সাথী দাস, পুরুলিয়া, ৬ ফেব্রুয়ারি: আবাসিক স্কুলের শিশুকে মাথা থেঁতলে খুনের ঘটনায় গ্রেফতার অষ্টম শ্রেণির কিশোর। ছাত্র মৃত্যুর ঘটনাটি ঘটে ৩০ জানুয়ারি পুরুলিয়ার মানবাজার থানার জবলা এলাকার ঘাসতোড়িয়া সারদা শিশু মন্দির আবাসিক স্কুলের কাছে। মৃত শিশুর নাম সুদীপ মাহাত (৬)। প্রথম শ্রেণির ছাত্র ছিল সে। ঘটনায় গতকাল ৫ ফেব্রুয়ারি সোমবার মানবাজার থানার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় অভিযুক্ত ছাত্র। সে ওই বিদ্যালয়েরই অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। প্রথমে তাকে পুরুলিয়ার শিমুলিয়া আনন্দমঠ জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডের কাছে পেশ করা হয়। পরে সেখান থেকে হুগলির কল্যাণ ভারতী হোম পাঠানো হয়। হোস্টেলের বন্দি দশা থেকে মুক্তি পেতে এই খুনের ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে ওই কিশোর, এমনই তথ্য প্রাথমিক তদন্তে উঠেছে এসেছে পুলিশের কাছে।
জেলা পুলিশ সুপার অভিজিৎ ব্যানার্জি বলেন, “এই ঘটনায় আমরা ওই স্কুলের আবাসিক অষ্টম শ্রেণির ছাত্রকে গ্রেফতার করেছি। সে স্বীকারও করেছে। আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।”
খুনের কারণ হিসেবে পুলিশ সুপার বলেন, “ওই শিশু ছাত্রকে খুন করলে সে স্কুল থেকে ছাড়া পাবে এরকমই বিশ্বাস ছিল তার। তার এই বক্তব্য আমরা যাচাই করছি।” এই ঘটনার দু’ তিন দিন আগে স্কুলের পেছনে থাকা পুকুরে আরেকটি আবাসিক পড়ুয়াকেও ওই ছাত্র ধাক্কা মেরে জলে ফেলে দিয়েছিল বলে পুলিশি তদন্তে উঠে আসে। স্কুল কর্তৃপক্ষ জানতে পেরে ছাত্রটিকে উদ্ধার করে। তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, ঘটনার দিন গত মঙ্গলবার চতুর্থ পিরিয়ডের পর মৃত সুদীপ মাহাতোকে আর দেখা যায়নি। সেই সঙ্গে অভিযুক্ত ছেলেটিকেও সেদিন ওই সময়ের পরে আর দেখা যায়নি। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবে ক্লাস রুমেও তাকে দেখা যায়নি। আর এখান থেকে সন্দেহ হয় পুলিশের।
ঘটনার দিন অভিযুক্ত পড়ুয়াকে যে দিকে স্কুলের পুকুর সেদিক থেকেই আসতে দেখা গিয়েছিল। কিন্তু পুলিশ হতবাক যে পঞ্চম ও ষষ্ঠ পিরিয়ডের পরে সপ্তম পিরিয়ডে অভিযুক্ত আবার ক্লাস করেছে। আবাসিক স্কুলে ভর্তির পর থেকেই ওই পড়ুয়ার মন বসছিল না বলে পুলিশের কাছে জানায় সে। পুলিশ ওই অভিযুক্ত কিশোরকে আটক করার পরেই তার বাবাকে ডাকে। তাদের বাড়ি বান্দোয়ান থানা এলাকায়। অতীতে ওই আটক ছাত্র বান্দোয়ানের একটি আবাসিক স্কুলে পড়ত। তখনও সে বাড়িতে চলে যাওয়ার জন্য জেদ করত। পরিবারের সদস্যদের ঘনঘন ফোন করত বলে পুলিশি তদন্তে উঠে এসেছে।
এদিকে পুলিশের হাতে উঠে আসা তথ্যগুলি তার বাবাকে বললে তা বিশ্বাস করতে চান না তিনি ও তার পরিবার। স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, গত মঙ্গলবার বিকেলে ঘাসতোড়িয়া সারদা শিশু মন্দির শান্তিবনের আবাসিক প্রথম শ্রেণির সুদীপ মাহাতোকে (৬) স্কুলের অদূরে একটি পুকুরে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে স্কুলের অন্যান্য পড়ুয়ারা। পরে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে উদ্ধার করে প্রথমে মানবাজার ও পরে পুরুলিয়া দেবেন মাহাতো গভর্নমেন্ট মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক ওই শিশুকে মৃত ঘোষণা করেন। এই ঘটনায় মঙ্গলবার পুরুলিয়া সদর থানার পুলিশ একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা করে। বৃহস্পতিবার ছেলের মৃত্যুতে স্কুল কর্তৃপক্ষের গাফিলতির অভিযোগ তুলে মানবাজার থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন কেন্দা থানার কেশ্যা গ্রামের বাসিন্দা মহানন্দ মাহাতো। এরপরেই এদিন ওই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির আবাসিক ওই পড়ুয়াকে আটক করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ জানতে পেরেছে, ঘটনার দিন দুপুরে টিফিনের ছুটিতে চকোলেট দেওয়ার নাম করে ওই পড়ুয়াকে পুকুর পাড়ে নিয়ে গিয়ে পাথর দিয়ে ওই বালকের মাথায় বার বার আঘাত করা হয়। সেখানেই রক্তাক্ত অবস্থায় লুটিয়ে পড়ে বালক। মৃত শিশুর দাদু উত্তম মাহাতো বলেন, “নির্মম ভাবে হত্যা করেছে ওই ছেলেটি। ওর যেন কঠোর শাস্তি হয়। সমাজে ওই ছেলে থাকলে হত্যালীলা চালাবে। এছাড়া স্কুলের ভরসায় নাতিকে পড়াশোনার জন্য রাখলাম। আর সব শেষ হয়ে গেল। স্কুলের গাফিলতি না থাকলে কী করে বাইরে বেরলো ছাত্ররা।” আজ স্কুলের মধ্যে দেখা গিয়েছে থমথমে পরিবেশ। হোস্টেল কর্মীদের চোখে মুখে ছাপ পড়েছে।
প্রধান শিক্ষক যুধিষ্ঠির মাহাতো বলেন, “ঘটনার সময় আমি স্কুলে ছিলাম না। তা ছাড়া অষ্টম শ্রেণির ওই ছাত্রটি সবে ভর্তি হয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে ওর আচরণ বোঝা সম্ভব হয়নি।”
হোস্টেল কর্মী রজনীকান্ত সিং সর্দার বলেন, “আমি কিছু জানি না।” এই ঘটনা মনোবিদদেরও ভাবাচ্ছে। একই সঙ্গে ওই বেসরকারি স্কুল কর্তৃপক্ষের ভূমিকা ও দায়িত্বশীলতা নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।