পরিযায়ীদের ‘সংখ্যা’ বাঙালীর ৪৩ বছরের ব্যর্থতার ইতিহাসকে পরিষ্কার করে দিয়েছে

ডা. সনৎ মণ্ডল
আমাদের ভারত, ১ সেপ্টেম্বর: একটা বড় ঝড়বৃষ্টির পর যেমন সবকিছু পরিষ্কার দেখা যায়, করোনা সমস্যাও তেমনভাবে বাঙালীর গত ৪৩ বছরের ব্যর্থতার ইতিহাসকে পরিষ্কার করে দিয়েছে– পরিযায়ীদের ‘সংখ্যা’ সবার সামনে এনে।

পশ্চিমবঙ্গ সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র ভূখন্ড যেখানে গত ৪ দশক যে ক’জন অর্থমন্ত্রী এসেছেন তারা সবাই বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডিl এছাড়া দু’জন নোবেল লরিয়েট তাঁদের অমূল্য পরামর্শ দিয়ে আসছেনl কিন্তু কার্যক্ষেত্রে যদি বিদ্যা বা জ্ঞানের চেয়ে রাজনৈতিক বিশ্বাস প্রতিষ্ঠাই মূল লক্ষ্য হয়, তবে তা কতটা ক্ষতিকারক হতে পারে, পশ্চিমবঙ্গ সম্ভবত তার একমাত্র উদাহরণ। এঁরা রাজ্যকে তাদের রাজনৈতিক তত্বের গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করে গেছেন ৪৩ বছর ধরে। পুরোটাই ব্যর্থ। এখন নোবেল লরেট সহ সেইসব মহাপুরুষদের টিকিও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না| হয়তো আবার সুযোগের জন্য অপেক্ষা করছেন।

অসীম দাশগুপ্তর স্মৃতি সম্ভবত তিন প্রজন্মের বাঙালী আমৃত্যু ভুলতে পারবে নাl বহু পরিসংখ্যান ও তাত্বিক আলোচনায় তিনি আমাদের বুঝিয়ে গেছেন, “গ্রামোন্নয়নের একমাত্র মডেল লুকিয়ে আছে তাঁর ঘাটতি শুন্য বাজেট অর্থনীতিতেl কংগ্রেস, তৃণমূল বা বিজেপি গ্রামবাংলায় দাঁত ফোটাতে পারতো না, কারণ গ্রাম বাংলা উন্নতির শিখরে ছিল! কলকাতার মানুষ বুর্জোয়াl তাই তারা গ্রামোন্নয়নের প্রতি ঈর্ষায় সিপিএমকে ভোট দিত নাl অসীম দাশগুপ্তর পরিসংখ্যান দেওয়া দেখলে হীরক রাজার যন্তর মন্তরের সেই বিজ্ঞানীর মগজ ধোলাইয়ের কথা মনে পড়েl

৯০ এর দশকে কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হঠাৎই লোডশেডিং কমে যায়। অসীমবাবু বাণী দিলেন, ‘এই রাজ্যে গত বছর লোড শেডিং ৮০% কমে গিয়েছেl কিন্তু তলায় তলায় একের পর এক শিল্প বন্ধ হতে থাকেl গরিব মানুষ সিপিমের অত্যাচারে দিল্লি, মুম্বই গিয়ে রিকশা চালানো, লোকের বাড়ি বাসনমাজা শুরু করে, আর যাদবপুর, শিবপুরের ইঞ্জিনিয়াররা অনেক সাম্যবাদের বিপ্লব করে ব্যাঙ্গালোর বা ক্যালিফোর্নিয়ায়l

কিন্তু ভোটে এর প্রভাব কোনওদিন পড়েনি, কারণ প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস বা তৃণমূল কোনও দিন বেকারত্বকে নির্বাচনের ইস্যু করেননিl তাছাড়া যারা বাইরে চলে যেত, তারা তো আর ভোট দিতে আসতো নাl বাকিটা রিগিংএর ইতিহাসl এইখানে অমর্ত্য সেনের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। উনি সারা পৃথিবীর গরিবদের নিয়ে গবেষণা করলেও, পশ্চিমবঙ্গের এই ভয়ঙ্কর শিল্প, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের ব্যর্থতাকে সুচতুরভাবে এড়িয়ে গেছেনl অভিজিৎ বিনায়ক বন্দোপাধ্যায় আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা নিয়ে বিস্তার কাজ করে তাদের ব্যর্থতা সারা পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছেন, কিন্তু কিভাবে পশ্চিমবঙ্গের জিডিপি দেশের ৪০% থেকে ৩% এ নেমে এলো, তা নিয়ে একদম নীরবl এদের ভয় ছিল, এদের গবেষণা যেন এদের রাজনৈতিক বিশ্বাসকে মানুষের সামনে ব্যর্থ প্রমান না করেl

এরপর অমিত মিত্রl বাকি চার জনের সম্পূর্ণ বিপরীত বিশ্বাসের দক্ষিণ পন্থী মানুষl যিনি এই রাজ্যেকে পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখতেনl বিপ্লবী রাজনৈতিক পরিবারের মেধাবী, স্কলার, বিদেশে পড়িয়েছেন এবং ১৯৯১–তে দেশে ফিরে দেশের বৃহত্তম বণিকসভাকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেনl চার বারের বিজনেস সামিট এর সম্পূর্ণ ব্যর্থতা তাঁর পরীক্ষার ফলl

কিন্তু ৪৩ বছরের ব্যর্থতার সূচক হয়ে গেছে আজকের লক্ষ লক্ষ পরিযায়ীরা–যারা চরম বিপদের দিনে নিজের বাবা, মা, স্ত্রী, সন্তানদের কাছে আসতে চেয়ে বাংলার রাজনীতি ও অর্থব্যবস্থার ব্যর্থতা চোখের সামনে তুলে ধরেছেনl আজ তারা যখন এই বিপদের দিনে “একসঙ্গে” ফিরতে চাইলেন, তাদের ‘সংখ্যা’ এই পাঁচ মহাপন্ডিত মানুষের ও তাদের রাজনীতির ব্যর্থতা তুলে ধরেছেl কিন্তু এতো লোককে পরিযায়ী হতে হল কেন?

ছবি: লেখক ডা. সনৎ মণ্ডল।
এতদিন আঙ্গুলগুলো অন্যের দিকে তাক করা ছিলl প্রথমে ভেবেছিলেন, পরিযায়ী ব্রহ্মাস্ত্র দিয়ে মোদী বধ করবেনl কিন্তু ব্রহ্মাস্ত্র আপনাদের দিকেই ফিরে এসেছে? এবার কিন্তু গরিব, নিপীড়িত গিনিপিগরা আঙ্গুল আপনাদের দেখাবেl সাবধান! (লেখার উদ্দেশ্য সময়োপযোগি। কোনো রাজনৈতিক বিশ্বাসকে আঘাত করার জন্য নয়….)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *