ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
আমাদের ভারত, ৫ এপ্রিল: তুলসীর মতো মূল্যবান ভেষজ খুব কম আছে। তুলসীর মতো পবিত্র গাছও কম। সামনেই বৈশাখমাস। বসুধারা ব্রতে তুলসীর উপরে মঞ্চ করে মাটির ঘট বসিয়ে, ছিদ্রে পলতে জড়িয়ে, নদী-পুকুরের জল ঢেলে বিন্দুপাতি সেচের বন্দোবস্ত করা বাঙালি রমণীর চিরকালের ঐতিহ্য। হরি-মাতোয়ারা-ভক্ত কথা বলার আগেপিছে দশ বার ‘হরিবোল’ বলেন। তা শ্রীহরির অধিষ্ঠান তুলসীমঞ্চেই তো সর্বোত্তম। অথচ হরি মন্দিরে কখনও তুলসীর চারা বিতরণ করতে দেখিনি। আপনি দেখেছেন? পাঁচ-দশ টাকা শুল্ক রেখে গোবরে প্রস্তুত ছোট টবে ব্যাপকভাবে তুলসীর চারা বিপণন করা যায় না?
চারা তৈরি কীভাবে হবে, শেখানো যায়। কিন্তু হাজার বলেও কারো গরজ দেখিনি, না কোনো প্রতিষ্ঠানেরও, না কোনো ব্যক্তির।
ডিসেম্বর মাস এলে তুলসী-পূজন নিয়ে অজস্র পোস্ট দেওয়া শুরু করেন সবাই। গৃহ পরিবেশে তুলসীমঞ্চ স্থাপনের কথা বলেন সবাই। তুলসীর মাহাত্ম্য আলোচনা হয় ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে। করোনা দূর করতেও তো তুলসীর নিয়মিত ব্যবহার দরকার। কিন্তু তুলসী নিয়ে কেউ কিছু বলতে গেলে, মনে রাখতে হবে, তুলসীর চারা কোথায় পাবেন, সেই সহজ সত্যটা বলে দিতে হবে। সাংগঠনিকভাবে তুলসীর হাজার চারা অল্প সময়ের মধ্যে দিতে পারবেন, এমন কোনো সংগঠন আজ পর্যন্ত দেখিনি। নিজের বাড়িতে ইতিউতি হয়ে থাকা দু’ চারটি তুলসীর চারা কেউ হয়তো প্রতিবেশী বা বন্ধুর হাতে তুলে দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি পোস্ট করেন। তা নিমেষে ভাইরাল হয়ে যায়। আদতে অধিকাংশ গৃহেই তুলসী-সংস্কৃতির পাট নেই। উপদেশ আর কর্তব্যের মধ্যে বড়সড় ফারাক থেকেই যায়। চারার দাবী এলে সহজে নার্সারী দেখিয়ে দেন তারা। কিন্তু কয়েকশো তুলসীর চারা তৈরি করতে যেখানে আধ কাঠা জমিও লাগে না, তাহলে চারা তৈরি করেন না কেন? সবাই আমরা জ্ঞান বিতরণ করছি, আসল কাজটা করছি না।
আমরা তুলসী মাহাত্ম্য নিয়ে যদি কিছু কথা বলতে যাই, প্রথম প্রশ্নটি আসবে, আমাকে একটা তুলসীগাছ সংগ্রহ করে দেবেন? চারার জন্য আমি দশ-বিশ টাকা দিতে রাজি আছি। আপনি চারা দিতে পারবেন? পারলে, আমার পরিচিত বন্ধুরাও নেবেন, কথা দিচ্ছি। পঁচিশ-ত্রিশটা গাছ লাগবে আমার। ফিডব্যাক শুনে বক্তা সেই যে ‘ধা’ হয়ে যায়, আর সেখানে আসেন না!
তুলসী ( _Ocimum sactum_ ) লেবিয়েটি পরিবারের বীরুৎ শ্রেণির একটি ভেষজ উদ্ভিদ। বেশ মনোরম, বলিষ্ঠ এই গাছের গন্ধ, গন্ধ এর পাতায়, মঞ্জরীতে। এক বর্ষজীবী বা এক মরশুমি গাছ হলেও তাকে যত্ন করে বহুবর্ষ বাঁচিয়ে রাখা যায়, তখন গাছটি গুল্মের আকার ধারণ করে। সামান্য একটু উর্বরা দোঁয়াশ বা বেলে-দোঁয়াশ মাটি, সঙ্গে নিকাশি বন্দোবস্তের সুবিধা পেলে তুলসীর বাড়বৃদ্ধি চোখে পড়ার মতো হয়। ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় জলবায়ু তুলসী চাষের পক্ষে অনুকূল। তবে তুষার এর ক্ষতি সাধন করে।
তুলসীর চারা তৈরি হয় বীজ থেকে। এক হেক্টরে তুলসীর বাগান করতে মাত্র ১২৫ গ্রাম বীজ দরকার হবে। সরাসরি মাঠেই বীজ বোনা যায়। অথবা নার্সারিতে চারা তৈরি করে নিয়ে মূল জমিতে লাগানো যাবে। কেয়ারিতে বীজ ফেলতে হবে। কেয়ারির মাপ হবে ১x৪ মিটার, অর্থাৎ ৪ মিটার লম্বা এবং ১ মিটার চওড়া এক একটি ফালি। কেয়ারির মাটি একেবারে ঝুরঝুরে করে নিতে হবে, কারণ তুলসীর বীজ অতি ক্ষুদ্র। কেয়ারিতে বীজ ফেলতে হবে এপ্রিল-মে মাস নাগাদ অথবা আগষ্ট-সেপ্টেম্বরে। উত্তর ও পূর্ব ভারতে এই সময়ই বীজ ফেলা হয়। পাহাড়ে বীজ ফেলার আদর্শ সময় হচ্ছে এপ্রিল।
যখন কেয়ারিতে তুলসীর চারাগুলি ৬ থেকে ১০ সেন্টিমিটার পরিমাণ লম্বা হয়, তখন তা তুলে ভালোভাবে বসাতে হবে মূলজমিতে; ৪০x৬০ সেন্টিমিটার দূরত্বে বসাতে হবে চারা। তুলসীর গ্রীষ্মকালীন ফসল নিতে হলে অর্থাৎ চারা মে মাসে বসালে সপ্তাহে একবার অন্তত জমিতে সেচ দিতে হবে। সেপ্টেম্বর মাসে চারা বসালে মাসে দুবার সেচ দরকার হয়।
মূল জমিতে চারা লাগানোর একমাস পর প্রথম বারের জন্য মাটি নিড়িয়ে আগাছা দূর করে দিতে হবে, তাতে গাছ ভালো বাড়বে। তারও চার সপ্তাহ পর দ্বিতীয় নিড়ানি ব্যবহার করে আগাছা সরাতে পারলে, পরে আর তেমন উপদ্রব হয় না।
তুলসীর ক্ষতিকর পোকা বলতে পাতা-মোড়ানো পোকা, এছাড়া কালো জাবপোকা লাগে শীতের মরশুমে বা তার শেষে। অন্য কয়েকটি শোষক পোকার সন্ধানও পাওয়া গেছে। এছাড়া পাতায় মাকড়ের আক্রমণ দেখা যায়। রোগের মধ্যে পাতায় দাগ বা লীফ-স্পট, স্ক্যাব বা দেদো রোগ, ব্লাইট বা ঝলসা রোগ, ঢলে পড়া রোগ বা উইল্ট ডিজিজ উল্লেখযোগ্য।
তুলসীর ফসল তুলে নেওয়া হয় চারা লাগানোর ১০-১২ সপ্তাহের মধ্যে৷ সেই সময় গাছ জুড়ে থাকে তুলসীর মঞ্জরী, তার ফুলগুলি সব ফোটা। এইসময় নীচের বুড়ো পাতাগুলি হলুদ হতে শুরু করে।তখনই তুলসীর ফসল নিতে হবে। নানান ভেষজ ওষুধ, প্রসাধনী সামগ্রী, সুগন্ধি তুলসী থেকে তৈরি হয়। তুলসী চাষ বেশ লাভজনক। তবে আগে থেকে চুক্তি চাষ করা উচিত, যেন আপনার ফসল কিনে নেন ক্রেতা। তুলসীর কাণ্ড থেকে তুলসীর মালা বেচেও অনেকে ভালো আয় করেন। বাজারে তুলসীপাতার দাম যথেষ্ট।