(খড়দার ভূমিপুত্র কৃষিবিজ্ঞানী ড. কল্যাণ চক্রবর্তী খড়দায় একাদিক্রমে ৩৫ বছর অবস্থান করেছেন। তার সঙ্গে খড়দার মানুষের দীর্ঘ সাংস্কৃতিক-সাহিত্যিক-সামাজিক যোগসূত্র আজও বিনষ্ট হয়নি। তিনি আপন-চারণায় সমকালীন সময়ের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন, তার মধ্যে সেই সময়ের স্থানীয় ইতিহাস কিছুটা ফুটে উঠবে এই আশায় তা পরিবেশিত হল। প্রস্তুত প্রতিবেদনটি তার ৮ম পর্ব)
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
আমাদের ভারত, ২৬ ডিসেম্বর: পরিবেশ আর বাস্তুতন্ত্রের দিক থেকে আজকের রহড়া-খড়দার সঙ্গে কয়েক দশক আগের জনপদটির ঠিক তুলনা চলে না। আজ বলবো সেদিনের পাখি-বৈচিত্র্যের কিছু কথা, ‘প্রকৃতির উড়ন্ত দুরন্ত সুন্দর’-এর কথা। তাদের বাহারি বর্ণ বৈচিত্র্য, বিচিত্র সুরের মূর্ছনার আবহ, বাসা বাঁধার অপূর্ব কৌশল, ঝোপঝাড়-জলাজঙ্গল থেকে খাদ্য সংগ্রহের অপরূপ সৌকর্য।
পাখির ডাক আজও আমাকে মুগ্ধ করে। দিনের শেষে বিলকান্দার পথে কান্নার সুরে যখন পানকৌড়িরদল ফিরে আসে নীড়ে, তার ক্রন্দন আমাকেও জারিত করে। আতঙ্কে থাকি — পাখির আবাসস্থল টিকিয়ে রাখতে পারবে তো আজকের প্রজন্ম! আগামীকাল কী অজানা বিপদ তাদের জন্য অপেক্ষা করছে! খড়দহের গোধূলি-যুবক, প্রৌঢ়-প্রবীণ সকলের মধ্যেই আমার মতো বিহঙ্গ-মুগ্ধতা আছে, আমি বিশ্বাস করি।
যখন ছোটো ছিলাম রহড়া-খড়দহের পাড়াগুলিতেই ছিল অনেক পাখির কূলায়। গঙ্গার ঘাটের পাশে, দিঘির ধারে, ধাপার মাঠে, পুবের কৃষিক্ষেত্রে, উদ্যানের চূড়ায় চূড়ায়, মালঞ্চের বিটপ-শাখায় নানান পাখির সমারোহ। এত রকমের পাখি, যে গুনে দেখতাম, পঞ্চাশ ছাড়িয়ে ষাটের কোটায় সাংখ্য মান পৌঁছে যায় অনবধানে। পরিযায়ী পাখি মিলিয়ে সংখ্যাটি সত্তরের কাছাকাছি হবে হয়তো। আমার বাবা অনেক পাখি চিনতেন। তিনিই আমাকে প্রথম দিকে পাখি চেনাতে শুরু করলেন। ঘরে বসেই বলে দিতে পারতাম ঝেচু বা ফিঙে পাখীর ডাক। তিনি বলতেন, ঠিক কী কী বৈশিষ্ট্য লিখে রাখলে, খাতায় কীভাবে স্কেচ এঁকে রাখলে পরে কোনো পক্ষী বিশেষজ্ঞের দ্বারা তা সনাক্তকরণ করা যাবে।
একদিন বাসা-বাড়ির নিমগাছের ডালে এলো একজোড়া হরবোলা পাখি, আর একদিন এলো একঝাঁক ফটিকজল। সাতের দশকের শেষে বন্দীপুর হেল্থ সেন্টারের কাছাকাছি ষষ্ঠীতলায় দেখেছি দুধরাজ পাখির অপরূপ সুন্দর লেজখানি। এই তিনটি পাখি আটের দশকের পর রহড়ায় আর দেখিনি। বহু বছর বাদে রুইয়া, বিলকান্দা, কর্ণমাধবপুরে কিছু বিরল পাখি আবার দেখলাম ২০১০-১১ নাগাদ যখন মুসলিম কবরস্থানগুলিতে উদ্ভিদ-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিষয়ে সমীক্ষা করতে গিয়েছিলাম। দুধরাজ সম্ভবত আর দেখা যাবে না খড়দহের গ্রাম এলাকাতেও। আমার ছোটোবেলায় শ্যামা, চাক দোয়েল, ভীমরাজ, রামগাংরা, সহেলি পাখি দেখা যেতো খড়দহে।
আজ ইচ্ছে করে সাইবোনার গ্রামীণ এলাকায় একবিঘে জমি কিনে একটি পাখি পর্যবেক্ষণের টাওয়ার বসাই আর মালঞ্চ রচনা করি। দেখাই কী অমূল্য সব প্রাকৃতিক সম্পদ এখনও টিকে রয়েছে খড়দায় প্রকৃতি পরিবেশে। কিন্তু জমি কেনা আমার কাছে অসাধ্য কাজ। স্থানীয় পঞ্চায়েত ইচ্ছে করলেই এই উদ্যোগ হাতে নিতে পারে। খড়দার গ্রামীণ এলাকা হয়ে উঠুক স্বাভাবিক পাখিরালয়। রাসায়নিক সার আর কীটনাশকের ব্যবহার থেকে বিরতি পেলেই অনেক কাজ এগিয়ে যাবে। জৈবচাষ করে ফল আর সবজি ফলালে অনেকটা এগিয়ে যেতে পারবো আমরা। প্রকৃতির শকুন্তলা হারিয়ে মনুষ্য-রূপ শকুনের আজ বড্ড দাপট! এ দাপট রুখতে হবে।
বাবাকে অকালে হারিয়ে পাখি চেনায় সহসা বাঁধা এসে পড়ল। তখন রহড়ার ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরি ও বালকাশ্রমের রাজকুমার পাঠাগারে রাখা বইয়ের সহযোগিতা নিলাম। সহায়ক পাখির বই-টই পড়ে, ছবি দেখে নিজে নিজেই পাখি চেনা শুরু হল। আর শিখলাম খড়দহের অনেক প্রবীণ মানুষের কাছ থেকে। জগদানন্দ রায়, অজয় হোমের বাংলার পাখি বিষয়ক গ্রন্থ, বনফুলের ‘ডানা’ উপন্যাস, সেলিম আলির বইয়ের ছবি, ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ পত্রিকার নানান সংখ্যায় পাখির প্রবন্ধ পাঠ করে এক একটি পাখি চিনতে শিখলাম।
ছোটবেলায় ছোটো এঁদো পুকুরের পাড়ে, জিওল গাছের ধারে ডাহুক ডেকে বেরাতো। জলার কানিবক, কয়েক প্রজাতির মাছরাঙা, জলপিপি, পানকৌড়ি, পরিযায়ী হাঁস। নিচু ভেজা জায়গায় শীতের সময় চলে আসতো নানান প্রজাতির খঞ্জন। ধীরে ধীরে পুকুর-জলা বুজিয়ে ঘর-বাড়ি হতে লাগলো চোখের সামনেই। সোনাই নদী চুরি হয়ে গেল। পাখিসব, কলরব হারিয়ে গেল।
মিশন পাড়ায় এখনও মনে পড়ে ঘাট বাঁধানো সানুবাবুর পুকুর; এখন যেখানে পুণ্যানন্দ মুক্তমঞ্চ সেখানে ছিল ‘রাক্ষসী পুকুর’; পাশেই জীবনবাবুর পুকুর; রাইমোহনবাবু ও ভদ্রেশ্বরবাবুর গৃহাভ্যন্তরের ছোট্ট পুকুর; বিশ্বাসদের তালপুকুর; চিত্তবিশ্রামের পুকুর আরও নানান ছোটো-বড় জলার পাশে এক চিলতে নির্জনতা আর দুপুরে-শব্দ আমায় আকৃষ্ট করতো৷ আনমনা মনে কখন যে কুবো ডেকে আনন্দে ভরিয়ে দেবে; কখন যে সদ্যস্নাতা পানকৌড়ি ঘনকৃষ্ণ শরীরটা মেলে দিয়ে বসবে পাশের-বাঁশের খুঁটিটায়; কখন যে মাছের দখল নিয়ে বক-বগুলার শোষানি শোনা যাবে — তার লেখাজোকা নেই! তারপরই অতি ক্ষুদ্র দেহে অতি উচ্চ রবে অনর্গল ডেকে উঠবে টুনটুনি; বড় পাতার আড়ালে সুরেলা গলায় গেয়ে উঠবে ভোরের দোয়েল; অনুচ্চ গুল্মে নেচে উঠবে চাকদোয়েলের পুচ্ছ।
বাড়িতে বাড়িতে আম কাঁঠাল গাছ থাকলেই উড়ে এসে বসতো হলদে দেহের কালো মাথা নিয়ে বাসন্তী বেনেবউ; তার ‘কৃষ্ণ খোকা হোক’ ডাকটি শুনে মনে হত, ওই কোন বোষ্টমী এলেন ভিক্ষে করতে! মাঝে মাঝে মেটালিক সাউন্ড; লেজঝোলা এক হাঁড়িচাচা, এ গাছ থেকে ও গাছে উড়ে চলেছে। নিদাঘ দুপুরে প্রায় হেঁটে হেঁটে এসে পৌঁছাতো চোখ লাল করা বড়সড় কুকো পাখি; একেবারেই নিশ্চুপ ভঙ্গিতে ছোট্ট ছোট্ট উড়ান দিয়ে একমনে পোকামাকড় খুঁজে চলতো। কখনও একঝাঁক বাদামী ছাতারে পাখি সাতভাইয়ের মতোই নিত্যকলহরত। কখনও ভাত-শালিখ, গো-শালিখ, ঝুঁট-শালিখের ঘনঘন আড্ডা আর চেনা-চেঁচামেচি। খড়দায় আরও দু’টি প্রজাতির শালিক তখন দেখা যেত বিস্তর — কাঠ শালিক আর ব্রাহ্মণী শালিক; আজ আর চোখে পড়ে না বিশেষ। তবে বৃক্ষের শাখায় শাখায় বিশেষত বট-অশ্বত্থের ডালে এখনও দুই তিনটি প্রজাতির বসন্তবৌরির দেখা পাই। চড়ুইয়ের সংখ্যা কমেছে — আজ বাড়ির ঘুলঘুলি নেই, বাসা বাঁধার রসদ নেই তাদের, বেঁচে-বর্তে থাকার ন্যূনতম শর্তও অনুপস্থিত। নানান কোম্পানির মোবাইলের বিভিন্ন মাত্রার কম্পন তাদের হারিয়ে দিচ্ছে। তখন বন্দীপুর, বিলকান্দায় নীলকন্ঠ পাখি দেখা যেত। বেশ বড়সড় পাখি, দশমীর দিন এই পাখিকে নিয়ে অনেক গল্প শুনতাম। আজ কখনও সখনও একাকী পাখির একক অনুভূতি দৃশ্যমান হলেও তারা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। কৃষিক্ষত্রের দূষণ এদের হারিয়ে দিয়েছে।
মিশন উচ্চ বিদ্যালয়ের করণিক সুধীর ব্যানার্জির মায়ের কাছে রামায়ণ ও মঙ্গল কাব্যের পাঠ শুনতে যেতাম মাঝে মধ্যে। তাঁর কাছেই ছোটোবেলায় পেলাম পাখি বৈচিত্র্যের তালিকা। শুনে শুনে প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছিল —
“সারস-সারসী ডাকে/কাক কাদাখোঁচা। গৃধিনী কোকিল চিল/আর কালপেঁচা।। সারী-শুক কাকাতুয়া/চড়া মৎস্যরঙ্ক। খঞ্জন-খঞ্জনী ফিঙ্গে/ধকড়িয়া কঙ্ক।। বাউট-পাউট শিখী /পক্ষী হরিতাল। পায়রা প্রবাজ আর/শিকড়া সরাল।। বক-বকী বাদুড়/বাদুড়ী নুরিটিয়া। ঝাঁকে ঝাঁকে চামচিকে/কাঠ-ঠোকরিয়া।”
কাদাখোঁচা পাখি বা স্নাইপ আজকাল খড়দার গ্রামাঞ্চলেও হারিয়ে গেছে। গৃধিনী বা শকুন আটের দশক পর্যন্ত খড়দহের ধাপায় দেখা যেত। চিল এখনও কিছু আছে। কোকিল আছে কাকের সৌজন্যে টিকে। মৎস্যরঙ্ক হল মাছরাঙ্গা। বাউট হল বাবুই, এখন প্রায় নেই, তাল-খেজুরের পাতায় ঝুলে কদাচিৎ বাসা দেখা যাবে গ্রামের দিকে৷ পাউট হল এক রকমের শালিখ। হরিতাল, হরিয়াল বা সবুজ পায়রা একসময় পাওয়া যেত, বহু-শিকার হয়ে শেষ হয়ে গেছে। তবে কখনও এক ঝাঁক এসে বসে কোনো কদমের গাছে, পুরনো সবেদা গাছের মাথায়। রহড়া-খড়দায় যে সমস্ত গাছ লাগানো হয়, তাতে পাখি, কাঠবেড়ালি, হনুমানের খাবার জোটে না। তাই তারাও উপযুক্ত বাসস্থান ও খাবারের অভাবে খড়দহে আসে না। সরাল হচ্ছে Lesser whistling duck, শিকড়া হচ্ছে Accipiter badius. এখানে অবশ্য বাদুড়কে পাখি হিসাবে ধরা হয়েছে, ওরা পাখি নয়, স্তন্যপায়ী প্রাণী।
একদা সারা বাংলায় দৃশ্যমান পাখি খড়দহেও বহাল তবিয়তে ছিল। আমি অনেক পাখি এখানে থেকেই চিনেছি। মাধ্যমিকের পর যখন নতুন সাইকেল চালানো শিখলাম। তারপর চলে যেতাম নন্দদুলালজীর মন্দির চত্বরে। পাশেই খাল হয়ে বইছে নোয়াই নদী। মন্দিরে বহু পুরাতন বৃক্ষ। ঘন্টার পর ঘন্টা ওখানে বসে পক্ষীচর্চা করেছি সবান্ধবে। ফেরার পথে হোগলার বনে নানান মুনিয়ার আকর্ষণ আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখতো। সাইকেল ধরে অদূরেই দেখতাম লাল মুনিয়া, তিলা মুনিয়া, কালোমাথা মুনিয়া। শীত এলেই রুইয়ার স্থানে স্থানে থকথকে কাদাভরা জায়গায় থেমে পড়তাম। হলুদ ছিপছিপে এক পাখি অনর্গল লেজ নাচিয়ে চলেছে। ওরা হলুদ খঞ্জন; থেমে থেমে তার সুরেলা গান, খাবার সংগ্রহের সম্মান-সঙ্গীত। মাটিতে দ্রুত হেঁটে এগিয়ে চলেছে ওরা, আর মোহনীয় ভঙ্গিতে লেজ নাচাচ্ছে। আমি নিস্পন্দ, মোহমুগ্ধ। দেখেছি সাদা খঞ্জন, পাকড়া খঞ্জন। এখনও শীতকাল এলেই খড়দহের গ্রাম এলাকায় ভেজা মাটিতে খঞ্জনের নাচ আর গান শুনতে পাওয়া যায়। করোনা পরিস্থিতিতে রহড়ার শহর এলাকার ছাদে ছাদে ফুলের মৌতাতে এসেছিল অনেক মৌটুসি; পোকার সন্ধানে ঘুরেছিল চেনা টুনটুনি।
খড়দার মানুষ বিশুদ্ধ পরিবেশে পাখির যে রকমারি গান শুনেছিল, তাতে বিহঙ্গের দল বলে গেছে, তোমরা বদলাও, আমাদের আসতে দাও। আমরা রমণ করবো তোমায়। প্রাকৃতিক দূষণ পাখির বৈচিত্র্য হ্রাসের প্রথম ও প্রধান কারণ।