প্রদীপ কুমার দাস, আমাদের ভারত, ২৯ ডিসেম্বর: মাঝে আর এক বছর, তারপরেই বিধানসভা নির্বাচনের দামামা বেজে যাবে। তার আগে রাজ্যে সাংগঠনিক ক্ষমতা বৃদ্ধিতে নজর বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের। বিজেপি ক্যাডার নির্ভর পার্টি হলেও পশ্চিমবঙ্গে তাদের সংগঠনে তেমন আঁটোসাঁটো বাঁধুনি নেই। তাই বিধানসভা ভোটের আগে বিজেপিকে সুশৃঙখলে বেঁধে ফেলতে নজর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের।
গত কয়েকটি নির্বাচনের দেখা গেছে, রাজ্যে বিজেপির ক্ষমতা বহুগুণ বেড়েছে। কিন্তু ক্ষমতা বাড়লেও সেই জনসমর্থনকে সুশৃংখলভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোথাও যেন একটা ত্রুটি রয়ে গেছে। তাই এবার জেলাস্তরে সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধিতে নজর দিচ্ছেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। অনেকক্ষেত্রে বিভিন্ন জেলায় দলীয় নেতাদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। সেই মতবিরোধ কাটিয়ে জেলার নেতাদের এক সুরে বেঁধে ফেলতে চাইছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। তাই রাজ্যস্তরে কিছু রদবদলের চিন্তাভাবনা চলছে ধীরে ধীরে সেই রদবদলের কাজ শুরু হয়েছে। রাজ্যে বিজেপির সাংগঠনিক নির্বাচনের আগেই সেই রদবদলের কাজ শুরু হয়েছে। সাংগঠনিক পদে আনা হয়েছে সংঘের ছাত্রসংগঠন এবিভিপির নেতা কিশোর বর্মন’কে। তাঁকে সহযোগী সংগঠন সম্পাদক করা হয়েছে আগেই। একই পদে নতুন সংযোজন অমিতাভ চক্রবর্তী।
তিনিও একসময় বিদ্যার্থী পরিষদের নেতা ছিলেন। যদিও আগেই তাঁকে রাজ্য বিজেপিতে নেওয়ার কথা ছিল। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তা পাকা করে ফেলেছিলেন। কিন্তু রাজ্য বিজেপি এবং সংঘ পরিবারের দু’একজন নেতার তীব্র বিরোধীতায় তখন তাকে নেওয়া সম্ভব হয়নি। বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তাঁকে ওড়িশায় সাংগঠনিক কাজের দায়িত্ব দেন। এবার রাজ্য নেতৃত্বের দু’একজনের বিরোধিতাকে আর পাত্তা দিতে চাননি কেন্দ্রীয় নেতারা। তারা সহযোগী সংগঠন সম্পাদক হিসেবে অমিতাভ চক্রবর্তীর নাম ঘোষণা করে দেন।
রাজ্য বিজেপির বর্তমান সংগঠন সম্পাদক সুব্রত চ্যাটার্জির হাতেই রয়েছে সাংগঠনিক ক্ষমতা। কিশোর বর্মন’কে বিজেপিতে আনা হলেও এখনো তেমনভাবে কাজ করতে পারেননি তিনি। মূলত দলের ভিতর প্রতিকূল পরিস্থিতি এই কাজে তার সব থেকে বড় বাধা। এই অবস্থায় অমিতাভ চক্রবর্তীর পর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আরও একজন সহযোগী সংগঠন সম্পাদক নিতে চাইছে বলে জানা গেছে। পরবর্তীকালে এই তিন সংগঠন সম্পাদকের হাতেই দলের সাংগঠনিক ক্ষমতা বৃদ্ধির দায়িত্ব দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। দিল্লি নেতৃত্ব চাইছে, রাজ্যকে তিনটি ভাগে ভাগ করে তিন সহযোগী সংগঠন সম্পাদককে তার দায়িত্ব দেবেন। তারা সেই জেলাগুলিতে পড়ে থেকে দলের সাংগঠনিক ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি শৃঙ্খলা আনার কাজ করবেন।
তবে, তৃতীয় ব্যক্তি কে হবেন তা নিয়ে দলের মধ্যে বিস্তর আলোচনা চলছে। এর আগেও একটি নাম নিয়ে চিন্তাভাবনা হয়েছিল, কিন্তু দলের এই গুরুত্বপূর্ণ পদটিতে একমাত্র সংঘের প্রচারকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাই সেই ব্যক্তির ক্ষেত্রে এটাই প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তিনি একসময় সংঘের প্রচারক থাকলেও পরে তিনি সেই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন। বর্তমানে তিনি একজন কট্টর হিন্দু নেতা হিসেবে ইতিমধ্যে রাজ্যে পরিচিতি লাভ করেছেন। গত লোকসভা ভোটে তাঁর হিন্দু সংগঠন বিজেপির হয়ে কাজ করেছে। তাই হিন্দু সংহতির নেতা দেবতনু ভট্টাচার্যের নাম নিয়ে ফের চিন্তাভাবনা করছে দিল্লি। রাজ্যে দিল্লির যেসব পর্যবেক্ষক রয়েছেন, জানাগেছে তাঁদের সঙ্গেও মোটামুটি আলোচনা সেরে ফেলা হয়েছে। বিধানসভা ভোটের আগে তাই দলের শক্তি বৃদ্ধিতে দেবতনু ভট্টাচার্যের উপর আস্থা রাখছে দিল্লি।
তবে সভাপতি পদে রদবদলের তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানাগেছে। এই পদে বর্তমান সভাপতি দিলীপ ঘোষের সমকক্ষ কাউকে এখনো পাওয়া যায়নি, তাই এখনো এই পদে রদবদলের তেমন কোনো সম্ভাবনার ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। অনেকেই দিলীপ ঘোষের সাফল্যকে একমাত্র তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তুলনা করেন।
বিজেপিতে যোগদানের পর থেকে দিলীপ ঘোষের তালিকায় শুধু সাফল্য। ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটের আগে তাঁকে সংঘ থেকে বিজেপিতে দেওয়া হয়। সেই সময় বারাসাত লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী পিসি সরকারের হয়ে তিনি প্রচারের দায়িত্বে ছিলেন। সেটাই বিজেপিতে তাঁর প্রথম বড় কাজ। এক বছরের মাথায় তাঁকে দলের সভাপতি করা হয়।
সভাপতি হয়েই দলের ভেতরে নিজেকে পরিচিতি বা গ্রহনযোগ্যতা বাড়াতে উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম ছুটে বেরিয়েছেন। দেখা গেছে দিনের বেশিরভাগ সময় তাঁর গাড়িতেই কেটেছে। অনেক ক্ষেত্রে একই দিনে তিনটি জেলা তিনি চষে বেরিয়েছেন। সকালে হয়তো উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জে কর্মী বৈঠক করলেন , দুপুরে তিনি দক্ষিণ দিনাজপুরে আবার সন্ধ্যায় তিনি মালদায় সভা করেছেন। সকালে তিনি হাওড়ায় উলুবেড়িয়ায় আবার বিকেলে তিনি উত্তর ২৪ পরগণার বসিরহাট এবং বারাসতে সভা করেছেন।
প্রথম দিকে তিনি ছোট ছোট পথসভাতেও অংশ নিয়েছেন। ভিড় তেমন হত না, গুটিকয়েক শ্রোতার সামনে দাঁড়িয়ে তাকে বক্তব্য রাখতে দেখা গেছে। কিন্তু ধীরে ধীরে এইভাবে একদিকে যেমন তিনি দলের কর্মীদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন, একইভাবে সাধারণ মানুষও তার বক্তব্যে আকৃষ্ট হয়েছে। আর দুই বছরের মাথায় খড়গপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে তিনি জয়ী হন এবং আরো দুই বিধায়ককে মালদা এবং আলিপুরদুয়ার থেকে জিতিয়ে আনেন।৷ এবার গত লোকসভা নির্বাচনে চূড়ান্ত সাফল্য পায় রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব। বিজেপি ইতিহাস সৃষ্টি করে ১৮টি লোকসভা আসন দখল করে। দিলীপ ঘোষের সাফল্যের ঝুলি ভরে ওঠে।
তার আলটপকা কিছু মন্তব্য বিরোধী নেতা নেত্রী অথবা দলের কিছু অংশের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলেও, গ্রামবাংলায় দিলীপ ঘোষের জনপ্রিয়তা বহুগুণ বেড়ে গেছে। বর্তমানে শহর এলাকাতেও দিলীপ ঘোষের গ্রহণযোগ্যতা ধীরে ধীরে বাড়ছে। তাছাড়া এই আলটপকা মন্তব্যগুলো নিজেকে হাইলাইট করার জন্য কি না, তা অবশ্য এখনও জানা যায়। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে দিলীপ ঘোষের সমকক্ষ আর কোনও নেতাকে এখনো পর্যন্ত দিল্লি বা সংঘ পরিবার খুঁজে পাননি। তাই আপাতত দিলীপ ঘোষ’কে সরানোর কোনও চিন্তাভাবনা দিল্লি করছেন না বলে জানা গেছে। এই ক্ষেত্রে দিলীপ ঘোষের নেতৃত্বে দলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাংগঠনিক ক্ষমতা বৃদ্ধিতে জোর দিচ্ছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। তাই রাজ্যকে তিনটি ভাগে ভাগ করে ৩ জন সহযোগী সংগঠন সম্পাদককে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে এবং আগামী দিনে হিন্দুত্ব ইস্যু এবং উদ্বাস্তুদের মধ্যে তাদের শক্তি বৃদ্ধিতে হিন্দু সংহতির নেতা দেবতনু ভট্টাচার্যকে পেলে বিজেপির লাভ হবে বলেই মনে করছে দিল্লি। ইতিমধ্যে ৩৮ সাংগঠনিক জেলা এবং তাদের অধীনে প্রায় ১২০০ মন্ডলের অধিকাংশেই সাংগঠনিক নির্বাচন হয়ে গেছে এবার শুধু রাজ্য সভাপতি নাম ঘোষণার পালা।