পারিবারিক ব্যবসা থেকে বঞ্চিত হয়ে আক্রোশে খুন, গড়িয়াহাটে বৃদ্ধা খুনে ধৃত বড় ছেলের স্ত্রী-কন্যা

সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা, ১৩ ডিসেম্বর: গড়িয়াহাটে বৃদ্ধা খুনে ২৪ ঘন্টার মধ্যে কিনারা পুলিশের। গ্রেফতার করা হল বড় ছেলের স্ত্রী ডিম্পল ঝুন্ড এবং তার মেয়ে কণিকা ঝুন্ডকে। জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে কথাবার্তায় অসংলগ্ন আচরণ এবং প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে খুব সহজেই এই নৃশংস খুনের কিনারা করে ফেললেন লালবাজারের গোয়েন্দারা। শুক্রবার বিকেল ৪ টে নাগাদ এদের গ্রেফতার করা হয়েছে।

বৃদ্ধাকে যে প্রবল আক্রোশে খুন করা হয়েছে, তা বৃহস্পতিবারই পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন গোয়েন্দারা। ময়না তদন্তের সময়ে দেখা গিয়েছে, প্রবল আক্রোশে আড়াআড়ি ভাবে তলপেট চিরে দেওয়া হয়েছে। বুকে, পেটে এবং তলপেটে ২০ থেকে ২৫ টি আঘাত পাওয়া গিয়েছে। যেগুলি সমস্তই দু়ই থেকে আড়াই ইঞ্চি গভীর। শুধু তাই নয়, মাথা কেটে শরীর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। খুনের পর ঘটনাস্থলও ধুয়ে দেওয়া হয়েছে। বৃদ্ধাকে রাত সাড়ে ১২ টা থেকে ১ টার মধ্যে খুন করা হয়েছে, কারণ তার পাকস্থলীতে অর্ধপাচ্য খাবার মিলেছে।

রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ খাবার দিতে আসেন বড় মেয়ে কনিকা। এর ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই খুন হয়েছে বলে দাবি গোয়েন্দাদের। পুলিশের অারও দাবি, এই দু’জন আরও একজন পুরুষ এই গোটা ষড়যন্ত্রে জড়িত। তবে তদন্তের স্বার্থে তার নাম এখনই প্রকাশ্যে আনতে চাইছে না পুলিশ।

কিন্তু এই নৃশংস খুনের পিছনে কারণ কি? এদিন লালবাজারে গোয়েন্দাপ্রধান মুরলীধর শর্মা বলেন, এই খুনের পিছনে রয়েছে মূলত আর্থিক কারণ। বৃদ্ধার তিন ছেলে মনদীপ, বলরাজ এবং দীপক। বৃদ্ধার স্বামী মারা গিয়েছেন সাত বছর আগে গড়িয়াহাটে গরচা ফার্স্ট লেনে বহু বছর ধরে তারা ভাড়া বাড়িতে রয়েছেন। মনদীপ ২০১৪ সালে মারা গিয়েছেন। তার স্ত্রী ডিম্পল দুই কিশোরী মেয়েকে নিয়ে থাকেন রিচি রোডের ফ্ল্যাটে। মেজো ছেলে বলরাজ ওরফে রানে কলকাতার অন্য জায়গায় স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে থাকেন। ছোট ছেলে দীপক মায়ের সঙ্গে থাকেন। বহুদিন পাঞ্জাবে কাটানোর পর মাসখানেক আগেই কলকাতায় ফিরে আসেন উর্মিলা দেবী। তারপর থেকে তিনি থাকতেন কখনও গরচা, কখনও রিচি রোডে। ৯ ডিসেম্বর ছোট ছেলে কোচবিহারে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গেলে তারপর থেকে একাই ছিলেন বৃদ্ধা।

এক সময়ে পারিবারিক ব্যবসা দেখাশোনা করতেন মনদীপ এবং বলরাজ। কিন্তু বান্ধিব মারা যাবার পর পারিবারিক ব্যবসা পুরোপুরি বলরাজের হাতে দিয়ে দেন মৃতা উর্মিলা। এই বিষয়টি নিয়ে তখন থেকেই মানসিক টানাপোড়েন ছিল উর্মিলা এবং বড় ছেলের স্ত্রী কন্যাদের মধ্যে।

তবে পারিবারিক ব্যবসা থেকে বঞ্চিত করলেও বড় ছেলের পরিবারকে ভরণপোষণের জন্য মাসিক বেশ কিছু টাকা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন উর্মিলা দেবী । কয়েক বছর আগে সেই টাকা বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু পারিবারিক ব্যবসা থেকে বঞ্চিত হয়ে মাসে মাসে কিছু পরিমাণ টাকা নেওয়া নাপসন্দ ছিল বড় ছেলের স্ত্রী ডিম্পল দেবীর। বিষয়টি নিয়ে প্রাথমিকভাবে আপত্তি জানালেও পরিবারে এই নিয়ে খুব বেশি আপত্তি তোলেননি তিনি। উর্মিলাদেবী ছোট ছেলে দীপকের সঙ্গে থাকলেও তার খাবার আসতো বড় ছেলের স্ত্রী ডিম্পল দেবীর রিচি রোডের ফ্ল্যাট থেকেই। বুধবার রাতেও নাতনি কনিকা রাত সাড়ে দশটার সময় এসে ঠাকুমার খাবার দিয়ে গিয়েছিলেন।

পুলিশের কাছে জেরায় ডিম্পল জানিয়েছেন, মাসোহারা টাকা নিয়ে সমস্যা ছাড়াও তার বসত ফ্ল্যাটেও কিছু আপত্তি ছিল। আরো বেশি পরিমাণ জায়গা চাইছিলেন তিনি। ব্যাঙ্কে উর্মিলা দেবী এবং ডিম্পলের নামে রয়েছে যুগ্ম লকার। কিন্তু সেই লকারও উর্মিলা দেবী নিজেই ব্যবহার করতেন। বড় বৌমার নাম থাকা সত্ত্বেও তাকে ছুঁতে দিতেন না। ফলে নিজের গয়নাও পেতেন না ডিম্পলদেবী। এইসব নিয়েই দিনের পর দিন মানসিক টানাপড়েন চরমে উঠলে খুনের পরিকল্পনা হয়।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পুলিশ জেনেছে, খুনের পর একটি ২০০০ টাকার নোটের বান্ডিল সহ সামান্য কিছু গয়না খোয়া গিয়েছে। বৃদ্ধার বাড়িতে আলমারির লকারের ভেতর আরেকটি লকার ছিল। সেখানে কিছু গয়না বার করে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া আর কি কি খোয়া গিয়েছে, শুক্রবার রাতে ছেলে দীপক শিলিগুড়ি থেকে ফিরলে তা আরও পরিষ্কার হবে তদন্তকারীদের কাছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *