জেলা ভাগের সিদ্ধান্তে বিমর্ষ বাঁকুড়া, প্রতিবাদের চিন্তা ভাবনা শুরু

সোমনাথ বরাট, আমাদের ভারত, বাঁকুড়া, ২ আগস্ট: বাঁকুড়া জেলাকে ভেঙে বিষ্ণুপুর জেলা গঠনের সিদ্ধান্তে বিমর্ষ বাঁকুড়ার অধিকাংশ মানুষ।ইতিমধ্যেই তারা প্রতিবাদে নামার চিন্তা ভাবনা শুরু করেছেন। সোমবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যে আরও ৭ টি নতুন জেলা হচ্ছে বলে ঘোষণা করেছেন। বাঁকুড়া জেলাকেও ভেঙে বিষ্ণুপুর জেলা ঘোষণা করেছেন তিনি। তার ঘোষণা মত যদি বিষ্ণুপুর মহকুমার ব্লক গুলিকে নিয়ে আলাদা জেলা হয় তাহলে বিষ্ণুপুর জেলায় থাকছে ইন্দাস, পাত্রসায়ের, কোতুলপুর, জয়পুর, সোনামুখী ও বিষ্ণুপুর ব্লক। আর যদি রাজনৈতিক সাংগঠনিক জেলা হিসাবে ধরা হয় তাহলে ভৌগলিক চিত্রটা কেমন হবে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণা শোনার পরই থেকে জেলাবাসীর মধ্যে একটা অংশ খুশী হলেও অধিকাংশ মানুষই বিমর্ষ। এই নিয়ে নেট দুনিয়া তোলপাড়। দেখা যাচ্ছে কোথাও লাড্ডু বিলি করে আনন্দোচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হয়েছে, আবার কোথাও শোকাতুর মানুষকে চোখের জল ফেলতেও দেখা গেছে। তবে জেলাবাসীর সিংহভাগ মানুষই মনে করছেন এটা জেলা ভাগ নয়, জেলা বাসীকেই দু’টুকরো করা হল। জেলাবাসীর মতামত নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি বলে তারা শাসক দলের সর্বোচ্চ নেত্রীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন।
তাদের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রীর মতামতকে জেলাবাসীর উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছেন জেলার সুশীল সমাজের সিংহভাগ মানুষ।

বাঁকুড়ার বিশিষ্ট সমাজকর্মী গৌতম মিশ্র বলেন, বাঁকুড়া ও বিষ্ণুপুরবাসীর আবেগকে নিশ্চয়ই গুরুত্ব দেবেন মুখ্যমন্ত্রী।

জেলার পুরাতত্ত্ববিদ তথা ক্ষেত্র সমীক্ষক সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, সেই মোঘল আমল থেকে বাঁকুড়া জেলাকে নিয়ে কাটাছেঁড়া চলছে। এই জেলার কিছু অংশ কখনও মুর্শিদাবাদের সঙ্গে, কখনও বীরভূমের সঙ্গে, কখনও বর্ধমান আবার কখনও মেদিনীপুরের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ফের পরবর্তীকালে ফেরতও এসেছে। এই কাটাছেঁড়া আজও চলছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৮৮১ সালের ১৪ মার্চ বাঁকুড়াকে পূর্ণাঙ্গ জেলার মর্যাদা দেওয়া হয়। সেই ভৌগোলিক মানচিত্র নিয়েই বাঁকুড়া জেলা আজও দাঁড়িয়ে আছে।

এখন হঠাৎ জেলা ভাঙার কথা শুনে মোহম্মদ বিন তুঘলকের কথা মনে পড়ছে বলে একরাশ হতাশা ব্যক্ত করেন সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। দু’ভাগ হয়েছে জেলার কবি সাহিত্যিক ও সংস্কৃতি সচেতন মানুষও।

বিষ্ণুপুরের বাসিন্দা প্রবীণ সাংবাদিক ও লেখক স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, জেলা ভাগের ঘোষণায় ভীষণ খুশি হয়েছি। এর ফলে প্রশাসনিক ভাবে বিষ্ণুপুর মহকুমার বাসিন্দাদের সুবিধা হবে। ইন্দাস পাত্রসায়েরের বাসিন্দাদের ১০০ কিমি দূরত্ব কমে ৪০- ৫০ কিমির মধ্যে প্রশাসনিক পরিষেবা পেতে সুবিধা হবে। তার কথায় বিষ্ণুপুর জেলা হলে আরো ১ টা জেলা পরিষদ হবে, সার্কিট হাউস হবে, রবীন্দ্র ভবন হবে, সরকারি বরাদ্দ বাড়বে। ফলে কর্ম সংস্থানও হবে আরও কিছু। স্বপনবাবুর মতে দূরবর্তী সুবিধার সঙ্গে সব দিক দিয়েই সুবিধা পাবেন বিষ্ণুপুর মহকুমাবাসী।

এর পাল্টা দাবি করে জেলার আরেক প্রবীণ সাহিত্যিক তথা বাঁকুড়া প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সন্তোষ ভট্টাচার্য বলেন, যদি দূরবর্তী ভৌগোলিক তথা অবস্থানের কথা বলা হয়, তাহলে খাতড়া মহকুমার ঝিলিমিলি, শিলদা, রাইপুর প্রভৃতি আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার কথা চিন্তা করে জেলা হিসেবে খাতড়াকে ভাবা উচিত। ওই সব এলাকা তো আরো দূরে অবস্থিত। তিনি বলেন, বাম আমলে প্রশান্ত সুর যখন পৌর মন্ত্রী ছিলেন তখন থেকে দাবি উঠেছে খাতড়াকে পুরসভা হিসেবে ঘোষণা করা হোক। কিন্তু আজও তা বাস্তবায়িত হল না। নতুন জেলার থেকেও খাতড়াকে পুরসভা করলে বাঁকুড়াবাসীর আবেগ ও দাবিকে মর্যাদা দেওয়া হত।

সন্তোষ বাবু বলেন, শ্রী শ্রী মায়ের জন্মস্থান জয়রামবাটি, মন্দির শহর বিষ্ণুপুর, সিল্কি শহর সোনামুখীকে নিয়ে জেলাবাসীর একটা আবেগ রয়েছে। তাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তাই এই ঘোষণাকে আমরা মেনে নিতে পারছি না। প্রতিবাদ করবোই। এর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে সম্মিলিত দাবি জানাবো। তার মতে জেলা ভাগ না করে খাতড়াকে পুরসভা ঘোষণা করা হোক। তাহলেই মানুষের উপকার হবে।

উপন্যাসিক ত্রিলোচন ভট্টাচার্য বলেন, পর্যটনের দিক থেকে বাঁকুড়া জেলার শুশুনিয়া মুকুটমণিপুর নিয়ে যেমন কদর আছে তেমনি পুরাতত্ত্বের দিক দিয়ে ঐতিহ্যবাহী শহর হিসেবে সারা বিশ্বে খ্যাতি রয়েছে বিষ্ণুপুরের। বাঁকুড়া জেলার ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী জেলায় আসতে গেলে বর্ধমানের কাছাকাছি ইন্দাসের মানুষের আসতে অনেক কষ্ট হয় ঠিকই। কিন্তু  প্রশাসনিক সুবিধা ইতিমধ্যেই বিষ্ণুপুর মহকুমাকে অনেক কিছু ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

জেলার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ তথা সমাজকর্মী “আমরা সবাই একসাথে”র সাধারণ সম্পাদক সমীরণ সেনগুপ্ত বলেন, এই অবাস্তব সিদ্ধান্তে আমরা হতাশ এবং ক্ষুব্ধ। মুখ্যমন্ত্রীর এই তুঘলকী সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।

প্রবীণ কবি ও সাহিত্যিক সৌমিত্র চ্যাটার্জি বলেন, বাঁকুড়ার মানুষ হিসেবে এই ঘোষণায় আমরা অপমানিত। এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা হোক। এছাড়াও জেলার বিভিন্ন সংগঠন এই ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। জনমত গঠন করতে সোশ্যাল মিডিয়া সহ নানা মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে প্রচার শুরু করে দিয়েছেন তাঁরা। জেলার সুশীল সমাজ ও সাধারণ মানুষ যেমন ক্ষুব্ধ তেমনি রাজনৈতিক ভাবেও জেলাবাসী দু’ ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। শাসক দলেরও অনেকেই এই সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারছেন না।

তৃণমূলের বিষ্ণুপুর সাংগঠনিক জেলার সভাপতি অলক মুখার্জি প্রস্তাবিত জেলার বাঁকুড়ার মধ্যে থাকলেও তিনি বলেন, মুখ্যমন্ত্রী অত্যন্ত সংবেদনশীল একজন প্রশাসক। জেলাবাসীর আবেগের সাথে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিজেপির বিষ্ণুপুর সাংগঠনিক জেলার সভাপতি বিল্লেশ্বর সিংহ । তিনি বলেন, মুখ্যমন্ত্রী অত্যন্ত চতুর এবং ধূর্ত। এই মুহূর্তে গোটা রাজ্যকে দুর্নীতিতে ডুবিয়ে দিয়েছেন তাঁর নেতা-মন্ত্রীরা। সেখান থেকে দৃষ্টি ঘোরাতেই জেলা ভাগের সিদ্ধান্ত। যাতে এই ৭ জেলার মানুষ তাদের আবেগ নিয়ে নিজেদের মধ্যে “ঠিক কি ভুল” এই বিতর্কে জড়িয়ে থাকুক।

সিপিআই(এম)’র প্রাক্তন জেলা সম্পাদক তথা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অমিয় পাত্র বলেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় হিসাব কষে জেলা ভাগ করেছেন। বাঁকুড়ায় থাকছে কয়লা, পাথর, গ্যাস ইত্যাদি খনিজ পদার্থ। আর বিষ্ণুপুরে থাকছে বালি। তাই একটা জেলায় কয়লার কারবার আরেকটা জেলায় বালির কারবার করতে সুবিধা হবে তাঁর।

আমিয় পাত্র বলেন, জেলা ভাগ নিয়ে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে, কাদের প্রয়োজনে জেলা ভাগ এর একটা পদ্ধতি আছে। তিনি বলেন, জেলা ভাগ নিয়ে একটি প্রশাসনিক সংস্কার কমিটিও আছে। সেই কমিটি ১ বছর আগে বিধানসভায় রিপোর্ট জমা দিয়েছেন। এর আগে সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে সর্বদলের সম্মতিতে জেলা ভাগ হয়েছে। কই বিতর্ক ওঠেনি তো। তাহলে এখন সেই কমিটির মতামত নিয়ে সর্বসম্মত ভাবে জেলা ভাগ করলে আপত্তির কিছু থাকত না। সেই পদ্ধতি মেনে না করার একটাই উদ্দেশ্য, দুর্নীতির খোলস ছাড়িয়ে যে টাকার পাহাড় বেরিয়ে এসেছে– সে দিক থেকে দৃষ্টি ঘোরাতেই এই সিদ্ধান্ত। এত দুর্নীতি মানুষ জেনে যাওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী ঘুমোতে পারছেন না। এবার নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *