করম পরব কি? কারা পালন করেন এই বিশেষ উৎসব?

আমাদের ভারত, ৩০ আগস্ট: বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। এমন অনেক পার্বণ আছে যেসবের আমরা নাম জানি। আবার গ্রাম বাংলার অনেক পার্বণের আমরা নামও জানিনা। সেরকমই পশ্চিমবঙ্গের একটি অজানা অথচ গ্রামবাংলায় সুপ্রচলিত একটি পার্বণ হল করম উৎসব। কিন্তু কি এই উৎসব? কারাই বা এই উৎসব পালন করেন? আসুন জেনে নেওয়া যাক……

করম পরব:
১.বিস্তারক্ষেত্র:

এই পরব পালন করা হয় মানভূম এলাকায় (পুরুলিয়া,বাঁকুড়া,পশ্চিম মেদিনীপুর) এমনকি ঝাড়খণ্ডের বুন্ডু তামাড় এলাকার জনজাতির প্রানের উৎসব হল এই করম। এই উৎসবের মাধ্যমে আদিবাসীদের জল-জমিন-জঙ্গলকেন্দ্রিক জীবন ধারার প্রতিফলন দেখা যায়।

২.সময়কাল

এই পরব তিথি নির্ভর। প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শুক্লা একাদশী তিথিতে পালন করা হয় এই পরব। এই দিন করম ডাল পুঁতে করম ঠাকুরের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়। অবশ্য এর প্রস্তুতি শুরু হয় প্রায় এক সপ্তাহ আগে থেকে।

৩.করম ব্রত পালনের রীতি

জাওয়া পাতা:

মূলত গ্রামের অবিবাহিত কুমারী মেয়েরাই এই ‘করম’ ঠাকুরের উপাসক। শুক্লা একাদশীর সাত দিন আগে কুমারী মেয়েরা একত্রে বাঁশের বোনা ‘টুপা’ (ডালা), এবং বিভিন্ন ধরণের শস্যবীজ নিয়ে জড়ো হয় পার্শ্ববর্তী কোনো নদী,খাল,বা পুকুরে। সেখানে প্রত্যেকে স্নান করে শুদ্ধ হয়ে সদ্যস্নাত ভিজে কাপড়ে নিজের নিজের টুপায় নদী খাতের বালি ভর্তি করে বাড়ি থেকে আনা সেই শস্যবীজগুলো বুনে দেয়।তারপর পরস্পরের হাত ধরে এই টুপা কে কেন্দ্র করে গোল হয়ে বিভিন্ন ধরনের আদিবাসী গান গাইতে থাকে।
তেমনই দু-একটা গানের নমুনা এখানে তুলে দিলাম…

“আইসঅ লো সঙ্গতি সবাই হাত ধইরে নাচি লো-

একমনে জাওয়া দিব, জাওয়া যেমন বাড়হে লো।

কাঁসাই লদির বালি আইনে জাওয়া পাতাব লো-

হামদের জাওয়া উঠে শাল ধুঁধের পারা লো।”

আবার কখনও গাওয়া হয়-

“কাঁসাই লদির বালিয়ে জাওয়া পাতিব লো।

আমদে জাওয়া উপারে রণে তাল গাছের পারা লো।।

সুরজ উঠে খিনি খিনি আমার জাওয়া উঠে না।

জাওয়ার লাগি দিন উপাসগো।।

সাত দিনকার জাওয়ার লাগি দিন পালন করি গো।”

তাও আমরা জাওয়া পাতাব গো।

এভাবেই শুরু হয় ‘জাওয়া পাতা’।

ব্রত পালন

এরপর শুরু হয় এই জাওয়া টুপা গুলোর পরিচর্যা।দিন দুয়েক পরই শস্যবীজগুলির অঙ্কুরোদম হয়।জাওয়া পাতানো কুমারী মেয়েরা জাওয়ার শুদ্ধতা বজায় রাখার সারা সপ্তাহ ধরে পালন করেন কিছু রীতি-নীতি। যেমন- এ কদিন তারা শাক খায় না, খাটিয়ায় ঘুমায় না, মাথায় তেল দেয় না, চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ায় না।এছাড়াও প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় মেয়েরা নিজ নিজ ডালা সহ গ্রামের একজায়গায় জড়ো হয়।জাওয়াকে কেন্দ্র করে সারা সন্ধ্যা চলে করম গান ও নাচ।

সারা সপ্তাহ ধরে এইসব রীতি-নীতি মেনে চলার পর আসে শুক্লা-একাদশী করম পুজোর দিন। এইদিন মেয়েরা সকাল থেকেই উপবাস থেকে একসাথে জঙ্গলে গিয়ে ফুল তোলে, জাওয়া গীত গাইতে গাইতে সারাদিনব্যাপী চলে নাচ-গান।

সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের লায়া (পুরোহিত) একজায়গায় করম ডাল পুঁতে করম ঠাকুরের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে।তৈরি হয় পুজার বেদী। গ্রামের ব্রতকারী কুমারী মেয়েরা ‘করম ডালায়’ পুজোর অর্ঘ্য রূপে ঘি, গুঁড়, আতপচাল, মধু, ধুপ, একগাছি ধান আর কাঁকুড় ইত্যাদি নিয়ে সমবেত হয়ে পুজো করে করম ঠাকুরের। কামনা করে সোহাগী স্বামী পাওয়ার ও সন্তানবতী হওয়ার। এই ‘কাঁকুড়’ কে কুমারী মেয়েরা পুরুষ হিসেবে কল্পনা করে।

পরদিন সকালে মেয়েরা জাওয়া থেকে অঙ্কুরিত বীজগুলিকে উপড়ে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়ে বাড়িতে বিভিন্ন স্থানে সেগুলিকে ছড়িয়ে দেন। এরপর করম ডালটিকে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। পূজার পরে মেয়েরা পরস্পরকে ‘করমডোর’ বা ‘রাখী’পরিয়ে দেয়। পরে পুকুরে বা নদীতে পূজার অর্ঘ্য সহ ‘কাঁকুড়-বিটা’কেও বিসর্জন দেওয়া হয়।

৪.করম গান ও নাচ

এই পরবের মূল সম্পদ হল জাওয়া-গান। এই গানগুলোর কোনো লিখিত রূপ না পাওয়া গেলেও প্রতিটা গ্রামে বংশ পরম্পরায় মুখে মুখে প্রচলিত।এই গানগুলো র মাধ্যমে নারী মনের সূক্ষ্ম অনুভূতির পরিচয় পাওয়া যায়।এই গানের সাথে সাথে চলে করম নাচ।জাওয়াকে কেন্দ্র করে মেয়েরা চক্রাকারে নাচে।এই নাচ গানের মধ্যে দিয়ে প্রতিফলিত হয় তাদের দৈনন্দিন জীবনের হাসি-কান্না,সুখ-দুঃখ।এই গানগুলো বাংলার লোকসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদও বলা যেতে পারে।

করম প্রধানত সৃষ্টির উৎসব,সৃজনের উৎসব।কর্ম থেকে করমের উৎপত্তি।ঝাড়খণ্ডের কিছু জায়গায় এই উৎসব কর্মা নামেও পরিচিত। আরও ভালো করে দেখলে বোঝা যায় এই পরবের মূল আচার যে জাওয়া পাতা তার মধ্যেও লুকিয়ে আছে এই সৃজনশীলতার ইঙ্গিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *