অচেনা বিধান

ড. রাজলক্ষ্মী বসু
আমাদের ভারত, ১ জুলাই: “এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ/ মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।”
বিধান চন্দ্র রায়ের প্রিয় রোগী ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। চিত্তরঞ্জন দাশের মহাপ্রয়াণের পর, তাঁরই একটা ছবি বিক্রি করে কিছু অর্থ সংগ্রহের পরিকল্পনায় বিধান রায় ছুটে যান রবি ঠাকুরের কাছে। রবি ঠাকুর বলেছিলেন, “ডাক্তার এতো প্রেসক্রিপসান না।” কিন্তু নাছোড় ডাক্তারের জেদের কাছে হার মেনে ওই অমর ছত্র লেখেন রবি ঠাকুর।

বিধান রায় ডাক্তার হবেন এমনটা তো ভাবেনইনি। পাটনার বাঁকিপুর থেকে যখন খালি পায়ে কলকাতা আসেন তখন তাঁর সম্বল ছিল সর্বসাকুল্যে পাঁচ টাকা পঁচিশ পয়সা। মৃত মায়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের সাধ্যহারা আঠারো ভাই বোনের বিধান চন্দ্র রায় সেদিন ঘোড়ার খাওয়ার খেয়ে খিদের জ্বালা মিটিয়েছেন। শিবপুর আর কলকাতা মেডিক্যালে আবেদন করেছিলেন ফর্মের জন্য। ভাগ্যিস ওই মেধাবী যশস্বীর হাতে মেডিক্যালের ফর্মটাই আগে এসেছিল তাই তিনি সেরা পূজিত ডাক্তার। কলেজস্ট্রিটের ওয়াই এম সি এ – তে থাকাকালীন এতোটাই অর্থাভাব তাঁর ছিল যে প্রথমদিকে ধনী রোগীদের বাড়িতে মেল নার্সের কাজও করেছেন। ডিউটিতে বারো ঘন্টার পারিশ্রমিক ছিল আট টাকা। একমাত্র বিধানচন্দ্রই মাত্র ১২০০ টাকা সম্বল করে সাহস নিয়ে বিলেত পারি দিয়েছিলেন, মেডিসিন ও সার্জারির চূড়ান্ত সম্মান এম আর সি পি এবং এফ আর সি এস শেষ করার উদ্দেশ্যে। সেন্ট বারথোলমিউ কলেজে ডাক্তারির ওই দুটি কোর্সের জন্য আবেদন করলে, অধ্যক্ষ সাহেবেরতো চোখ ছানাবড়া। দেশের সাদা চামড়ার মেধাবি ছাত্ররা যে কোর্স একসাথে করতে পারে না তা কিনা করবে এক দরিদ্র ভারতীয়! পত্রপাঠ প্রত্যাখ্যান। কিন্তু বিধান রায়ের দম সাহস নিষ্ঠার কথা সেদিন কেইবা জানত! পরপর তিরিশবার আবেদন করার পর অবশেষে হার মানলেন অধ্যক্ষ সাহেব। দু – বছরেই দু’দুটি কোর্স সসম্মানে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন বিধান রায়।

আমরা কি জানি যে সত্যজিত রায়ের অসমাপ্ত ছবি পথের পাঁচালী তিনি দেখেন এবং তিনিই সব নিয়মের ঊর্দ্ধে গিয়ে ছবিটির সরকারি প্রযোজনার ব্যবস্থা করেন। প্রকৃত প্রজ্ঞাবান জ্ঞানী সর্বদাই অন্য গুণীর সেবা করেন। বিধান রায়ের মুক্ত জীবন দৃষ্টির সাক্ষ্য পাওয়া যায় তাঁর মুখ্যমন্ত্রীত্ব কালে। লালবাজার একসময় পত্রিকা ও বাংলা বইতে আপত্তিকর অংশ নিষিদ্ধ করার চেষ্টা শুরু করেছিল। বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রবোধ কুমার সান্যাল এঁরা তখন পুলিশের বিষ নজরে। তারাশঙ্কর, সজনীকান্ত দাশ সহ লেখকদল কোমড় বেঁধে সোজা পাকড়াও করেন বিধান রায়কে। সত্যিই তো সৃষ্টির সাথে একি অনাসৃষ্টি! তৎকালীন হোম সেক্রেটারি আই সি রুনু গুপ্ত বলেন, এ হল আইনের ধারা। বিধান রায় ওসব তুঘলকি নিয়ম রাজ্য থেকে হটিয়ে সৃষ্টির উল্লাস সম্মানের পথ প্রশস্ত করেন।

মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি বিনামূল্যে নিয়মিত রোগী দেখতেন। রোজ সকাল সাতটায় তিনি বসতেন। ব্যক্তিগত স্টাফের বেতন দিতেন নিজের পকেট থেকে। রাইটার্সে সময়ে হাজিরা তাঁর নির্দেশে শুরু।
সকাল শুরু হতো গীতা ও শাস্ত্রপাঠ করে। ব্রেকফাস্টে থাকত টোস্ট, একটা ডিম, পেঁপে। আর কফি। কফির সমঝদার ছিলেন ডা. বিধান রায়। প্রিয় বন্ধু পেলেই মাঝে আসত কফি। শঙ্করের এক লেখায় জেনেছিলাম, বিধান রায় বুঝি নেহেরুর জন্য উত্তরপাড়ার “তরমুজ রসগোল্লা” পাঠাতেন। কিন্তু ঠিক কোন ময়রা, তার সন্ধান কিন্তু বিধানবাবু তাঁর চিঠিপত্রে উল্লেখ করেননি।

গান্ধীজির সাথে আদরের সম্পর্ক ছিল ডাক্তারবাবুর। গান্ধীজি চেয়েছিলেন তিনি যুক্ত প্রদেশের (এখন উত্তরপ্রদেশ) গভর্নর হোন। তাতে গান্ধীজি ” ইউর এক্সেলেন্সি” বলার সুযোগ পাবেন। বিধান রায় টুকরো রসিকতায় বলেছিলেন, আমার পদবী রয়, তাই আপনি আমাকে রয়্যাল বলতে পারেন। আর যেহেতু আমি লম্বা তাই আপনি আমাকে রয়্যাল হাইনেম বলেন তাই বা মন্দ কি?

স্বাধীনতার পর পিল পিল করে যখন ওপার বাংলা থেকে মানুষ আসছেন, তখন বিধান রায় ভেবেছিলেন এতো মানুষ থাকবেন কোথায়! সেদিন তিনি প্রফুল্ল সেনের সাথে কথা বলেন। প্রফুল্ল সেন বলেছিলেন, পূর্ব কলকাতার প্রায় সব জলা জমিই মন্ত্রী হেমচন্দ্র নস্করের। প্রফুল্ল সেন হেম নস্করকে বারংবার ফোন করে ধরেন, সোজা বাংলায় বগলদাবা করে বিধান রায়ের চেম্বারে নিয়ে আসলে, নস্করবাবু বলেছিলেন — ভেড়ির মাছ চাই? মন্ত্রী কিছু বোঝার আগেই বিধান রায় বলেছিলেন সমাজের স্বার্থে মানুষের প্রয়োজনে অতিরিক্ত জমি সম্পত্তি আর না। এক টাকায় জমি দেওয়া হোক। আজকের সল্টলেকের রূপকার তিনিই। রূপকথার নায়ক তিনি।

তাঁর মূল্যবান কর্মকীর্তির দলিল পাওয়া যায়। বিপন্নতার মাঝেও কেমন করে বাঁচতে আর বাঁচাতে হয় সে বোধ সূক্ষ্মতা কেবল তাঁরই ছিল। ৬৭/১ হ্যারিসন রোড আর তারপর প্যাথলজি ল্যাব খোলার উদ্দেশে ৮৪ হ্যারিসন রোড, কিন্তু তাঁর সম্মান জগতজোড়া খ্যাতি দরদীমন তাঁকে বিশ্বের দরবারে সেরার মুকুট পরিয়েছে। ১৯৪৮ বাংলার ইতিহাসের নিদারুণ সময়ে বিধান রায় যখন চোদ্দটি বছর রাইটার্সের লাল বাড়িতে ছিলেন, তার প্রথম তিন বছর কার্যত ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়েছেন। জমি, শেয়ার, এমনকি শৈলশহর শিলং এর প্রিয় বাড়িটাও বিক্রি করেছিলেন। পঁচিশ পয়সার হিসেব বিধান রায়কে শেষ দিনও দিতে হলো। মাত্র পাঁচ টাকা পঁচিশ পয়সা নিয়ে যিনি কলকাতা এসেছিলেন, তাঁর তিরোধানের পর মুখ্যমন্ত্রী গৃহেও ছিল এগারো টাকা পঁচিশ পয়সা। জীবনের সঞ্চয় ছিল ছ- টাকা।

এঁরা পরোয়া করেন না ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সের। ডাক্তারির প্রথম জীবনে কলকাতার রাস্তায় ট্যাক্সি চালানো ড. বিধান চন্দ্র রায়, যিনি পরিশ্রম নিষ্ঠা একাগ্রতা জেদ আর উচ্চ দৃষ্টিভঙ্গির ভরে বাঙালির প্রাণের সারথী হলেন তাঁর কাছে যশ খ্যাতি আর সম্মানটাই অর্থ। বাকি সব অর্থহীন। মানুষের হৃদয় আর ইতিহাস দখল করেছেন ইনি। ইনিই তো প্রকৃত ক্ষণজন্মা। জন্মলগ্নে ঠাকুমার দেওয়া নাম ভজন, হারিয়ে গেছে। থেকে গেল বিধান চন্দ্র রায়, যে নাম রেখেছিলেন নব জাগরণের পথিকৃত কেশব চন্দ্র সেন। বাংলার মানুষ আজও সেই আশীর্বাদে ধন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *