পুজোর গন্ধ নেই পুরুলিয়ার সিংবাজার গ্রামের তাঁতি পাড়ায়

সাথী প্রামানিক, পুরুলিয়া, ২৬ সেপ্টেম্বর: পুজোর গন্ধ নেই পুরুলিয়ার সিংবাজার গ্রামের তাঁতি পাড়ায়। থাকবে কী করে? পুজোর উৎসবে সামিল হতে গেলে উপার্জনের রাস্তা পরিষ্কার এবং আর্থিক স্বচ্ছলতা যে বড় জরুরী। সেটা তসর শিল্পীদের এখন নেই। করোনাকালের কয়েক বছর আগে থেকেই এই করুণ দশা। এই অবস্থাতেও আগমনীর সুর ভেসে আসছে বাতাসে।

মহিলা ক্রেতাদের শাড়ি বা সৌখিন পুরুষদের সার্ট-পাঞ্জাবীর হ্যাণ্ডলুমের কাপড়ের চাহিদা তুঙ্গে থাকলেও শিল্পীদের দারিদ্রতা ক্রমশ গ্রাস করে চলেছে। পুরুলিয়া শহরের উপকণ্ঠে সিংবাজার গ্রামের তাঁতি পাড়ায় বর্তমান অবস্থাটা অনেকটা সেরকমই। ঐতিহ্যবাহী রেশম শিল্প এখানে ধুঁকছে। মহাজন আর বড় ব্যবসায়ীদের যাঁতাকলে পড়ে এই শিল্প এখন বিপণ্যের পথে। হাড় ভাঙা পরিশ্রম করেও শিল্পীরা ন্যায্য পারিশ্রমিক না পাওয়াতেই এমন দশা বলে জানা গেল।

পুরুলিয়া ২ ব্লকের ভাঙ্গড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের সিংবাজার গ্রামে এক সময় তাঁতিদের শাড়ি বা কাপড় বোনার হস্ত চালিত যন্ত্রের শব্দে ঘুম ভাঙ্গতো এলাকাবাসীর। একটা সময় ষাটটিরও বেশি পরিবার এই কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই স্বর্ণ যুগে এই গ্রাম থেকে কাবুল, কন্দাহার সহ পশ্চিমি দুনিয়ার দেশ গুলিতে রপ্তানি হত হ্যান্ডলুমের কাপড়। তখন শিল্পীদের উৎসাহ ও উপার্জনের মাত্রা ছিল সর্বাধিক। অভিমান নিয়েই কথাগুলো বলছিলেন প্রৌঢ় শিল্পী শালিগ্রম মণ্ডল, আশুতোষ মণ্ডল।

স্বর্ণ যুগের সমাপ্তি ঘটলেও যে কয়েকটি হাতে গোনা পরিবার রয়েছে তাঁরা আজও নিপুণভাবে কাপড়ের উপর নক্সা ফুটিয়ে তুলছেন। শিল্পীরা মাকু দিয়ে সুতোর বুননে অসাধারণ শিল্প কলা তুলে ধরছেন কাপড়ের উপর। যখন এখনকার তাঁতিদের ব্যবসা রমরমিয়ে চলত তখন গঠিত হয়েছিল ‘সিংবাজার রেশম শিল্প সমবায় সমিতি’। এখন পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়ায় সেই সমিতি অকেজো হয়ে রুগ্ন হয়ে পড়েছে। মহাজন তাঁদের বাজার দখল নিয়ে কৃত্রিমভাবে শিল্পীদের পথে বসিয়েছে। অভিযোগ খোদ শিল্পীদের।

গ্রামের বাসিন্দা তথা শিল্পী শ্যামসুন্দর মণ্ডল, ধনঞ্জয় দাস বলেন, এখন মহাজন ও বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে রেশম গুটি পায়। সেই গুটি সেদ্ধ করে সুতো তৈরি করেন বাড়ির মেয়েরা। সেই সুতোর মিশেলে কাপড় তৈরি করে মহাজন ও বড় ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিলে সাত থেকে আটশ টাকা হাতে দেন তাঁরা। এই গোটা প্রক্রিয়াটি করতে এক সপ্তাহের উপর লেগে যায়। তাঁরা আক্ষেপের সঙ্গে আরও বলেন, সময় সাপেক্ষে এই কাজের পরিশ্রম করলেও উপযুক্ত অর্থ না পাওয়ায় উত্‍সাহ হারিয়ে ফেলছেন তাঁরা। নবীন প্রজন্ম এই কাজের ভবিষ্যত্‍ দেখতে না পাওয়ায় সরে আসেছেন। প্রবীণ বা প্রৌঢ়রা এক প্রকার বাধ্য হয়েই আজও কাপড় বুনে চলেছেন স্রেফ পরিস্থিতির জন্য।

সিংবাজার গ্রামের শিল্পীদের আশা, সরকারিভাবে তাঁরা একটু সাহায্য পেলে রুগ্ন দশা কাটিয়ে উঠতে পারবেন। কাঁচা মাল কেনার জন্য সরকারি ঋণ আর তৈরি কাপড় বেচার জন্য বাজারে সরাসরি ক্রেতাদের কাছে যাওয়ার ব্যবস্থা থাকলে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পের স্বর্ণ যুগ আবার ফিরে আসবে। সেই প্রত্যাশা নিয়েই হয়তো বাড়ির দরজার উপরে লিখেছেন ‘এসো মা দুর্গা’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *