আমাদের ভারত, কলকাতা, ২২ ফেব্রুয়ারি: মনোজ দাশের লেখা “ঘরপোড়া গরু এবং” বইটি গত তিন বছরে প্রায় 17000 কপি বিক্রী হয়েছে। বাঙালির ভবিষ্যৎ নিয়ে স্যাটায়ার ধর্মী লেখাটির অংশবিশেষ দেশে বিদেশে সোশ্যাল মিডিয়াতে খুব চলছে। এখানে লেখাটির সেই অংশটি তুলে দিলাম। আপনাদের জন্য।
“আজ থেকে ৫০/৬০ বছর আগে বাংলায় একটা রাজনৈতিক দল ছিল, নাম ছিল ‘আমরা বাঙালি! রাজনৈতিক দল বটে, তবে যতদূর মনে পড়ছে, নির্বাচনের রাজনীতিতে তেমনভাবে অংশ নিত না। বছরে দু’একবার পদযাত্রা করত কলকাতা থেকে বনগাঁ সীমান্ত পর্যন্ত। অন্য দু-একজায়গাতেও করত। স্লোগান দিত সীমান্তের বেড়া ভেঙ্গে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কিছুটা অংশ দখল করার। দখল যে করতে পারেনি, সেটা বলাই বাহুল্য। তবু লোকজন জুটিয়ে মিছিলগুলো মন্দ করত না।
মিছিল করা ছাড়া আর একটা কাজ তারা খুব করত। রেলস্টেশনের প্লাটফর্মের গায়ে, সরকারি অফিসের ফাঁকা দেয়ালে যেখানে জায়গা পেত, খুব শ্লোগান লিখত। একটা স্লোগানের কথা মনে পড়ছে- ‘বাঙালি জাগো’। রসিক কোনও বঙ্গসন্তান তার নীচে লিখে দিয়েছিল- ‘কাঁচা ঘুম ভাঙিও না’।’
প্রথম যেদিন পড়েছিলাম এই মন্তব্যটি, খুব হেসেছিলাম। পরে দেখলাম, মন্তব্যটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। যেখানে বাঙালি জাগো- সেখানেই কাঁচা ঘুম ভাঙিও না! এখন বুঝতে পারছি, হালকা চালে কী নিদারুণ সত্যি কথাটি লিখেছিলেন অজ্ঞাত মন্তব্যকারী!
বাঙালির ঘুম সেদিন ভাঙেনি, আজও ভাঙেনি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই জাতটা চারপাইয়ে উঠে রজনীগন্ধার মালা গলায় জড়িয়ে যাবে শ্মশান যাত্রায়।
বল হরি, হরিবোল।
—কে মরল?
— বাঙালী।
— কি হয়েছিল?
— সেকুলার রোগ।
— সেটা আবার কী রোগ ?
— এই রোগে রোগী নিজেই নিজের মাথা হাঁড়িকাঠে তুলে দেয়। মাথা চলে গেলে জীবনটাই যে চলে যাবে, এই রোগ হলে সেই ভয়টা থাকে না।
— সাংঘাতিক রোগ দেখছি। তা এ রোগের লক্ষণ কী, ভাই ?
–এই রোগের প্রাথমিক লক্ষণ– ভুলে- যাওয়া।
কালকেই ঘরে আগুন লেগেছে, আজ কিস্যু মনে নেই। বউকে–বোনকে টেনে নিয়ে গিয়ে কাল যে লোকটা রেপ করেছে, আজ তাকেই ভাই বলে বুকে টেনে নিচ্ছে।
— বলছেন কী ?
— আজ্ঞে হ্যাঁ। ডাক্তারি শাস্ত্রে এই রোগের নাম হয়েছে বাঙালি রোগ। ভালোই হল। পৃথিবী থেকে চলে গেল জাতটা, কিন্তু চিকিৎসা জগতে অন্তত নামটা রেখে গেল। এটাও বোধ হয় কম কথা নয়। রোগের বিবরণ পড়ার সময় আগামী প্রজন্মের মানুষ জানতে পারবে যে, একদা বাঙালি নামে একটা জাত ছিল। তারা খুব ভালো কবিতা লিখত, গল্প- উপন্যাস লিখত, গান গাইত, ভাষণ মারত। গাদা গাদা মহাপুরুষ জন্ম নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে। সারা ভারতে বড় নাম ছিল তাদের। বলা হত, বাঙালি আজ যা ভাবে, বাকী ভারত সেকথা ভাবে আগামীকাল।
— খুব জ্ঞানী ছিল তাহলে?
— শুধুমুধু জ্ঞানী নয়, এক্কেরে মহাজ্ঞানী। তবে কান্ডজ্ঞান ছিল না। নিজের ভালো বুঝতো না। আর মরলও তার জন্যে।
কান্ডজ্ঞান থাকলে ‘আমাদের এই ছিল, আমাদের সেই ছিল’ বলে স্রেফ ঢেঁকুর তুলে দিন কাটাতো না। বদহজমের রুগি হয়ে শুয়ে শুয়ে চিমসে মেরে যেত না। নজর ঘুরিয়ে দেখত, কোন পথে সে চলেছে। কোন রোগে তাকে ধরেছে। সেই অনুযায়ী ওষুধের ব্যবস্থাটা অন্তত করতে পারত। বাঁচুক না বাঁচুক চেষ্টাটা করতে পারত।
— বড় দুঃখের কথা। দুনিয়া এমন এক মহাজ্ঞানী জাতকে হারাল! আহারে!
— মহাজ্ঞানী এবং মহামূর্খ। টু ইন ওয়ান। ঘরপোড়া পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখে সাবধানী হয়ে বাঁচল, আর ঘরপোড়া বাঙালি, আগুন আবার ধেয়ে আসছে দেখেও বাঁচার ব্যবস্থা না করে গান গাইতে বসল ”মোরা একই বৃন্তে দুইটি কুসুম!” মরণ ছাড়া অন্য গতি হয় কখনো? এরা গরুর চেয়ে বোকা; গোরুরও অধম।
— বড় দুঃখ হল। এমন একটা জাত —- হা হা হা রে
— — হরপ্পা- মহেঞ্জোদারো সভ্যতার মতো যে জাত মিউজিয়ামে চলে যাচ্ছে
— তার জন্য হা-হুতাশ করে কী হবে? সে তো ফিরবে না আর। তার চেয়ে একবার প্রার্থনা করুন– যাতে হতভাগার আত্মার সদ্গতি হয়।
— তাই করি তাহলে। বড় কষ্ট পেয়েছে বেচারা।
বল হরি, হরিবোল।
ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ।