অশোক সেনগুপ্ত, আমাদের ভারত, ২২ মার্চ: বাংলার শিক্ষা জগতে আর এক ইন্দ্রপতন। চলে গেলেন সুনন্দ সান্যাল। বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। শেষের কয়েক বছর বার্ধক্য জনিত অসুখে ভুগছিলেন।
কলকাতার একটি ইংরেজি দৈনিকের রেসিডেন্ট এডিটর তরুণ গোস্বামীর কথায়, “সুনন্দদা সেই যুগের শেষ প্রতিনিধি যে যুগে বহু মানুষ ছিলেন যারা ইংরেজি এবং বাংলাতে একই রকম পারদর্শী। যখন ইংরিজিতে বক্তৃতা দিতেন তখন সেটি যেমন শুনতে ভাল লাগতো, বাংলা বক্তৃতা দেবার সময় কখনও একটি ইংরিজি শব্দ ব্যবহার করতেন না। ক্ষুরধার যুক্তি, তীব্র রসবোধ তার বক্তৃতা গুলিকে অন্য স্তরে নিয়ে যেত।
রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির কলেজ, বেলুড়ের তিনি ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন। কি করে ক্লাসের পড়ানো আকর্ষণীয় করতে হয় তাতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। নিজের বিষয়ের সাথে তিনি নানা বিষয় জানতেন এবং তাঁর প্রাঞ্জল ভাষা এ আলোচনা সকলের নজর কাড়তো।
স্টেটসম্যান হাউস ছিল তাঁর দ্বিতীয় গৃহ। দুটি খবরের কাগজে তিনি অসংখ্য লেখা লিখেছেন। বাম ফ্রন্ট যখন ইংরিজি তুলে দিলো, তিনি তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। সবসময় লেখা পড়ার মধ্যে থাকতেন, চিন্তা করতেন। ছাত্রদের কিসে ভাল হবে সেদিকে সর্বদা নজর ছিল এই দরদী মাস্টার মশাই এর। স্টেটসম্যান-এ এলে অনেকক্ষন তাঁর সাথে আলাপের সুযোগ আমার হয়েছিল। বহু বিষয় আলোচনা করেছি। স্বামীজি বিষয় কিছু বলতে গেলে ফোন করতেন।
আমি যখন টেলিগ্রাফ থেকে স্টেটসম্যান-এ এসেছিলাম তখন একদিন সি আর ইরানী আমাকে বললেন তোমার দু’জন ব্যক্তির দুটি চিঠি লাগবে। তাঁরা লিখে দেবেন তোমাকে তাঁরা চেনেন। আমাকে চেনেন বলে দুজন লিখে দিয়েছিলেন, একজন স্বামী লোকেশ্বরানন্দ আর অন্যজন সুনন্দ দা। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি আমার আত্মীয় হতেন। তিনিও আমার মামা বাড়ির দেশ পাবনাতে থাকতেন দেশ ভাগের আগে।
ধুতি পাঞ্জাবী পরা ইংরিজির মাস্টার মশাইদের তিনি ছিলেন শেষ প্রতিনিধি। ভাল থাকবেন সুনন্দ দা, যেখানে আছেন আনন্দে থাকবেন মুখের সেই পবিত্র হাসিটি নিয়ে।“
‘হ্যাশট্যাগ বোকা_বুদ্ধিজীবীর_মৃত্যু’ শিরোনামে সাংবাদিক মানব গুহ লিখেছেন, “এখন পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর টুইট নেই, শোক প্রস্তাব নেই, গান স্যালুট নেই, বুদ্ধিজীবীদের শোক নেই, মিডিয়ার হইচই নেই…নিঃশব্দে চলে গেলেন, বাংলার অন্যতম প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবী, পরিবর্তনের অন্যতম সৈনিক, শিক্ষাবিদ সুনন্দ সান্যাল। শেষ হল এক বড় প্রতিবাদী অধ্যায়ের…খুব চুপচাপ ভাবেই….
বাংলায় বামফ্রন্ট শাসনের অত্যাচার, ছাপ্পা ভোট, স্বজনপোষন, জুলুমবাজি, দাদাগিরি ইত্যাদির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে পথে নেমেছিলেন। সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মুখ ছিলেন এই শিক্ষাবিদ…সিঙ্গুরে টাটাদের গাড়ি প্রকল্পে জোর করে জমি অধিগ্রহন ও নন্দীগ্রামে জমি রক্ষার লড়াইয়ে বুক চিতিয়ে লড়ে তৈরি করেছিলেন বাংলার নাগরিক আন্দোলন…পরিবর্তনের অন্যতম সেরা অনুঘটক…
বামেদের হঠিয়ে পরিবর্তনের নতুন বাংলা গড়তে, ২০০৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট তৈরি হলে, তাঁর সভাপতি হয়েছিলেন শিক্ষাবিদ সুনন্দ সান্যাল…
বাম আমলে বারবার ব্যাঙ্গের শিকার হয়েছেন…
লাঞ্ছনা গঞ্জনা সয়েছেন…..তবু লড়াই থেকে পিছু হঠেননি…প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে লড়েছেন….প্রতিবাদ করেছেন সব অন্যায়ের….
বাংলায় পরিবর্তনের পরেও পাল্টাননি….২০১১ সালে বামফ্রন্টকে সরিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূলের ঐতিহাসিক জয়ের পরও, গতানুগতিক রাজনীতির মধ্যে অন্য অনেকের মতো গা ভাসাননি সুনন্দ সান্যাল। একের পর এক বুদ্ধিজীবী নিজের শিরদাঁড়া বিক্রি করে দিলেও, সুনন্দ সান্যাল সেই রাস্তায় হাঁটেননি….
তাই মমতার প্রিয়পাত্র হননি…কোন অ্যাকাদেমির চেয়ারম্যান হয়ে লাখ টাকার দাসত্ব করেননি…সরকারি গাড়িতে বিলাসিতার গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাননি…
২০১১ এর মে-তে ক্ষমতায় আসার পর, এই শিক্ষাবিদকে স্কুল সিলেবাস রিস্ট্রাকচার কমিটির চেয়ারম্যান করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু প্রথম দিনের বৈঠকেই তিনি পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন, তিনি চেয়ারম্যান পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে সাধারন সদস্য হিসেবেই থাকবেন, কমিটি নিজের চেয়ারম্যান বেছে নিক। তারপরে, ছয়মাসের মধ্যেই ২০১১র নভেম্বরে, সেই পদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। ক্লাস এইট পর্যন্ত পাশ-ফেল তুলে দেওয়া হোক…মমতার এই নির্দেশ মানতে চাননি সুনন্দ সান্যাল….তিনি মনে করতেন, পাশ-ফেল তুলে দিলে ছাত্রছাত্রী-দের পড়াশোনার ইচ্ছেটাই শেষ করে দেওয়া হবে…..
সুনন্দ সান্যাল মনে করতেন, ক্ষমতার বাইরে থেকে সরকারের ভুল-ত্রুটির সমালোচনা একটি সরকারকে সঠিক দিশা দেখাতে পারে। তাঁর এই মত অবশ্য শাসক দলের পছন্দ না হওয়ায়, পরিবর্তনের অন্যতম সৈনিকের সঙ্গে পরবর্তীতে বিস্তর দূরত্ব তৈরি হয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের….
রাজ্যসভার সাংসদ পথ অথবা শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব হেলায় নাকচ করে দিয়েছেন সুনন্দ স্যান্যাল…নিজের অস্তিত্ব বিকিয়ে না দেবার বিশ্বাসে, অনড় ছিলেন জীবনের শেষদিন পর্য্যন্ত। মঙ্গলবার দুপুর একটায় দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর সল্ট লেকের এক বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যু হল তাঁর….নিরবে নিঃশব্দে…সবার চোখের আড়ালে…মিডিয়া কভারেজের বাইরে…
একটু দাসত্ব, একটু দালালি, একটু চাটাচাটি করতে পারলেই…..আজ কলকাতায় বড় মিছিল হত…কেওড়াতলায় কলকাতা পুলিশের গান স্যালুট হত…পরিবর্তনের সৈনিকের জন্য রাস্তায় নামতেন সেই পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ‘ফায়দা’ পাওয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়…..
“সুটিয়ায় প্রতিবাদী শিক্ষক বরুণ বিশ্বাস খুনে দায়ী, তৃণমূল নেতা ও রাজ্যের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক”…একথা প্রকাশ্যে বলায় জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক আইনি নোটিশ ধরান সুনন্দ স্যান্যালকে…
সল্টলেকে এসএসসি অফিসের সামনে অনশনে বসা পরীক্ষায় পাশ করা ছাত্রছাত্রী-দের সমর্থনে অনেকবার এগিয়ে এসেছেন… অনশনে বসেছেন…
সিঙ্গুর আন্দোলনের নেতা বেচারাম মান্নার সম্পত্তি, তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে কিভাবে আকস্মিক বৃদ্ধি হয়ে কয়েক হাজার কোটি গুণ বেড়েছে, তা সবার সামনে এনে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন তিনিই….
২০১৩র নভেম্বরে সারদা কাণ্ডে অভিযুক্ত কুণাল ঘোষ যে ১২ জন নেতার নাম সামনে এনেছিলেন, তাদের গ্রেফতার করার দাবি নিয়ে রাস্তা ঘেরাও করে গ্রেফতার হয়েছিলেন সুনন্দ সান্যাল…সেই কুণাল ঘোষ আজ তৃণমূলের মুখপাত্র ও মমতার কাছের লোক…..
বাংলার বুদ্ধিজীবী-দের মধ্যে কামদুনি কাণ্ডের প্রথম প্রতিবাদটা শুরু করেছিলেন…
শুধু তিনিই রয়ে গেলেন, চিরকালের প্রতিবাদী…
এত বোকা বুদ্ধিজীবী আজকের দিনে হয়….
তাও এই বাংলায়…..!!???”