বর্ষীয়ান সাংবাদিক বরুণ দাশগুপ্তর প্রয়াণ, শোক প্রেস ক্লাবের

অশোক সেনগুপ্ত
আমাদের ভারত, ১ ননভেম্বর: রবিবার প্রয়াত হয়েছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক বরুণ দাশগুপ্ত। বয়স হয়েছিল ৮৬। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। নিমতলা মহাশ্মশাণে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।

বর্ণময় জীবন ছিল বরুণদার। অসমে চার দশকের সংগ্রামের একটা অধ্যায়ে যতিচিহ্ণ পড়তে চলেছে। গত শতকের ছয়ের দশকে অসমে বড়োরা স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরির জন্য তাদের বিপ্লব শুরু করেছিলেন। বিভিন্ন সময় দফায় দফায় দীর্ঘ আলোচনার পর তৈরি হল বড়োল্যান্ড। তারিখটা ছিল ২০০৩-এর ৫ ডিসেম্বর। তৎকালীন উপপ্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণী-সহ তিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, অসমের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রমুখছিলেন ওই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে।

সরকারের তরফে বাছাই কিছু সাংবাদিককে কোকরাঝাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল খবর করার জন্য। অনুষ্ঠান শুরুর বেশ কিছুটা আগে সাংবাদিকরা একটি ঘরে গল্প করছেন। হঠাৎ ২-৩টি ছাত্র এল। অসমে বড়ো-আন্দোলনের উদ্ভব ও বিবর্তনের বিশদ জানতে চায় তারা। সাংবাদিকরা চোখ বন্ধ করে পাঠিয়ে দিল অপর একটি নির্দিষ্ট ঘরে, বরুণদা-র নাম করে।

ওই ঘরে আমি একা নানা বিষয় নিয়ে কথা বলছি বরুণদার সঙ্গে। ছাত্ররা এসে নিবেদন করলেন। টানা এক ঘন্টার ওপর কোনও বই না দেখে দিন-সালের উল্লেখ করে বরুণদা ওদের বোঝালেন বড়ো-আন্দোলন সম্পর্কে। প্রথমে আমিও কিছু নোট নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। অচিরেই কলম গুটিয়ে নিলাম। আলোচনা শেষে শুধু বললাম, “বরুণদা যদি আপনার বক্তব্যটা টেপ করে রাখা যেত, একটা দূর্মূল্য দলিল হত।“

একটি নামী দৈনিকের সাংবাদিক হিসাবে প্রায় দেড় বছর গুয়াহাটিতে ছিলাম। বরুণদা একটি সর্বভারতীয় দৈনিকের প্রতিনিধি হিসেবে বেশ ক’বছর ছিলেন গুয়াহাটিতে। তাই নানা সময় প্রমাণ পেয়েছি একটি মানুষের জ্ঞান এবং স্মৃতিশক্তি কতটা প্রখর হতে পারে। ক’বছর আগে ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনিয়ন অফ জার্নালিস্টসের স্মরণিকায় ‘আমার চোখে দুই সেরা সাংবাদিক’ শীর্ষক প্রতিবেদন লিখেছিলাম। দুই সেরা সাংবাদিকের একজন ছিলেন বরুণ দাশগুপ্ত।


ছবি: গান্ধীজীর সঙ্গে ছোট্ট বরুণ দাশগুপ্ত।

মহাত্মা গান্ধীর অনুপ্রেরণায় তাঁর অনুগামী সতীশ চন্দ্র দাশগুপ্ত সোদপুরে একটি আশ্রম তৈরি করেছিলেন। প্রায় সেখানেই ছেলেবেলায় থাকতেন সতীশবাবুর ভাইপো বরুণদা। বাচ্চা বরুণদা-র কাঁধে হাত রেখে হাঁটছেন গান্ধীজী— অনেকে সেই ছবির সঙ্গে পরিচিত। বরুণদার ঘনিষ্ঠ ছিলেন অশীতিপর আর এক প্রবাদপ্রতিম সাংবাদিক হিমাংশু হালদার। এই প্রতিবেদককে জানালেন, “একবার গান্ধীজী সোদপুরে গিয়ে বরুণদার দেখা পেলেন না। গান্ধীজী সোদপুর থেকে ট্রেনে শিয়ালদহে আসবেন বলে রওনা হয়েছেন। সে সময় শুনলেন বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে বরুণদা শয্যাশায়ী। আবার তিনি ফিরে এলেন আশ্রমে। বরুণদার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে ফের রওনা দিলেন।

কোনওদিন স্কুলে পড়েননি। কিন্তু জ্ঞানের ভান্ডার ছিল অফুরন্ত। বাংলা-ইংরেজি-হিন্দি তো বটেই দক্ষ ছিলেন ওড়িয়া-অসমীয়া-উর্দুতেও। পরে জড়িয়ে পড়েন আরসিপিআই-এর সঙ্গে। পান্নালাল দাশগুপ্তর ঘনিষ্ঠ অনুগামী ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে জরুরি অবস্থায় গৌরকিশোর ঘোষ বেশ কিছুকাল জেলে ছিলেন। সাতের দশকের মাঝপর্বে কারামুক্তির পর তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশ হয় ‘আজকাল’। সে সময় কয়েক বছর বরুণদা ওই পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। এর পর সাংবাদিকতা করেছেন একাধিক নামী ইংরেজি দৈনিকে। মননশীল এবং বিশ্লেষণমূলক লেখায় দাগ রেখেছেন পাঠকমহলে।

বরুণদা-র জীবনও ছিল যেন অ্যাডভেঞ্চারের মত। লরিবোঝাই টিনের ক্যানেস্তারার ফাঁকে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে মণিপুরের এক গ্রামে গিয়েছিলেন। নানা অভিজ্ঞতায় পূর্ণ ছিল তাঁর জীবন। কয়েক বছর আগে প্রয়াত হন তাঁর স্ত্রী রুচিরা শ্যাম। এর পর একাকীত্ব অনেকটাই গ্রাস করে তাঁকে। হিমাংশু হালদার জানান, “পান্নালাল দাশগুপ্ত একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। রুচিরা সেই পত্রিকায় কাজ করতেন। সেই সুবাদে ওঁদের পরিচয় হয়। ঘর বাঁধেন।“

শেষ বয়সেও লেখালেখি করতেন সাপ্তাহিক ‘জনস্বার্থ বার্তা’-য়। সাহিত্যিক শেখর বসু জানিয়েছেন, “গত দু-তিন বছর চলাফেরায় আগের মতো স্বচ্ছন্দ ছিলেন না; কিন্তু মস্তিষ্ক ছিল পুরোমাত্রায় সজাগ। পরিচ্ছন্ন সব সংবাদ-নিবন্ধ নিয়মিত লিখতেন যেগুলিতে সুযুক্তি ও বিদ্যাবত্তার ছাপ ধরা পড়ত। মানুষটি ছিলেন স্বশিক্ষিত, স্কুল-কলেজের সার্টিফিকেটের তোয়াক্কা করেননি কোনওদিন।

সর্বভারতীয় নানা পত্রপত্রিকায় কাজ করেছেন, অবসর নেন ‘দি হিন্দু‘ পত্রিকার স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট পদ থেকে। কিন্তু লেখালেখি কখনো থামাননি। লিখতেন ইংরেজি, বাংলা ও অসমিয়া ভাষায়। অত্যন্ত রসিক ও আড্ডাবাজ মানুষ ছিলেন। ওঁর সঙ্গে সময় কাটত তরতর করে। সুলেখিকা, বিদুষী স্ত্রী রুচিরা শ্যাম প্রয়াত হয়েছেন বছর-চারেক আগে। ইদানীং একাই থাকতেন। আমরা একজন আদ্যোপান্ত ভালোমানুষ প্রতিবেশীকে হারালাম।“

শোক প্রকাশ করে প্রেস ক্লাব, কলকাতার পক্ষ থেকে  জানানো হয়েছে, কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে  বরুণ দাশগুপ্ত রবিবার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।মহাত্মা গান্ধীর প্রত্যক্ষ স্নেহে তাঁর বেড়ে ওঠা। ’কম্পাস’  পত্রিকায় তাঁর সাংবাদিকতার সূচনা। পরে  ‘পেট্রিয়ট’  পত্রিকার ঢাকার সংবাদদাতা ছিলেন এবং ইন্ডিয়ান প্রেস এ সোসিয়েশন সংবাদ প্রতিষ্ঠানের গুয়াহাটির সংবাদদাতা 
ছিলেন। ‘আজকাল’ পত্রিকার সূচনালগ্নে  তিনি ঐ  পত্রিকায় যোগ দেন। পরে কিছুদিন তিনি  ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ‘মেনস্ট্রিম’  পত্রিকারও তিনি সংযুক্ত সম্পাদক ছিলেন। ‘দি হিন্দু’  পত্রিকার উত্তর পূর্ব ভারতের প্রধান হিসেবে তিনি কৃতিত্বের  সঙ্গে সাংবাদিকতা করেন। অবসরের পরেও তিনি বিভিন্ন  পত্র পত্রিকায় নিয়মিত নানান বিশ্লেষণ মূলক প্রতিবেদন 
লিখেছে।

রাজনৈতিক জীবনে তিনি আর সি পি আই দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর স্ত্রী ‘আজকাল’ পত্রিকার প্রাক্তন সাংবাদিক  রুচিরা শ্যাম আগেই প্রয়াত হয়েছেন। বর্ষীয়ান সাংবাদিক  বরুণ দাশগুপ্ত-র প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করা হচ্ছে এবং তাঁর অনুগামীদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করা হচ্ছে।“

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *