অশোক সেনগুপ্ত, আমাদের ভারত, ৩০ অক্টোবর: “অনেকে দুখিয়ার মা না বলে, বলে ‘বাবুলালকা-আদমী’। কথাটা খুবই ভাল লাগে সুখিয়ার মা’র, বিশেষ করে যখনই আপিসের উর্নিপাগড়ি পরা বাবুলালের চেহারা তার মনে আসে। এমন মানায় এ পোশাকে বাবুলালকে। বুধনী ভাবে পাড়ার সকলে হিংসেয় ফেটে পড়ছে। দুখিয়ার মাকে রোজগার করতে হয় না বলে সত্যিই পাড়ার মেয়েরা তাকে হিংসে করে। এত লোকের বিষের নজর এড়িয়ে দুখিয়াটা বাঁচলে হয়।”
‘ঢোঁড়াই চরিতমানস’ উপন্যাসে এক পেয়াদার সহধর্মিণীর চোখ দিয়ে সতীনাথ ভাদুড়ি এভাবেই দেখছেন আকৃষ্ট নিম্নবর্গীয় একটি পরিবারকে। ‘চাপরাসীর বৌ’ দেখছে রাষ্ট্রকে। এভাবেই সুপরিচিত প্রশাসক আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘আমলার মন’-এ ফুটিয়ে তুলেছেন আমলাকূলকে। বিভিন্ন সময়ে আমলাদের অনেকে বিভিন্ন ভাষায় তাঁদের কর্মক্ষেত্র নিয়ে চর্চা করেছেন। সেই তালিকায় আলাপনের এই বই নিছক একটি সংযোজন নয়, বরং একটি ব্যতিক্রমী সংযোজন।

কেন ব্যতিক্রমী? প্রথমত, আলাপনের লেখার অনন্য শৈলী। লেখার ধাঁচ থেকে বিশ্লেষণ, শব্দ নির্বাচন, বাক্যগঠন— একেবারেই আর পাঁচজনের থেকে অন্যরকম। লেখার মধ্যে মুন্সিয়ানার ছাপ স্পষ্ট। দ্বিতীয়ত, তিনি যেভাবে কখনও রবীন্দ্রনাথ, কখনও শরৎচন্দ্র, কখনও বা গুরুসদয় দত্তর প্রাসঙ্গিক উক্তির শরনাপন্ন হয়ে বিশ্লেষণ করেছেন, তা এক কথায় অনন্য। বিভিন্ন অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন তাঁর মন্তব্যের সংশ্লিষ্ট পাদটিকা— সংখ্যায় মোট ১১০। সুতারাং নিছক আপন মনের মাধুরী মেশানো পর্যবেক্ষণ নয়, তা বলাই বাহুল্য।
বইটির মূল উপপাদ্য বিশ্লেষণে লেখা হয়েছে, “আমলা আসলে কে বা কী? সে কি ঈশ্বরপ্রতিম, বা দেবদূত, প্রায় যেন বিধাতাপুরুষ? নাকি সে নেপথ্যে মৃত সৈনিক, অসহায় দাস? পুংলিঙ্গ, না স্ত্রীলিঙ্গ, না ক্লীবলিঙ্গ? সে কি গৌরবে বাঁচে, না অগৌরবে মরে? তার স্বাধীনতার সীমানা কোথায়, অস্তিত্বের সীমাবদ্ধতা কী? বাংলা ও ভারতবর্ষের কয়েক শত বৎসরের ইতিহাস ছেঁচে এই বইয়ে তুলে আনা হয়েছে প্রশাসনিক ক্ষমতার আশ্চর্য সব গাঢ়, নির্মোহ, কিন্তু অন্তরঙ্গ বিশ্লেষণ।“
আরও বিশদ ব্যখ্যা করতে গেলে বইটিতে মোট ১৪টি অধ্যায়। এগুলো হল ১) ভূমিকা, ২) আমলার মন আমলা শব্দটাকে এবার নির্বাসনে পাঠাতে হবে, ৩) আদি বাঙালি প্রশাসককুল এবং বাংলা ভাষার নির্মাণে তাদের ভূমিকা, ৪) সাম্রাজ্যবাদী রাজপুরুষের মন : ক্ষমতার রতি, ৫) সাহেব অমাতার আরেক রকম বিষণ্ণ আত্মদর্শন, ৬) রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ কি আসলে অন্তগামী ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রের উপর একটি টিপ্পনী? ৭) ঔপনিবেশিক প্রশাসনে দেশপ্রেমী ভারতীয় রাজপুরুষ : রাষ্ট্রকার্যে দেবীদর্শন, ৮) পরাধীন রাষ্ট্রভৃত্যের গঠনমূলক দেশকর্ম বিস্তৃত প্রশাসক গুরুসদয় দত্ত, ৯) স্বাধীনতার পর বাংলার প্রশাসন ও রধীন সেনগুপ্ত, ১০) প্রশাসকের মৃত্যু, ১১) আজকের রাজকন্যা ও রাজকর্মীদের অগৌরবের মরণ, ১২) সরকারি কেরানির অন্তরঙ্গ ইতিহাস ১৩) রাষ্ট্রের পেয়ালা-নির্মাণ : পিওন-আর্নালি-চাপরাশিরা কীভাবে তৈরি হয়, ১৪) রাষ্ট্রকর্মীর লিঙ্গবোধ।
আগ্রহী পাঠকের অবশ্য একটা অভাবের কথা মনে হতেই পারে। আর তা হল আমলাকূলের ওপর ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক ফাঁসের বাঁধন। সমস্যাটা প্রায় গোটা দেশের। একদিকে সংবিধানের ওপর দায়বদ্ধতা, অন্যদিকে ওপরওয়ালা (সংশ্লিষ্ট রাজ্যের) নির্দেশ— এ দুয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে টিঁকে থাকা কতটা এবং কেন জটিল হয়ে উঠছে, তার সদুত্তর এতে নেই। তবে এটাও ঠিক, এর পর্যালোচনার চালচিত্র এত বিস্তীর্ণ যার একটা বড় অংশ লেখা যাবেনা প্রমাণের অভাবে। দ্বিতীয়ত, মন্ত্রগুপ্তির একটা দায়বদ্ধতাও থেকে যায়! সব মিলিয়ে প্রশাসনের ওপর একটা সুলিখিত অত্যন্ত মূল্যবান বই ‘আমলার মন’।
কর্মরত অবস্থায় তাঁর প্রকাশিত বইয়ে লেখক পরিচিতিতে আছে— “আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় গত তিরিশ বছর ধরে ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে আছেন। তিন জেলায় জেলাশাসক ছিলেন, কেএমডিএ ও কলকাতা পুরসভার সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদে কাজ করেছেন। এখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রধান সচিব।
নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয় ও প্রেসিডেন্সি কলেজ হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত লেখক তাঁর সাহিত্য, ইতিহাস ও সমাজবিদ্যার পাঠকে রাষ্ট্রকর্মের অধ্যয়নে যুক্ত করায় বিশ্বাসী। যৌবনে নামী সাংবাদিক ছিলেন, সে অভিজ্ঞতাও কাজে লেগেছে।
লেখক আইজেনহাওয়ার ফেলো। তাঁর আগের বই বাঙালির সকালসন্ধ্যা (২০০০)। এছাড়াও তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে প্রসঙ্গ গোর্খাল্যান্ড (১৯৮৭) এবং যৌথ সম্পাদনায় হাওড়া-কলকাতার গঙ্গার ঘাট (১৯৯৮) ও The Philosopher’s Stone: Speeches & Writings of Sir Daniel Hamilton (২০০৩)।“
২০০৬-এ প্রথম প্রকাশের পর পুনর্মুদ্রণ হয়েছে ২০২১-এ। সামনেই এর আত্মপ্রকাশের ছয় বর্ষপূর্তি।

