম বর্ণের স্বর লুপ্ত হয়। যেমন— বাগ্মী (বাগ্মি), যুগ্ম (যুগ্মো), মৃন্ময় (মৃন্ময়), জন্ম (জন্মো), গুল্ম (গুল্মো)।

ব -ফলার উচ্চারণ: ক. শব্দের প্রথমে ব-ফলা যুক্ত হলে উচ্চারণে শুধু সেই বর্ণের উপর অতিরিক্ত ঝোঁক পড়ে। যেমন— ক্বচিৎ (কোচিৎ), দ্বিত্ব (দিত্তো), শ্বাস (শাশ্), স্বজন (শজোন), দ্বন্দ্ব (দন্দো)।

শব্দের মধ্যে বা শেষে ব-ফলা যুক্ত হলে যুক্ত ব্যঞ্জনটির দ্বিত্ব উচ্চারণ হয়। যেমন— বিশ্বাস (বিশ্শাশ্), পক্ব (পক্কো), অশ্ব (অশ্শো)।

সন্ধিজাত শব্দে যুক্ত ব-ফলায় ব-এর উচ্চারণ বজায় থাকে। যেমন— দিগ্বিজয় (দিগ্বিজয়), দিগ্বলয় (দিগ্বলয়)।

শব্দের মধ্যে বা শেষে ‘ব’ বা ‘ম’-এর সঙ্গে ব-ফলা যুক্ত হলে ব-এর উচ্চারণ বজায় থাকে। যেমন— তিব্বত (তিব্বত), লম্ব (লম্বো)।

উৎ উপসর্গের সঙ্গে ব-ফলা যুক্ত হলে ব-এর উচ্চারণ বহাল থাকে। যেমন— উদ্বাস্তু (উদ্বাস্তু), উদ্বেল (উদ্বেল্)

প্রয়োজনীয় কিছু শুদ্ধ বানানঃ
উজ্জ্বল, জ্বলজ্বলে, জ্বলন্ত, জ্বালানি, প্রাঞ্জল, অঞ্জলি, শ্রদ্ধাঞ্জলি,গীতাঞ্জলি।

অধ্যক্ষ, প্রতীক, ব্যাখ্যা, আকস্মিক, মূর্ছা, ক্ষীণ, মুখমণ্ডল, অনুরণন, হাস্যাস্পদ, সালিস, সত্বর, উচ্ছ্বসিত, স্বেচ্ছাচারী, কর্মচারী, বিচি, বাণী, শ্বশুর, শাশুড়ি।

পরিপক্ব, লজ্জাকর, ভাস্কর, দুষ্কর, সুষমা, নিষিদ্ধ ষোড়শ, নিষ্পাপ, কলুষিত, বিষন্নতা, ওষ্ঠ, সম্মুখ, সম্মান, সংজ্ঞা, ব্যাখ্যা, আনুষঙ্গিক, রূদ্ধশ্বাস, দুর্নাম, অন্তঃস্থল, নগণ্য, আতঙ্ক, জটিল, গগণ, তিথি, অতিথি।
***

৭২ ।
দরিদ্র, দারিদ্র্য/ সরল, সারল্য

অক্ষর শুদ্ধ বানান ও ভাষাচর্চা ফেসবুক গ্রুপে ‘বানানের টিপস্’-এ স্বপন ভট্টাচার্য লিখেছেন “দরিদ্র শব্দটা বিশেষণ। এই শব্দের সঙ্গে ষ্ণ্য (য) অথবা ‘তা’ যোগ করে একে বিশেষ্য শব্দে পরিণত করা হয়। যেমন: দরিদ্র+য = দারিদ্র্য, দরিদ্র+তা = দরিদ্রতা। আমরা অনেক সময়ই ভুল করে এই দুটি প্রত্যয়‌ই এক‌ই সঙ্গে লাগিয়ে দিই, লিখে ফেলি ‘দারিদ্র্যতা’।

এই শব্দের কিন্তু কোন‌ও অর্থ নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে কোন‌ও শব্দে একই অর্থে দুটো প্রত্যয় লাগানো যায় না। আমরা হয় লিখব ‘দারিদ্র্য’ অথবা লিখব ‘দরিদ্রতা’। ঠিক সেভাবেই স্বাতন্ত্র্য বা স্বতন্ত্রতা, সারল্য বা সরলতা, দৌর্বল্য বা দুর্বলতা, ঔদার্য বা উদারতা, বৈশিষ্ট্য বা বিশিষ্টতা, নৈপুণ্য বা নিপুণতা ইত্যাদি শব্দ লিখলে যে কোন‌ও একটা লিখব।

আর একটা কথা, অনেকে হয়তো প্রশ্ন করবেন স্বতন্ত্র থেকে স্বাতন্ত্র্য বা সরল থেকে সারল্য হচ্ছে কেন? অর্থাৎ একটা বাড়তি আ-কার আসছে কেন? অথচ স্বতন্ত্রতা বা সরলতা শব্দে তো গোড়ার স্বরের কোনও পরিবর্তন হচ্ছে না। একে বলে স্বরের বৃদ্ধি। কোনও কোনও প্রত্যয় যুক্ত হলে গোড়ার স্বরের বৃদ্ধি হয়।“
***

৭৩।
সহকারী কিন্তু সরকারি, কেন?

‘নিমোনিক প্রমিত বাংলা বানান অভিধান’-এ ড. মোহাম্মদ আমীন জানিয়েছেন, “এর অনেক ব্যাকরণিক কারণ আছে। এত কারণ মুখস্থ করার সুযোগ সবার থাকে না। ছাত্রজীবনে অনেক মুখস্থ করেছি। এবার কঠিন সূত্র মুখস্থ না-করে জেনে যাব সহজে কীভাবে শুদ্ধ বানান আয়ত্তে আনা যায়।

সহকারী: ব্যক্তির সঙ্গে নারী, নারীর সঙ্গে ঈ-কার। তাই ব্যক্তি প্রকাশ করে এমন সব শব্দে ঈ-কার যুক্ত কারী দেবেন। যেমন: অহংকারী, কর্মচারী, নির্মাণকারী, পদাধিকারী, সহকারী, ভ্রমণকারী, গমনকারী, পরিচর্যাকারী, বমনকারী, তদন্তকারী, গণনাকারী- – -।

সরকারি: ‘তরকারি’ বানানে ‘কারি’। ব্যক্তি ছাড়া অন্য কিছু প্রকাশ করলে সোজা ই-কার যুক্ত কারি বসিয়ে দেবেন।
যেমন: কেলেংকারি, তরকারি, দরকারি, রকমারি, সরকারি, টিটকারি, মশকারি, পাইকারি, পায়চারি—।

এরপর যদি কারি-কারীতে ভুল হয় তাহলে আমার দোষ নেই। আমার ভুল হলে দোষ আপনাদের। কারণ, আপনাদের জন্য লিখতে গিয়েই তো ভুল হলো, না কি! শিকারি ব্যতিক্রম। তবে অভিধানে ‘শিকারী’ বানানও দেখা যায়।
***

৭৪।
ঠাকুর (পদবি) এল যেভাবে

‘পৌরাণিক শব্দের উৎস ও ক্রমবিবর্তন’-এ ড. মোহাম্মদ আমীন জানিয়েছেন, “বাংলার শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথের পদবি হিসেবে ‘ঠাকুর’ বহুল পরিচিত একটি শব্দ। শব্দটি ছিল তুর্কি ভাষায় ‘তিগির/ তাগরি’। তুর্কি থেকে এসে শব্দটি সংস্কৃত ও প্রাকৃতে হয়ে যায় ‘ঠক্কুর’। বাংলায় ঠক্কুর থেকে হলো ‘ঠাকুর’। কেউ কেউ মনে করেন শব্দটির মূল উৎস ফারসি।

যাই হোক, তুর্কি/ফারসি উৎসের শব্দ (তু. তাগরি/তিগির =দেবতা); স. ঠক্কুর> ঠাকুর। ঠাকুর কোনো বিশেষ ধর্ম বা সম্প্রদায়গত পদবি নয়। চৌধুরি, মজুমদার, মুস্তাফি প্রভৃতি পদবির মতো ঠাকুর পদবিও মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে ধারণ করতেন। যেমন: কোরেশী মাগন ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, হরিদাস ঠাকুর।

বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, ঠক্কুর থেকে উদ্ভূত ঠাকুর অর্থ (বিশেষ্যে) ভগবান, দেবতা, প্রতীমা, প্রভু, শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি, গুরু, ব্রাহ্মণ, পুরোহিত, পাচক ব্রাহ্মণ, পদবিশেষ। স্ত্রীলিঙ্গে ঠাকুরানি। পদবির চেয়ে অন্যান্য অর্থ বা সম্বোধনে ঠাকুর শব্দটির বহুল ব্যবহার লক্ষণীয়। এক্ষেত্রে শব্দটি হিন্দু সম্প্রদায়ে বহুল প্রচলিত। যেমন, ঠাকুরদা, ঠাকুরমা, ঠাকুর ঘর, ঠাকুরজামাই, ঠাকুরঝি, ঠাকুরদালান, ঠাকুরপূজা, ঠাকুরপো, ঠাকুরমশাই, ঠাকুরাল, বাবুর্চি ঠাকুর, হিন্দু ঠাকুর, মুসলিম ঠাকুর প্রভৃতি।ঠাকুরজামাই তো খুবই পরিচত সম্বোধন: “বলি ও ননদি আর দুমুঠো চাল ফেলে দেয় হাঁড়িতে ঠাকুরজামাই এল বাড়িতে ও ননদি ঠাকুরজামাই এলো বাড়িতে—”। সূত্র: পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.
***

৭৫।
ভাতার

বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, সংস্কৃত ভর্তৃ থেকে উদ্ভূত খাঁটি বাংলা শব্দ ভাতার অর্থ (বিশেষ্যে) স্বামী, পতি; যে ভাত দেয়; গালিবিশেষ।

এ কথা জানিয়ে ড. মোহাম্মদ আমীন লিখেছেন, “যে ভাত দেয় সে ভাতার। স্বামী ভাত দিত, তাই সে ভাতার। প্রাচীন কালে নারীরা বাইরে কাজ করত না। স্বামীর ওপর মৌলিক চাহিদা পূরণের পুরো দায়িত্ব থাকত। বর্তমান কালের জন্যও কথাটি বহুলাংশে সত্য। মৌলিক চাহিদার প্রধান বিষয় হলো খাদ্য; আর বাঙালির প্রধান খাদ্য হিসেবে সবার আগে আসে ভাত। তাই স্বামীকে ভাত-দাতা হিসেবে সম্মান ও কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ ডাকা হতো: ভাতার।

বাঙালি হিন্দুদের বিয়ের পর এখনও একটা ভাত কাপড়ের অনুষ্ঠান হয়। সেখানে স্বামীকে পরিবারের সবার সামনে স্ত্রীকে বলতে হয়, “আজ থেকে আমি তোমার ভাত কাপড়ের দায়িত্ব নিলাম।” মানে তোমার ভাতার হলাম। একসময়, ভাতার সম্মানজনক শব্দ ছিল। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কগত নানা নেতিবাচক জটিলতার কারণে সৃষ্ট ঝগড়ায় নেতিবাচক কথা হিসেবে ক্রমাগত ব্যবহারের ফলে ভাতার হয়ে গেছে গালি! যেমনটি হয়েছে ‘মাগি’ শব্দের ক্ষেত্রে।

সূত্র— ড. মোহাম্মদ আমীন। ব্যাবহারিক প্রমিত বাংলা বানান সমগ্র, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *