কর্মের নামই বিশ্বকর্মা

ডাঃ রঘুপতি সারেঙ্গী,কোচবিহার, ১৬ সেপ্টেম্বর:
” বিশ্বকর্মা যেথায় মত্ত
কর্মে হাজার করে…..
সেথা যে চারণ চাই।”
আমাদের এই চারণ করার দিনটি–ভাদ্র মাসের সংক্রান্তি। করোনা যতোই থাবা উঁচিয়ে তেড়ে আসুক তবু, আমাদের “বারো মাসে তেরো পার্বন”
বলে কথা!
দেবীও বুঝি কৈলাশে, কাচ্চা-বাচ্চাদের পোশাক ধোয়া-কাচা শুরু করে দিয়ে থাকবেন এতদিনে! কিন্তু রাজনৈতিক হানাহানি, নির্বাচনের হালকা উগ্রগন্ধ আর আর্থিক মন্দার মাঝে খালি হাতে আসাটা ওঁনার জন‍্য নিরাপদ কতোটা? তবে কী শুধু দেবী’র জন‍্য এতোগুলো অস্ত্র বানাতেই বাহাদুর বিশ্বকর্মাকে এতো করে ডাকাডাকি?

আসলে, দধীচি মুনী’র হাড় দিয়ে ইন্দ্রের হাতের বজ্র থেকে শিব বাবাজী’র ত্রিশূল, বিষ্ণু’র সুদর্শন চক্র, এসবই যে তাঁর বাম হাতের খেল!
না, শুধু এটাই নয়…. ।
শোনা যায়, সেই কোন্ সত্যযুগে খোদ স্বর্গের নির্মান, ত্রেতাতে রাবনের স্বর্ণ-লঙ্কা আর দ্বাপর যুগে শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা’র রাজপ্রাসাদ এ সবই নাকি, এঁনারই হাতে তৈরী!
আরও শুনবেন ? দেবরাজ ইন্দ্রের পুরী নির্মাণ করা থেকে সারা নগরীর পরিকল্পনা এঁনারই। শ্রী-ক্ষেত্রে জগন্নাথদেবের যে মন্দির দেখে হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন আপনারা, সেও কিন্তু এঁনারই হাতে গড়া। এই তো সেদিন, চাঁদ সদাগর বেহুলার জন‍্য যে বাসর ঘর বানিয়েছিলেন তার order পেয়েছিলেন কিন্তু সেই বিশ্বের প্রথম নির্মানকারী সংস্থার Owner cum Architect, বিশ্বকর্মা মশাই। এরকম এক গুণীজন না হ’লে কি লোকে বছরে বছরে এঁনাকে বাড়িতে ডাকে!

আরে, বলেন কী মশাই? বলি কী, মানে লিস্ট আরও লম্বা।এই যেমন ধরুন, যুদ্ধের যতো রথ দেখ্ছেন–চার-চাকা থেকে চৌদ্দ-চাকা–এ সবই এঁনার কুটির শিল্প। সূর্যের চারিদিকে জমে থাকা প্রচন্ড গরম ধুলো-কনা কে ঠান্ডা করে, পুষ্পক-রথ বানিয়ে, উনি প্রজাপিতা ব্রহ্মাকে gift করেছিলেন।
ব্রহ্মা থেকে কুবের। কুবের থেকে রাবণ আর অবশেষে, রাবনকে হারিয়ে রাম পেলেন সেটি!
বলেন কী !–জিনিষটা এতদিন টিকে আছে? আরে ভাই, টিকেই শুধু নেই, রীতিমতো মাল টানে, ক্ষেত্রবিশেষে যুদ্ধেও যায়! সেই জিনিস একখান্। আরে মশাই কী বলবেন, রাশিয়া আর আমেরিকা যে মিসাইল দেখিয়ে আমাদের ধমকে-চমকে রাখে, সে তো এরা বিশ্বকর্মার বজ্র-প্রযুক্তিকেই কাজে লাগিয়ে–ব‍্যাটারা স্বীকার করবে না! এই যে Moon mission, Mars mission, Figter-jet–এ সবই যে ড.বিশ্বকর্মা’রই অবদান, জানেন!

ভদ্রলোক ডক্টরেট ছিলেন?
না, মানে…..ঐ….এতো আগের দিনের ব‍্যাপার কী না…..এখন হ’লে পৃথিবীর কতগুলো বিশ্ববিদ‍্যালয় যে ডেকে-ডেকে ওঁনাকে ডি-ফিল আর সাম্মানিক পি-এইচ-ডি দিত কে জানে!

বিশ্বকর্মা’র বেশ পেটাই শরীর। সুগার-প্রেশার এর বালাই নেই কিনা! চার টি হাত। এক হাতে জলের কলস, এক হাতে বই, তৃতীয় হাতে দড়ি আর চতুর্থটিতে তুলাদন্ড ধরা থাকে। ভদ্রলোক পোষা হাতির পিঠেই বেশ চষে বেড়ান চারিদিক।
ওনার Bio-data র বিষয়ে… শিল্পকর্মে সারা জগতে আর জগতের বাইরেও ওঁনার যা নাম-যশ!

কী হবে ওনার চাকুরী বলুন?
না, না…আমি তা বলিনি। আসলে এমন গুণীজনের বংশ পরিচয় পেতে কা’র না ইচ্ছে করে বলুন…এই আর কী!
ও…ইনার জন্ম ১৭ই সেপ্টেম্বরে। এই দিনটিতেই হয়েছিল পৃথিবীতে হল (লাঙল) এর উদ্ভাবন। ওনার মা যোগসিদ্ধা।
বাবা হলেন আমাদের এই অষ্টবসু’র অন‍্যতম, বিভাসবাবু।
ঋগ্বেদের ১০ম মন্ডলের ৮১ এবং ৮২ নং সূক্তে পাঁচ বার এই নাম এর উল্লেখ আছে। বেদজ্ঞরা মনে করেন, বেদোক্ত সবিতা, ত্বষ্টা, ইন্দ্র এবং ব্রহ্মা একই ব‍্যক্তি। মৎস্য-পুরাণ আর বিষ্ণু-পুরাণ দুটোতেই এঁনার নামধাম পাওয়া যায়। রামায়ণের কিষ্কিন্দা কান্ডে এবং সুন্দর কান্ডে এঁনার নাম এর সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে।

মহাভারতে আসুন। পান্ডবদের “মায়াসভা”… সে তো ইনার হাতেই গড়া!
শুক্ল যজুর্বেদের “পঞ্চ-ঋষি” র অন‍্যতম ইনি
(বশিষ্ট, যমদগ্নী, ভরদ্বাজ, বিশ্বামিত্র এবং বিশ্বকর্মা)।
সমস্ত বই- পুস্তকে, খবরের কাগজেই দেখি ইনার নাম।
থাকবেই না, কেন বলুন…..
একজন Versatile genius তো!
চৌষট্টি কলাতেই
পারদর্শী– মাইরি!
বিশ্বকর্মা মহারাজের পুত্র ‘নল’, যিনি সেতুবন্ধনের সময়ে শ্রীরামচন্দ্রজী’কে আপ্রাণ সাহায‍্য করেছিল। কন‍্যারত্নের নাম ছিল ‘সঙ্গা’ যাকে উনি সূর্যদেবের সাথে বিবাহ দেন। সে যাক।

আগামীকাল সারা ভারতবর্ষ, নেপাল আর বাংলাদেশ জুড়ে আনন্দে ইনার Birth-day celebrate করবে সবাই।
দুঃখটা আমার একটু কোথায় জানেন, যে ইংল‍্যান্ডে শিল্প-বিপ্লবটা প্রথমেই ঘটালেন ইনি, আজ তারা এঁকে ভুলে গেছে! মানুষ কত অকৃতজ্ঞ…..তাই না?
যাক আমরা তো মনে রেখেছি! হরিয়ানার রাজধানী-শহর, চণ্ডীগড়ের কাছে লোহগড় এবং অন্ধ্রপ্রদেশের মছলিপত্তনম এ বিশ্বকর্মাজী’র সুন্দর মন্দির আছে।
দেখুন, নির্মান কাজের সাথে বিশ্বকর্মা Engineering Pvt. Ltd পুরো যুক্ত থেকে সারা পৃথিবী জুড়ে শহর-নগর- মন্দির বানালেও ওঁনার জন্মদিন পালনের উদ্দেশ‍্য আমাদের কিন্তু আলাদা।
আমাদের কাছে: কর্মনৈপুন‍্যের মাধ‍্যমে বিমূর্ত সৃজনশীলতার নাম বিশ্বকর্মা। শ্রমকে হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করার পাঠ এখান থেকেই। শিল্পী হোন বা শ্রমিক হোন কাজের নিরিখে এই উভয়ের প্রতি আমরা যেন সম্মান জানাতে শিখি।
সাহেবরা বলেঃ “Work is Worship”.
আজকের দিনে, বিশ্বকর্মা পুজোতে আচার্যের মুখেও এই কথাগুলি শুনে বড্ড ভালো লাগে। তিনি তাঁর উদাত্ত কন্ঠে, স্পষ্ট উচ্চারণে, যখন বলেনঃ
“… দেবশিল্পী মহাভাগঃ
দেবাণাং কার্যসিদ্ধকঃ।
পূজা গৃহাণ বিধিবৎ
কল‍্যাণং কুরুমে সদা।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *