শিকড় ছিঁড়ে এপারে চলে আসা দেশান্তরীদের কীর্তি নিয়ে অনন্য প্রদর্শনী

অশোক সেনগুপ্ত
আমাদের ভারত, ২৭ নভেম্বর: দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে। সাত পুরুষের ভিটে ছেড়ে এপার বাংলায় চলে আসার ঢল নেমেছে ওপারের হিন্দুদের। ওঁদেরই একজন শান্তিরঞ্জন গাঙ্গুলি। কাজ করতেন ডাকবিভাগে। বরিশালের (অধুনা ঝালোকাঠি) বাড়ি ছেড়ে চলে এলেন এপারে। সঙ্গে মা-বাবা, দু’ভাই।

শান্তিবাবুরা অনেকদিন আগেই চলে গিয়েছেন অন্য লোকে। থেকে গিয়েছে একবুক স্মৃতি। এখনও সেই স্মৃতি আঁকড়ে আছেন দেশান্তরীদের পরিবারের অনেকে। যেমন শান্তিবাবুর নাতনি অর্চি বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই অর্চি ‘কলকাতা পার্টিশন মিউজিয়ম’-এর সহযোগিতায় অন্য রকম একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন আইসিসিআর-এর দ্বিতলে, বেঙ্গল গ্যালারিতে। দুই বাংলার প্রায় একশো জন মৃৎশিল্পী, শঙ্খশিল্পী, তাঁত ও বেনারসি শিল্পী, শীতলপাটি ও শোলা শিল্পীদের জীবন ও কাজে দেশভাগের ‘প্রভাব’, তারই প্রদর্শন— শিল্পনমুনায়।

ফ্যাশন ডিজাইনিং- এর ছাত্রী অর্চির লেখাপড়া চেন্নাই ও লন্ডনে, ‘মিড ফেলোশিপ’ পেয়ে তিনি ফিরেছেন শিকড়ে, বাংলার কারুশিল্প ও শিল্পী-জীবনে খুঁজেছেন দেশভাগের প্রভাব। ফলশ্রুতি তাঁরই ভাবনার ফল (কিউরেট) প্রদর্শনী ‘পার্টেড ক্রাফ্টস। সেখানে প্রদর্শিত প্রতিটি জিনিসের মধ্যে জড়িয়ে আছে ছিন্নমূল, বাস্তুহারাদের মনন আর আবেগ। যেমন ইতি বিশ্বাসের হাতে বোনা শাড়ি।

ইতির সেই শাড়িতে ফুটে উঠেছে নিজের জীবনবৃত্ত। তার জন্ম দুই বোনের পর। তাই নাম হল ঘিন্না। সংখ্যার পরিচয়ের পালা শেষ না হতেই দাঁড়ি পড়ল শিক্ষায়। দারিদ্র্য ছিল নিত্যসঙ্গী। খিদে পেলে পড়শি মুসলিম চাচার বাড়িতে গিয়ে কিছু পেতেন। মেয়ে পার হলে কমে পরিবারের দারিদ্রের বোঝা। কৈশোর না কাটতেই ইতিকেও বিদায় জানাল বাবা-মা। চোখের জলে ছাড়তে হল তাকে আজন্ম বেড়ে ওঠা টাঙাইলের ভিটে। স্বান্ত্বনা জানিয়ে মা বলেছিলেন, “তুই যা। আমরাও চলে যাব।”

স্বামী অজয়ের হাত ধরে ইতি চলে এল ‘ইণ্ডিয়া’য়। নতুন সাকিন হল নদিয়ার ফুলিয়া সংলগ্ন হাবিবপুরে। সেখানে ঘরে ঘরে তাঁত। তাঁতি পরিবারের মেয়ে না হলেও ইতির জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল তাঁতযন্ত্র। মা কথা রেখেছিলেন। তিনিও শিকড় ছিঁড়ে চলে এসেছিলেন ওপার থেকে এপারে। মনের আবেগ দিয়ে মা-কে ইতি বুনে দিয়েছিলেন তাঁতের একটা সুন্দর শাড়ি।

এর পরে কেটে গিয়েছে পাঁচ দশকেরও বেশি সময়। ইতি এখন ব্যস্ত তাঁতশিল্পী। সংসার চালানোর দায় তাঁর ওপরেই। গ্রামবাংলার জীবনের নানা আলেখ্য কাপড়ের ওপর ফুটে ওঠে তাঁর সেই সব শিল্পে। দেশ ভাগ হলেও মন তো ভাগ হয় না।

অর্চির কথায়, “এই ইতিরাই হয়ে উঠেছে আমার অনুপ্রেরণা, বা ধরুণ পাল পরিবারের দুই ভাই শ্যামল-বিমল। নিউ বারাকপুর থেকে এখন আর আমাদের বেহালার বাড়ির দুর্গাপ্রতিমা তৈরি করতে আসতে পারেন না। এই শ্যামল একসময় ওঁর দাদু মানে হীরালাল, যদুনাথের হাত ধরে আমার দাদুর দুর্গাপ্রতিমা তৈরি করতে বরিশালে আসতেন। ওরাও ওপারের পাট গুটিয়ে চলে এসেছেন এপারে। এত কথা শুনেছি শ্যামল-বিমল বা আমার পূর্বপুরুষদের কাছে! আমার অস্থিমজ্জায় মিশে গিয়েছে দুই বাংলার হস্তশিল্প আর শিল্পীরা। ওই শিল্পী- কারিগরেরা নিজেদের কর্মদক্ষতা ছাড়া আর কিছু আনতে পারেননি সঙ্গে।”

প্রদর্শনীতে ঠাঁই পেয়েছে মৃৎশিল্প, সুদৃশ্য শীতলপাটি, মুখোশ, শোলা ও শঙ্খের কাজ, শাঁখ কাটার পেল্লাই ধাতব করাত প্রভৃতি। শীতলপাটিতে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, কোচবিহারের চন্দন ও সুষমা দে-র শিল্পকাজ। আছে বিভিন্ন রকম দলিল-দস্তাবেজ। এপারে স্বামী অনিল বসাকের সঙ্গে বর্ধমানের গোপীনাথপুরে চলে আসা টাঙাইলের আরতিরানী বসাকের পাসপোর্ট।

রবিবার সন্ধ্যায় বসবে ‘সীমান্তে বাংলার শিল্প’ শীর্ষক এক আলোচনাসভা। তাতে থাকবেন কলকাতা পার্টিশন মিউজিয়াম ট্রাস্টের ম্যানেজিং ট্রাস্টি ডঃ ঋতুপর্ণা রায়, ডিজাইনার ও শিল্প গবেষক অর্চি বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘তাঁতিপাড়ার আখ্যান’-এর লেখক হরিপদ বসাক ও বিশ্বভারতী কলাভবনের রিসার্চ স্কলার তথা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মহম্মদ তারিকাত ইসলাম।

প্রদর্শনী শুরু হয়েছে ২৫ নভেম্বর। চলবে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত, দুপুর ৩টে-রাত ৮টা।
ছবিতে প্রদর্শনীর কিছু সামগ্রী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *