সেনা আর “শত্রুপক্ষ ” কেন্দ্রই এখন আমফানে ভরসা

ড. রাজলক্ষ্মী বসু
আমাদের ভারত, ২৪ মে: রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন… ‘ঝড়কে আমি করব মিতে / ডরব না তার ভ্রুকুটিতে’… আমফানের পর মনে হচ্ছে আর দুঃসাহসে কেউ এর উচ্চারণ করবে না।

সময়ের আবর্তে কতো কিছুই না দেখতে হয়। গত বছর ঠিক এই সময় যখন লোকসভা নির্বাচনের দামামা, ঠিক তখনই সারা দেশের ২৩টি বিরোধী দলকে নিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি কোথাও গিয়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন তো বটেই। আজ রাজ্যের বুকে আমফান আছড়ে পড়ল, ১৪টে জেলা লন্ডভন্ড। জেলায় জেলায় এমনকি খোদ কলকাতা শহরেই প্রায় তিনদিন বিদ্যুত্ নেই। জলসঙ্কটের গভীর কালো মেঘ। রাস্তায় বিদ্যুতের খুঁটি আর গাছ একে অন্যকে আলিঙ্গনরত অবস্থায় দুমড়ে মুচড়ে রয়েছে, বিচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ। এতো যে জোটশক্তি, তারা এখন কোথায়! কেন্দ্রের সাথে বারংবার অসহযোগিতা রাজ্যের, যা ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টেও প্রভাব ফেলেছে। গত ৮ মে, কেন্দ্র চিঠিতে এ রাজ্যের রেসিডেন্স কমিশনারকে ডিজাস্টার বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে বলে এবং কি অ্যাকশান প্ল্যান প্রস্তুত আছে তার রিপোর্ট ১৫ মে র মধ্যে দিতে বলে। করোনা সামলাতে গিয়ে রাজ্যের সে সময় আর হয়নি। ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টে অনেক ঘাটতি যে এখনও এ রাজ্যে আছে তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ সংস্থা এবং রাজ্যের মধ্যে ভাব আদান প্রদানের কার্পণ্যতা। বিদ্যুৎ সংস্থাগুলিকে আগাম সতর্ক করলে এতটা বাড়তি সমস্যা হতো না। কারেন্ট না থাকা বিষয়ে যে বক্তব্য মাননীয়া রেখেছেন- ” আধ ঘন্টা বা দু’ দিন কারেন্ট নেই…।” আধ ঘন্টা কারেন্ট না থাকা নিয়ে কেউ চিন্তিত নন। চিন্তিত দু দিন বা তার বেশি সময়ের জন্য। উনি বলেছেন- “আমার মুন্ডুটা কেটে নিন।” রাজ্যবাসী র দ্বারা উনি নির্বাচিত। কেন মুন্ডু কাটবে মানুষ? আর তাতে কার কি উপকার হবে?

উত্তেজনার বশে উনি বললেও মানুষ ধৈর্য রাখছে। কখনও বা জল বিদ্যুৎ ইন্টারনেট দীর্ঘ সময়ের জন্য না পেয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। জিজ্ঞাসা উঠছে সিইএসসির ভূমিকা নিয়ে। এই একচেটিয়া বাজার বাম আমলে তৈরি, আর তার বাড়বাড়ন্ত তৃণমূল সরকারের জমানায়। এখন জেনারেটারে রাজ্য চলছে- ঘোর তমসায় আমরা। প্রসঙ্গক্রমে বলা ভালো রাজ্যকে গাছ কাটার মেশিনটাও ওড়িশা থেকে ধার নিতে হলো। সুলেখা মোড় থেকে কাকদ্বীপ–মানুষ তার সুরক্ষা বুঝতে চাইছে। ছাড়খার রাজ্যে বিদ্ধস্ত ঘাসফুল পরিচালিত সরকার। এমতাবস্থায় রাজ্যকে স্বাভাবিক রাখতে পথে নামাতে হলো সেনা।

২৩ মে, স্বরাষ্ট্র দপ্তরের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি পুনরুদ্ধার করার জন্য সেনা সমর্থন চাইছে বাংলা। এরই মধ্যে কেন্দ্র এবং রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা দল মোতায়েন করা হয়েছে বিভিন্ন প্রান্তে। উচ্চ সতর্কতার আওতায় এখন রাজ্য। ঝড়ের পরের দিন, প্রধানমন্ত্রী–মুখ্যমন্ত্রী আকাশ পথে বিধবস্ততা পর্যবেক্ষণ করেন। আবার ঐ দিনই কেন্দ্র বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির সাথে বৈঠক করেন মমতা ব্যানার্জি। বিষয় ছিল- কেন্দ্র বিরোধী নীতি গঠন। কিন্তু এ কেমন রাজনীতি! এ কেমন রাজধর্ম।

প্রশ্ন এবার সেনা চাওয়া নিয়ে। এও এক অতি অপরিচিত ব্যবহার মুখ্যমন্ত্রীর। ২০১৬ র ডিসেম্বরের ঘটনা। হঠাৎ স্মরণে এলো। ট্রাকসহ বিভিন্ন ভারী যানবাহনগুলির বহন ক্ষমতা প্রভৃতির বিস্তারিত তথ্য জোগাড় করতে ( যা সারা দেশেই তারা নিয়মিত করেন।) সেনা এ রাজ্য সহ আরো সাতটি রাজ্যের মোট ৬৮টি স্হানে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অবস্থান করছিল। সেদিন কিন্তু মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী তার বিন্দুমাত্র সহযোগিতা করেননি। সেদিনও গণতন্ত্র রক্ষার্থে তিনি প্রতিবাদ আর রাতভোর দপ্তরেই অবস্থান করেন। তাঁর প্রতিবাদে আর অসহযোগিতায় সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হন। টোল প্লাজায় সেনার রুটিন কাজে বাধা দেওয়ায় তৎকালীন কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর পারিক্কার বলেছিলেন –“Political frustration”। সেদিন ভারতীয় সেনাও তথ্য প্রমাণ দিয়ে মমতার দ্বিচারিতার প্রমান দেয়। জেনারেল সুনীল যাদব সাংবাদিক বৈঠকে প্রমান করেন , তৃণমূলের এই সেনা বিরোধীতা ভিত্তিহীন, সেনার ইসটার্ন কমান্ড প্রতিবছর এই পদ্ধতিতে ডেটা সংগ্রহ করে এবং তাতে রাজ্য পুলিশও সাহায্য করে। টোল প্লাজায় সেনার রুটিন কাজে সেদিন উনি বলেছিলেন, “জরুরী অবস্থার চেয়েও ভয়ঙ্কর। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর আঘাত করা হচ্ছে।” আজ কি তাহলে যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো বিঘ্নিত হচ্ছে না! স্ববিরোধীতা আজ যে নিজের অজান্তেই হচ্ছে। তবুও বলব, রাজ্যের এবং মানুষের স্বার্থে এমন স্ববিরোধিতাকে গ্রাহ্য করবো আমরা।

স্বয়ং মমতা ব্যানার্জি ঠিক একবছর আগে বলেছিলেন–“সেনার নামে ভোট চাইছে মোদী”। পুলওয়ামায় জঙ্গি আক্রমণের পরে, এই নরেন্দ্র মোদী কে “সেনা” বিষয় নিয়ে শব্দবানে বিঁধেছিলেন মাননীয়া। ৫ মার্চ ২০১৯, কেন্দ্রের এবং নরেন্দ্র মোদীর কড়া সমালোচনা করে মাননীয়া বলেছিলেন, “কেন এতোগুলো জওয়ানদের রক্ত নিয়ে রাজনীতি করা হবে, কেন মানুষগুলোকে বাঁচানোর চেষ্টা হলো না, জওয়ানদের রক্ত দিয়ে কেউ নির্বাচন জিতবে এটা কিন্তু হওয়া যাবে না।”

জওয়ান বা সেনারা নীলকন্ঠ। তাই উনারা রাজনীতির তোয়াক্কা করেন না। উনারা প্রাণ দেন, অক্লান্ত সেবা দেন তাদের ধর্ম পালনে। এ রাজ্যে তৃণমূল সরকার প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পরপরই সেপ্টেম্বরে, দার্জিলিং, দিনাজপুর, শিলিগুড়ি ও জলপাইগুড়ি ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেদিনও কিন্তু সিকিমের এবং সেনার সাহায্যেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছিল। রাজ্যের আজ এমন ভাগ্য পরিহাস যে পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে সেই সেনাকেই নবান্ন আমন্ত্রণ জানালো। কিন্তু এই সতর্কতা আর সহযোগিতা সবক্ষেত্রে প্রদর্শিত হলে হয়তো রাজ্যের সুদিন অনেক আগেই ফিরত।
“জ্যোতিষ্কলোকের পথে” কটা চিহ্ন রাখবে জানি না, কিন্তু এরা কর্তব্য করবেন। রাজর্ষিতে রঘুপতি নক্ষত্র রায়কে বলেছিলেন, “উপায় ঢের আছে। উপায়ের অভাব নাই। আমি তোমাকে উপায় দেখাইয়া দিব, তুমি আমার সঙ্গে চলো।” সমাজের দেশের প্রকৃত মঙ্গল চাইলে রাজ্যকে রাজধর্মকে ঐ রঘুপতির মতোই উদ্যোগী হতে হবে। রাজ্য নিশ্চয়ই কঠিন সময়েও জয়ী হবে। (বক্তব্য এবং মতামত লেখকের নিজস্ব)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *