আশিস মণ্ডল, শান্তিনিকেতন, ৬ মে: “ভাবতে হবে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে, দেশটা কোথায় দাঁড়িয়ে”। অমর্ত্য সেনকে হেনস্থা প্রসঙ্গে অবস্থান মঞ্চে এমনই মন্তব্য করেন চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পর প্রতীচীর অদূরে শান্তভানু সেনের বাড়ির সামনে অবস্থান মঞ্চে এদিন উপস্থিত হয়েছিলেন গৌতম ঘোষ।
এদিন উচ্ছেদের হুঁশিয়ারি দেওয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান চলাকালীন সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন দেউচা পাঁচামীর আদিবাসীরা। অমর্ত্য সেনের উচ্ছেদ তারা মানছেন না, জানিয়েছেন স্পষ্টভাবে। পাশাপাশি তারা এও জানিয়েছেন, অমর্ত্য সেনের উচ্ছেদ যেমন তারা মানবে না তেমনই কয়লা খনির নামে দেউচা পাঁচামীর স্থানীয় মানুষদের উচ্ছেদও তারা মানবেন না। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনকে বিশ্বভারতীর উচ্ছেদের হুঁশিয়ারির প্রতিবাদে অবস্থানের ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই মত শনিবারও হয়েছে অবস্থান। অমর্ত্য সেনের ‘প্রতীচী’ বাড়ির কাছে মঞ্চ বানিয়ে হয়েছে সেই প্রতিবাদ৷ উপস্থিত ছিলেন চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ, শিল্পী যোগেন চৌধুরী, শিল্পী কবীর সুমন, জেলা পরিষদের সভাধিপতি বিকাশ রায় চৌধুরী প্রমুখ বিশিষ্ঠ জনেরা। অবস্থান মঞ্চে নাম না করে উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর ব্যাঙ্গ চিত্র আঁকেন শিল্পী শুভাপ্রসন্ন। সেখানে উপাচার্যকে হনুমান চিত্রিত করে বিশ্বভারতীতে লঙ্কাকাণ্ডের জন খলনায়ক হিসেবে তুলে ধরা হয়। আঁকা চিত্রে দেখা যায় “এক হনুমান নিজের লেজের আগুনে রবীন্দ্রনাথের গায়ে আগুন লাগাচ্ছে”। শুভাপ্রসন্নর আঁকা একই চিত্র হাতে নিয়ে সবাই মঞ্চ থেকে প্রতিবাদ জানান।
নিজের আঁকা ছবি সম্পর্কে শিল্পী শুভাপ্রসন্ন সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমার মনে হয় একজন অমানুষ রবীন্দ্রনাথকে দগ্ধ করছে। এক ধরনের লঙ্কাকাণ্ড। এছাড়াও নরেন্দ্র মোদী আচার্য হলেও রবীন্দ্রনাথ নিয়ে পড়াশোনা নেই। তিনি সেরকম শিক্ষিত নন বলে মন্তব্য করেন শুভাপ্রসন্ন। প্রতীচীর ধারেপাশে ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা ১৪৫ ধারা জারি থাকা সত্ত্বেও এই ধরনের সভা মঞ্চস্থ করা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে শিল্পী শুভাপ্রসন্ন বলেন, “এই আবোলতাবোল অনেক দিন ধরেই বলছে। আবোলতাবোল কাণ্ডকারখানা অনেক দিন ধরেই করছে। রবীন্দ্রনাথের আদর্শকে ভূলুণ্ঠিত করছে। সব থেকে বড়ো কথা পৃথিবীর মানুষের কাছে অমর্ত্য সেনের অবদান স্বীকৃত। তিনি শুধুমাত্র ভারত রত্ন নন, একজন নোবেল লরিয়েট।”
চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ বলেছেন, “বিশ্বভারতী অচলায়তনে পরিণত হয়েছে। সামান্য জমি নিয়ে অহেতুক ঢাক পেটানো হচ্ছে। অমর্ত্য সেনের জমি সংক্রান্ত আইনী বিষয়ে যাচ্ছি না, তবে ওঁনার মত পন্ডিত মানুষের সাথে এ ভাষায় কথা বলা যায় না। উনার অনেক বয়স হয়েছে। এই বয়সে ভয়ংকর যন্ত্রণা পূর্বপুরুষের ভিটে নিয়ে। এটা কখনও কাম্য নয়। এটাও ভাবতে হবে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে। দেশটা কোথায় দাঁড়িয়ে।”
প্রবীণ আশ্রমিক স্বপন ঘোষ বলেন, “প্রবীণ আশ্রমিক, অর্থনীতিবিদ, নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের প্রতি বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের যে অসম্মান আচরণ তাঁর প্রতিবাদে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের যে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও সমাবেশ ঘটেছে ইদানিংকালে এরকম সমাবেশ ঘটেনি। শুধু তাই নয়, দেশের বুদ্ধিজীবী, চিত্রপরিচালক, কবি, রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী, সমাজসেবী এবং আশ্রমের শিক্ষক, ছাত্র, আশ্রমিক, বাউল, শিল্পী এবং আদিবাসীরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে অমর্ত্যর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। আমার পঞ্চাশ বছরের শান্তিনিকেতন জীবনে এমন ঘটনা ঘটেনি। প্রসঙ্গত, একটা কথা মনে করিয়ে দেওয়া দরকার আমাদের শান্তিনিকেতনের গৌরব বিশ্ববরেণ্য অমর্ত্য সেন যখন ছাত্র ছিলেন শান্তিনিকেতনের আশেপাশের গ্রামে বিশেষ করে আদিবাসী পল্লিতে নৈশ্য বিদ্যালয় পরিচালনার কাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেছিলেন”।
এদিন মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশমত সামিল হয়েছিলেন দলের বিধায়ক-সাংসদরাও৷ বাউল শিল্পীদেরও আনা হয়েছিল অবস্থান মঞ্চে। সেই বাউল শিল্পীদের জিজ্ঞাসা করা হলে তাদের অনেকেই বলেছেন জানতেন না অবস্থানের কারণ কি। যেমন বাউল শিল্পী কৃষ্ণদাস বাউল, “কি অনুষ্ঠান তা তো জানি না। তথ্য সংস্কৃতি দপ্তর থেকে আসতে বলা হয়েছে তাই অনুষ্ঠান করতে এসেছি।”
আবার অমর্ত্য সেনকে উচ্ছেদের হুঁশিয়ারির প্রতিবাদে যখন ধর্না-অবস্থান চলছিল তখনই মাদল বাজাতে বাজাতে মিছিল করে সেখানে হাজির হন দেউচা-পাঁচামীর বাসিন্দারা৷ তাদের হাতে থাকা ব্যানারে ছিল নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের সাথে সাথে দেউচা-পাঁচামীতে আদিবাসীদের উচ্ছেদের প্রতিবাদ। শাসক দলের নেতা মন্ত্রীদের সামনেই স্লোগান দিতে দিতে প্রতিবাদ মিছিল করেন তাঁরা। যে প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দ্বিচারিতার প্রতি ধিক্কার বার্তাই ভেসেছে শান্তিনিকেতনে। অমর্ত্য সেনকে উচ্ছেদের হুঁশিয়ারির বিরুদ্ধে হওয়া
এদিনের অবস্থান মঞ্চের সামনেই জড়ো হওয়া পাঁচামীর আদিবাসীরা সাফ বলেছেন, ‘অমর্ত্য সেনের উচ্ছেদ মানছি না। তাই তাঁর পাশে আমরা দাঁড়াতে এসেছি। পাশাপাশি দেউচা পাঁচামীর সাঁওতালরাও যাতে উচ্ছেদ না হয় সেই বার্তাও দিতে এসেছি। অমর্ত্যের সেনের উচ্ছেদ যেমন মানব না তেমনই দেউচা পাঁচামীর আদিবাসীদের উচ্ছেদও মানছি না।’