অলিন্দ যুদ্ধে বাঙালির সংজ্ঞা গিয়েছিল বদলে

মিলন খামারিয়া এবং কল্যাণ চক্রবর্তী
আমাদের ভারত, ৮ ডিসেম্বর: তাঁরা ‘পোষ-মানা’ বাঙালি ছিলেন না। ‘সুপ্ত হয়ে লুপ্ত হয়ে’ গুপ্তবাসের গৃহী-বাঙালি ছিলেন না। “বোতাম-আঁটা জামার নীচে শান্তিতে শয়ান” ছিল না তাদের। “তৈল-ঢালা স্নিগ্ধ তনু/নিদ্রারসে ভরা” দেহও তাদের নয়। তাঁরা নিমেষে বিকট উল্লাসে সব কিছু ছিঁড়ে ছুটে যাবার বাঙালি; রুদ্ধ-প্রাণ মুক্ত করার বাঙালি। তাঁরা মদ্যসম পান করতে চেয়েছেন মুক্ত ভারতবর্ষের সুধা, শূন্য-ব্যোম অপরিমাণ দেশমাতৃকা চেয়েছেন।

৮ ই ডিসেম্বর, ১৯৩০; রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান করলেন এমন তিন অসীমসাহসী বাঙালি। ‘অলিন্দ যুদ্ধ’-এর তিন মহানায়ক সেদিন বাঙালির সংজ্ঞা-স্বরূপ-বৈশিষ্ট্য দিয়েছিলেন বদলে। বিনয় বসু, যাঁর জন্ম ১৯০৮ সালের ১১ ই সেপ্টেম্বর, অভিযানকালে বয়স মাত্র ২২। বাদল গুপ্ত, জন্ম ১৯১২ সালে, বয়স হয়েছিল ১৮। দীনেশচন্দ্র গুপ্ত, জন্ম ১৯১১ সালের ৬ ই ডিসেম্বর, বয়স তখন মাত্র ১৯ বছর।

এদের তিন জনের হাতেই পিস্তল। অত্যাচারী পুলিশ অফিসারদের সাজা দেবেন, এই প্রতিজ্ঞা করলেন। ব্রিটিশ পুলিশে ত্রাস জাগাতে তাঁরা মরিয়া হয়ে উঠলেন, যাতে দেশের মানুষকে অত্যাচার করার সাহস কোনোদিন না পায়। গোপনে গড়ে তুললেন তাজা বিপ্লবের শাখা। আগ্নেয়াস্ত্র চালনা শিখে প্রস্তুত হয়েই এলেন সাহেবী পোষাকের ছদ্মবেশে তিন দেশপ্রেমী। কুখ্যাত ইন্সপেক্টর জেনারেল সিম্পন সাহেবকে দুর্ভেদ্য রাইটার্স ভবনের মধ্যেই খতম করবেন, এই দৃঢ়তা ছিল। সুসম্পন্ন হল সেই কাজ। তারপর পুলিশের সঙ্গে চললো এক অসমসাহসী, ঐতিহাসিক অলিন্দ-যুদ্ধ। রাইটার্স বিল্ডিংয়ে এখনও তার অমোচ্য ইতিহাস স্মৃতি হয়ে আছে। আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি ফুরোলো; কিন্তু তাঁরা পুলিশের হাতে ধরা দিতে চান না। বাদল গুপ্ত পটাশিয়াম সায়ানাইড খেলেন এবং অচিরেই মৃত্যু মুখে ঢলে পড়লেন। বিনয় বসু নিজেকে গুলিবিদ্ধ করলেন। দীনেশও তাই করলেন। বিনয় ব্রিটিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেলেন। দীনেশকে বাঁচিয়ে তুলে ব্রিটিশ-বিচারে ফাঁসিকাঠে ঝোলালো আদালত। তাঁরা কিন্তু আজও মরেন নি, দেশের মুক্তির ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন। রাইটার্স বিল্ডিং মানে ইংরেজ প্রশাসকের কলম-কালি পেশার দম্ভের অট্টালিকা নয়; রাইটার্স বিল্ডিং মানে কয়েক দশকের লালফিতে-সুলভ লালবাড়ির অধ্যাদেশ নয়। রাইটার্স বিল্ডিং মানেই বিনয়-বাদল-দীনেশের রক্তলেখা এক হারিয়ে যাওয়া বাঙালির বীরত্বের অমর ইতিহাস।

পূর্ববঙ্গ, পূর্ব পাকিস্তান হয়ে বর্তমান বাংলাদেশের বিক্রমপুরের ভূমিপুত্র ছিলেন এই তিন বাঙালি। *কিন্তু বিক্রমপুর কি তাঁদের মনে রেখেছেন?* কেমন আছেন সেখানকার বর্তমান বাঙালি? অত্যাচার কি বন্ধ হয়েছে? “অন্নপায়ী বঙ্গবাসী/স্তন্যপায়ী জীব” তক্তাপোষে জটলা করে একবারও কি সেই আলোচনা করবেন না?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *