তপন কুমার ঘোষ
আমাদের ভারত, ১১ মার্চ: ঠিক বুঝিয়ে ব্যাখ্যা করে বলার মত ধৈর্য্য নেই। যারা রোদ্দুর রায়’কে গ্রেপ্তারের দাবী জানাচ্ছে আমি তাদের সঙ্গে একমত নই। একেবারেই একমত নই।
রোদ্দুর রায় সম্বন্ধে সকলের অভিযোগ, তিনি আমাদের শিল্প সংস্কৃতির বিকৃতি ঘটাচ্ছেন, মহামনীষীদের অপমান করেছেন, এবং সর্বোপরি চূড়ান্ত অশ্লীলতা করছেন। সব অভিযোগই হয়ত ঠিক। কিন্তু একেবারে নিঃসংশয়ে বলা যায় না। ভিন্নমতও আছে। অভিযোগগুলো ঠিক হোক বা না হোক, এর প্রতিকার গ্রেপ্তার করে পুলিশ কেস দিয়ে হওয়া উচিত নয়। সাংস্কৃতিক বিকৃতির প্রতিকার সংস্কৃতি দিয়েই করতে হবে। ঠিক যেমন বই নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে। কোনও বইই নিষিদ্ধ করা উচিত নয়। বইয়ের উত্তর বই হওয়া উচিত। আমরা যদি স্যাটানিক ভার্সেস বা লজ্জা নিষিদ্ধ হলে তার প্রতিবাদ করি, তাহলে নবারুণ ভট্টাচার্য্য বা রোদ্দুর রায় দের মত লেখকদের বই নিষিদ্ধ করার দাবীও আমাদের করা উচিত নয়। আজ থেকে না জানি কত হাজার বছর আগে যখন চার্বাক লিখেছিলেন পাপ পুণ্য স্বর্গ নরক কিছু নেই, যখন কপিল মুনি লিখেছিলেন ঈশ্বর নেই, যখন গৌতম বুদ্ধ বলেছিলেন, “বেদ মানার দরকার নেই”, তখনও কেউ ওই পুঁথিগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়ার দাবীও জানায়নি, জনগণের জন্য ওগুলো নিষিদ্ধ করার দাবীও জানায়নি। ওইসব মতের প্রবক্তাদের ইউরোপের মত পুড়িয়ে মারার চেষ্টাও কোনও রাজা বা সমাজ পরিচালক করেননি। এটাই ভারত, এটাই হিন্দু সংস্কৃতি। এই ভারত জানে, চিন্তাকে বন্দী করা যায় না, ধ্বংস করা যায় না। যদি সেই চিন্তার মধ্যে শক্তি থাকে তাহলে তা হবে অপ্রতিরোধ্য। আর যদি তার মধ্যে শক্তি না থাকে, তাহলে তার মৃত্যু এমনিতেই হবে। ঠিক যেমন ডি এল রায়ের দ্বারা রবীন্দ্রনাথের নোংরা সমালোচনার মৃত্যু এমনিতেই হয়ে গেছে। তার জন্য রবীন্দ্রনাথ বা তাঁর ভক্তদের থানায় এফআইআর করতে হয়নি। এখানে আরো লক্ষণীয়, দ্বিজেন্দ্রলালের রবীন্দ্রনিন্দার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু দ্বিজেন্দ্রলালের নিজস্ব সৃষ্টি ও মহিমার মৃত্যু হয়নি।
আর দুটো কথা।
১) রোদ্দুর রায় অশ্লীলতা করছেন, সমাজের সংবেদনশীলতায় আঘাত হানছেন। সুনীল গাঙ্গুলী-র কীর্তিগুলো কি সবাই ভুলে গেলেন! রবীন্দ্রনাথ যত মানুষের আরাধ্য, বোধকরি কালী মা এবং দেবী সরস্বতী তার থেকে অনেক বেশী মানুষের আরাধ্যা। সেই দেবদেবীদের নিয়ে চূড়ান্ত নোংরামিকে যে সমাজ উন্নত সাহিত্যের মর্যাদা দিয়েছে, সেই সমাজের রোদ্দুর রায় কে “জেলে দাও ফাঁসি দাও” দাবী করা সাজে না।
২) আমাদের তরুণ সমাজ রোদ্দুর রায় কে দেখে বিভ্রান্ত হবে ও অশ্লীলতা শিখবে। এটা অভিযোগ। রোদ্দুর রায় না থাকলেও শিখবে ও বিভ্রান্ত হবে যদি সমাজ তার সামনে উন্নত কিছু না দিতে পারে। যে যুগে ক্ষুদিরাম প্রফুল্ল চাকী ছিলেন, মুকুন্দদাস ছিলেন, সেইযুগেই বটতলার সাহিত্যও ছিল। বটতলার সাহিত্য সেইযুগে তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত করতে পারেনি।
তাই রোদ্দুর রায়রা সমাজকে বিপথগামী করবে – এ চিন্তা ছেড়ে দিন। আপনারা হিন্দুত্ববাদী সত্যজিৎ রায় ও জাতীয়তাবাদী শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, সুকান্ত ভট্টাচার্য তৈরী করার চেষ্টা করুন। এগুলো তৈরী না হলে ওই রোদ্দুর রায় কে ফাঁসি দিয়ে দিলেও তরুণ সমাজকে বিপথগামিতার হাত থেকে রক্ষা করতে পারবেন না।
এইবার শেষ কথা। রোদ্দুর রায় ঠিক না ভুল, সেকথা বলার সময় এখনো আসেনি। তাই সবাই রোদ্দুর রায় কে ছেড়ে দিয়ে নিজের নিজের কাজে মন দিন।