ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
আমাদের ভারত, ৩০ জানুয়ারি: ‘রাজা’ নাটকে রবীন্দ্র-সৃষ্ট এক চরিত্র বলছেন, “আমার রাজার ধ্বজায় পদ্মফুলের মাঝখানে বজ্র আঁকা।” ধ্বজায় এই বজ্র আঁকার পরিকল্পনা রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন লোকমাতা নিবেদিতার কাছ থেকে। বজ্র সমন্বিত জাতীয় পতাকা এঁকেছিলেন তিনি। মহর্ষি দধীচি নিজের অস্থি দান করেছিলেন এই বজ্র নির্মাণ করার জন্য। এই আয়ূধ তাই ভারতবর্ষীয় ত্যাগ ও শক্তিসাধনার মহত্তম প্রতীক। রাষ্ট্রের জন্য কঠিন ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন যিনি, তিনি এক-একজন দধীচি মুনি। পতাকার সঙ্গে থাকবে ভারতীয় পদ্ম, এক আধ্যাত্মিক পরিমন্ডলের প্রতীক, হৃদয়রূপ শতদল ফুটিয়ে তোলার সাধনা। পদ্মালয়ে শ্রী এবং লক্ষ্মীর অধিষ্ঠান। মহাবৈভবশালী ভারতরাষ্ট্র হবে সেই লক্ষ্মীশ্রী নিয়ে, সেই ঐশী সত্তা দিয়ে।
এই রাজার স্বরূপ কেমন? সবাই কি রাজাকে চিনতে পারেন? রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “ভিক্ষুকের কর্ম নয় রাজাকে চেনা। ছোটো ভিক্ষুক বড়ো ভিক্ষুককেই রাজা বলে মনে করে বসে।” এ রাজ্যেও বর্তমানে খানিকটা তেমনই অবস্থা। রাজনীতিতে ভিখারি-মানসের হ্যাংলামি রাজাকে চিনতে অসমর্থ হয়েছে। ছোটো নেতা মাঝারি নেতাকে, মাঝারি নেতা বড় নেতাকে রাজা বলে ভুল করে বসে৷ সেইসব নেতারা আপন গোষ্ঠীকে নিয়ে সমান্তরাল রাজ্যপাট চালায়; লুঠপাট চালায়; তোলাবাজি, ধমকানি চমকানির সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “গা-ভরা গয়না পরে রাস্তার দুই ধারের লোকের দুই চক্ষুর কাছে ভিক্ষে চেয়ে বেড়িয়েছে,… লোভীরা তাকেই রাজা বলে ঠাউরে বসে..”। তারা যাবতীয় পাবার জিনিস হাটে কিনে ঘর ভরিয়ে তুলেছে। কিন্তু ” যাহা যায় না পাওয়া তারই হাওয়া” কোথায়?
রাজা কেমন হবেন? ত্রাসের দাসত্বে যখন রাজ্যবাসী বাঁধা থাকবেন না, তখনই হবে আসল রাজ্যপাট। আপন সৌকর্যে, আপন খেয়ালে, আপন খুশিতে শুভঙ্করী যা কিছু সব করতে পারাই সেই রাজ্যে সম্ভব করাতে হবে। যদি “রাজা সবারে দেন মান,/ সে মান আপনি ফিরে পান।” কারও সম্মান, কারও প্রাপ্তি বিন্দুমাত্র কেড়ে নেওয়া চলবে না। সকলকে আপন মতে চলার পথ করে দেবেন রাজা। কেউ বিফলতার বিষম আবর্তে মরবে না তার রাজ্যে। আলাদা করে সেখানে থাকবে না রাজা, মানে রাজাকে আলাদাভাবে চিনতে পারা যাবে না। গণতান্ত্রিকতায় প্রত্যেকের অংশগ্রহণ জরুরি সেই রাজ্যে, সেটাই এর নির্যাস। আর সেখানেই “আমরা সবাই রাজা।” (লেখক একজন অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক)