ছবি: ওপরে, শচীন দেব বর্মনের বাড়ির বর্তমান অবস্থা।
ডঃ অচিন্ত্য বিশ্বাস ★ অশোক সেনগুপ্ত
আমাদের ভারত, ৩ অক্টোবর: শচীন দেব বর্মনের পৈত্রিক বাড়িটিতে এখন মুরগির খামার হয়েছে! জীবনানন্দ দাশের বরিশালের আবাস হয়েছে সরকারের ‘কমিউনিটি হল’! এই মন্তব্য করে ফেসবুকে প্রাক্তন উপাচার্য অচিন্ত্য বিশ্বাস লিখেছেন, “সাধারণত কেউ ট্যাগ করলে পড়ি না। আজ এক বন্ধু ট্যাগ করলেন। পড়লাম।
¤ ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি তরুণ, ক্লাস ইলেভেন। মনে আছে ‘বিশ্ব কবির সোনার বাংলা নজরুলের বাংলাদেশ/ জীবনানন্দের রূপসী বাংলা রূপের যে তার নেইকো শেষ।’ অংশুমান রায়ের গান। আর শচীন কর্তার কালজয়ী গান ‘টাকডুম টাকডুম বাজে বাংলাদেশের ঢোল/ সব ভুলে যাই তাও ভুলি না বাংলা মায়ের কোল।’ মনে হত এই দুটি গানই রমনার বিধ্বস্ত কালীমন্দিরের সামনে পাক বাহিনীর ৯৩০০০ সৈনিকদের অস্ত্র সংবরণের বাধ্যতার আসল শক্তি ছিল। এখন সেখানে ‘তিন নেতার মাজার’!
যে লেখক এই পোস্ট করেছেন, আর যিনি প্রসার করেছেন — দুজনকেই ধন্যবাদ। সুষুপ্ত পাঠক আর আসাদ নুর — তাদের কৃতজ্ঞতা জানাই। লেখাটিতে কিছু বানান আর তথ্যের ভুল আছে। নজরুলের বাড়ি চুরুলিয়া, পশ্চিম বর্ধমান। ওই পোস্টে পুরুলিয়া হয়েছে! তাই নিজেই লিখলাম।
¤ যেসব আশ্চর্য জীব আজ বঙ্গ বন্ধুর ডাককে পশ্চিমবঙ্গের রণহুঙ্কার বানাতে উদ্যত তাদের স্বপ্নের দেশ কেমন হতে পারে তার প্রমাণ এই সংবাদ।
¤ ঋত্বিক ঘটকের আবাস এখন রিকশা সারানোর ছাউনি! সেই ঋত্বিক, যিনি বঙ্গ জননীর রূপ কল্পের দিকে চেয়ে শুনিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের গান: ‘কেন চেয়ে আছো গো মা ….’! আর সেই জননীর রূপ ধ্বংসের এই ষড়যন্ত্র দেখে ভিতর থেকে গুমরে ওঠে ধিক্কার। এই জন্যই আমাদের তরুণ সময়ের উদ্দীপনা ছিল সেদিন?
¤ বাংলাদেশের ভাষা সংস্কৃতি ইতিহাসবোধ সম্পূর্ণ কিম্ভূতকিমাকার এক ভুল গৌরব সন্ধান করছে বহুদিন। আল মাহমুদ যখন লেখেন ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ — তখনই তাঁর ইতিহাস সূচনার যুক্তিযুক্ত ভিত্তিটি দুলে ওঠে। অর্থাৎ তার আগেকার ইতিহাস বাঙ্গালীর হতেই পারে কিন্তু তার সঙ্গে বাংলাদেশী ইতিহাসের যোগ নেই।
এই বিকৃত মনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে বই বিক্রি হয়? দাওয়াত পাওয়া যায়? বাংলাদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর হওয়ার সুযোগ আসে? মাইজভান্ডারি হুজুরের কৃপা লাভ ঘটে?
¤ জানি না। শুধু জানি, এই মরু দস্যুদের উট আমার ঐতিহ্য নয় — আমাদেরও হতে পারে না। আমরা বঙ্গ জননীর সন্তান।
অশোক সেনগুপ্ত জানিয়েছেন, “স্মৃতি-স্থাপনা সংরক্ষণের অবশ্যই যুক্তি আছে। কিন্তু আনন্দবাজার পত্রিকায় সাংবাদিকতার সুবাদে বিষয়টির গভীরে ঢোকার অবকাশ হয়েছিল। আমরা দাবি তুলে দায় সাড়ি। এই বাংলায় কোথাও আইনি সমস্যা, কোথাও প্রকৃত সদিচ্ছার অভাব, কোথাও সংরক্ষণের পর সেটির উপযুক্ত ব্যবহার প্রভৃতি থেকে গিয়েছে। পূর্ববঙ্গের ঐতিহ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও যে এই সব বাধা থাকবে, বলাই বাহুল্য। ইউরোপে প্রবাসজীবনে বিভিন্ন শহরে নিজে গিয়ে দেখেছি কীভাবে নামী ব্যক্তিত্বদের ঘরবাড়ি মমত্ব দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে। অর্থের সঙ্কুলানের জন্য প্রচারপত্রের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে আবেদন করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে এ ব্যাপারে একটা সার্বিক সচেতনতা দরকার।
কুমিল্লা শহরের চর্থা এলাকায় শচীন দেববর্ণের যে বাড়িটার ছবি দিয়ে অচিন্ত্যবাবুর লেখায় বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, অন্য একটি লেখায় জানলাম এটি ২০১৫-র দৃশ্য। বিষয়টা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছিল। ২০১২-র ১৫ জানুয়ারি শেখ হাসিনা ত্রিপুরা সফরে এসে আশ্বাস দিয়েছিলেন বাড়িটি সংরক্ষণের। ২০১৭-তে সেটি কার্যকরী হয়। তার ছবিও পেলাম। তবে ফেসবুকে পরস্পরবিরোধী মন্তব্যে সংলগ্ন ৬০ একর জমির বাকিটা কী অবস্থায় আছে, সেটা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারলাম না। ঢাকার বিচারপতি রায়বাহাদুর কমলনাথ দাশগুপ্তের নাতি মীরা দাশগুপ্ত ছিলেন শচীনের সহধর্মিনী।
পূর্ববঙ্গে হিন্দু ঐতিহ্য নিয়ে নানা সময় লিখেছি। ওই বঙ্গের স্মরণীয় ও প্রতিষ্ঠিতদের বেশির ভাগ বাড়িরই বেহাল অবস্থা। ভাওয়াল রাজার বিশাল ভবন ও জমির অনেকটা অংশে সরকারি অফিস। অনেকাংশে দখল। নিজে খুব বিশদে দেখেছি।
ছবি: ভাওয়াল রাজবাড়ি— অশোক সেনগুপ্ত।
ঢাকার অদূরে বারদিতে নিশিকান্ত বসুর জমিতে তৈরি বাড়ির একাংশ তাঁর এককালের পরিচারকের দখলে। শুনেছি পরিচারকের পরিবারের তরফে সেখানে থাকতে জ্যোতিবাবুকে সানুনয় অনুরোধ করায় জ্যোতিবাবু তা মঞ্জুর করেছিলেন। জ্যোতি বসুকে শেখ হাসিনা শ্রদ্ধা করতেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিজে উদ্যোগী হয়ে বেশ কিছুকাল আগে ওই জমিতে জ্যোতি বসুর নামে সংগ্রহশালা তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। সেখানে একটি দ্বিতল বাড়িতে জ্যোতি বসুর স্মরণে গ্রন্থাগার হলেও সংগ্রহশালা হয়নি। গ্রন্থাগারটিতেও যতদূর জানি পাঠক খুব সামান্যই আসেন। আমি দেখে এসেছি।
বড় ব্যতিক্রম বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি। শিলাইদহ কুঠিবাড়িটি সরকারি ব্যবস্থাপনায় জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়েছে। কুষ্ঠিয়ার শিলাইদহ ছাড়া শাহজাদপুর কাচারিবাড়ি, পতিসর কুঠিবাড়ি, দক্ষিণডিহি শ্বশুরবাড়ি— এগুলো ইতিহাসের সাক্ষী। এগুলো টিকিট কেটে দেখার অবকাশ আছে। নাম হয়েছে মধুপল্লী। আর দু’বছর বাদে ২০০ বছর হবে মাইকেল মধুসূদন দত্তর। ১৯৬৫ সালের ২৬ অক্টোবর সরকার কপোতাক্ষ নদীর ধারে তাঁর জন্মস্থানটিকে পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে। এটিও এপার বাংলার অনেকে দেখতে যান।
আর একটি সুন্দর এবং এককালের গুরুত্বপূর্ণ ভবন নাটোরের রাজবাড়ি। বিশাল এলাকা নিয়ে নয়নাভিরাম ভবনটির নাম উত্তরা। ওখানে প্রধানমন্ত্রী না থাকলেও ওটি তাঁর বাসভবন হিসাবে স্বীকৃত। তাই সাধারণের প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আমার বন্ধু প্রদীপ মল্লিক বিশেষ অনুমতি নিয়ে বিশদ দেখানোর ব্যবস্থা করেছিলেন।
পাবনায় গোপালপুর মহল্লার হেমসাগর লেনে রয়েছে ‘কিংবদন্তী মহানায়িকা সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংগ্রহশালা’। তাঁর স্মৃতিকে সম্মান জানিয়ে কয়েক বছর আগে ওই বাড়িতে সেটি গড়ে তোলা হয়েছে।
সাবেক পূর্ববঙ্গের প্রতিষ্ঠিত স্মরণীয় হিন্দুর সংখ্যা অগণিত। এরকম ব্যতিক্রমী কিছু ভবন ছাড়া জানি না আর ক‘টি ভবন সংরক্ষিত করা গিয়েছে। সেকালের নয়নাভিরাম স্থাপত্যগুলো ফেসবুকে নিয়মিত দেখার সুযোগ হয়। কালের করাল ছোবলে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে সেগুলোর শেষের সেদিন।
ছবি: নাটোরের রাজবাড়ি – অশোক সেনগুপ্ত।
ঢাকা থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলায় স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর বাড়ি। তাঁর পৈতৃক বাড়িটির ত্রিশ একর জায়গায় জগদীশ চন্দ্র বসু কলেজ ও কমপ্লেক্স তৈরি হয়েছে। তাঁর জীবিত অবস্থায় তিনি তার সম্পত্তি দান করে যান। সেখানে ১৯২১ সালে সুরুজ বালা সাহা বিদ্যালয় ও পরে ১৯৯১ সালে জগদীশ চন্দ্র বসু ইনস্টিটিউশন ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০১১ সালে জগদীশ চন্দ্র বসু কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়েছে, যা চলে জগদীশ চন্দ্র বসু ইনস্টিটিউশনের উদ্যোগে। কমপ্লেক্সে তৈরি হয়েছে জগদীশ চন্দ্র বসু স্মৃতি জাদুঘর, পশু-পাখির ম্যুরাল, কৃত্রিম পাহাড়-ঝরনা ও সিঁড়ি বাধানো পুকুর ঘাট। জাদুঘরে জগদীশ চন্দ্র বসুর পোট্রেট, গবেষণাপত্র, হাতে লেখা পান্ডুলিপি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল প্রাপ্তিতে তাঁকে লেখা চিঠি ও রবীন্দ্রনাথের বসুকে লেখা চিঠি, তেল রং দিয়ে অাঁকা ১৭টি দুর্লভ ছবি, রয়্যাল সোসাইটিতে দেওয়া বক্তৃতার কপি এবং নানা দুর্লভ জিনিস রয়েছে।
২৬ জুলাই ২০২০ মৌ ভট্টাচার্য আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘তিতাস একটি স্মৃতির নাম’ শিরোনামে একটি সুন্দর কাহিনী লিখেছেন। তাতে জেনেছি, “সংরক্ষিত করা যায়নি অদ্বৈত মল্লবর্মণের বাড়িটিকেও। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ভূখণ্ডের দেশগুলোর কলোনিয়াল হ্যাংওভারের কথা বিশ্ববিদিত, কিন্তু সংরক্ষণের ধারাবাহিকতা তারা আজও আয়ত্ত করে উঠতে পারেনি। তাই অদ্বৈত মল্লবর্মণের বাড়িটিকে মিউজ়িয়াম করে তোলা সম্ভব হয়নি, আরও অনেক কিছুই, যা সংরক্ষণযোগ্য ছিল, ক্রমশ হারিয়ে গিয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাটি থেকে।“
অচিন্ত্য বিশ্বাস জানিয়েছেন, “আমি অদ্বৈত মল্লবর্মণের বসত বাড়ি দেখে এসেছি ১৯৯৯ এর ৩১ ডিসেম্বর। পরে ২০০৫ নাগাদ খবর পাই, একটা মূর্তি বসেছে। মৌলবাদীরা এ নিয়ে আপত্তি করেছিল।
১৯৯৯ এ স্থানীয় মন্দিরের পুরোহিত জানিয়েছিলেন খুব কষ্টে আছেন। ২০০৮ নাগাদ রাজশাহী যাই, কালীপুজো ছিল, ভীরু তারাবাতি জ্বলছিল। পটকা তুবড়ি ফাটেনি!“