সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা, ১৪ জানুয়ারি: দুটি হাতের কবজি থেকে চেটো কেটে যাওয়ায় আতঙ্কে যুবক ভেবেছিলেন, সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেলেন। কিন্তু তার ক্ষেত্রে নিয়তি অতটা নিষ্ঠুর নয়। দুটি হাতই জুড়ে দিয়ে ফের নজির সৃষ্টি করল এসএসকেএম হাসপাতাল।
সেই কাটা দুই হাতের পাঞ্জা কব্জির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। আর ৭ দিনের পর থেকেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরছেন ৩৯ বছরের যুবক শংকর সাহা। আঙুলও নাড়াতে পারছেন। এসএসকেএম হাসপাতালের ট্রমা কেয়ারে এমন নজিরবিহীন ঘটনা ঘটিয়েছেন প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের চিকিত্সকেরা।
জানা গিয়েছে, রোগীর নাম শংকর সাহা। সরস্বতী প্রেসে ছাপাখানার কর্মী হিসেবে কাজ করেন তিনি। গত মঙ্গলবার ৭ জানুয়ারি ভোরে দিন আগে হাইকোর্টের বিভিন্ন কাগজপত্র ছাপানোর কাজ চলছিল সরস্বতী প্রেসে। দ্রুত অনেকটা কাজ শেষ করার ছিল। পেপার কাটিং মেশিনে ছাপা সামগ্রীর পেপার কাটিং কাজ করছিলেন শংকর। মুহূর্তের অসাবধানতায় কাটিং মেশিনের দুটি হাতে ঢুকে যায়। পেপার কাটারের ধারালো ব্লেড মুহুর্তের মধ্যে দুটি হাত হাতের কব্জি থেকে বাকি অংশ কেটে পড়ে যায়।
অপারেশনের পর হাসপাতালের বেডে শুনেই শংকর বলেন, “ওই মুহূর্তে আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। দেখলাম হাত কেটে পড়ে রয়েছে কবজিগুলো। ভেবেছিলাম সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেলাম। একদিকে কাটা হাত দেখা আরেকদিকে সারা জীবনের জন্য কাজ চলে যাওয়ার আতঙ্ক, সবমিলিয়ে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেছিলাম।”
ছাপাখানার কর্মীরা জানিয়েছেন, একটা বিকট আর্তনাদ শুনে সকলে ছুটে এসে দেখেন মাটিতে শুয়ে কাতরাচ্ছেন শঙ্কর। পাশেই পড়ে রযেছে কব্জি থেকে ছিন্ন হওয়া দু’টো হাত। রক্তে ভেসে যাচ্ছে। মুহূর্তের বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠে, সঙ্গে সঙ্গেই শঙ্করকে নিয়ে যাওয়া হয় কামারহাটির ইএসআই হাসপাতালে। হাতের কাটা অংশ দু’টো প্লাস্টিকে মুড়ে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। সেখান থেকে তাঁদের পাঠানো হয় এসএসকেএমে। সেখানে পৌঁছনো মাত্র শঙ্করকে ভর্তি করা হয় এসএসকেএমের ট্রমা কেয়ার সেন্টারে। দ্রুত তৈরি হয় মেডিক্যাল টিম। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে অস্ত্রোপচার শুরু করে দেন প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের ডাক্তাররা।
এসএসকেএম হাসপাতাল সূত্রে জানানো হয়েছে, প্লাস্টিক সার্জন, অ্যানাস্থেটিস্ট মিলিয়ে ১৪ সদস্যের দু’টি মেডিক্যাল টিম তৈরি হয়। ঘণ্টাখানেকের অস্ত্রোপচারে নিপুণভাবে কব্জি থেকে কাটা হাতের অংশ দু’টো জুড়ে দেন ডাক্তাররা। দীর্ঘ সময় ধরে চলে অস্ত্রোপচার। নার্ভ জোড়া লাগানো হয়। ক্ষতিগ্রস্ত মাংসপেশি অস্ত্রোপচার করা হয়। রক্তের শিরা-উপশিরা জোড়া লাগানো হয়। ৩ দিনের মাথাতেই, জোড়া লাগানো হাতের দুই হাতের আঙ্গুল থেকেই রক্ত বের হতে দেখা যায়। বোঝা যায় রক্তসঞ্চালন হচ্ছে। ৭ দিনের মাথায় চিকিত্সকরা ঘোষণা করলেন সাফল্যের সঙ্গে দুটি হাতে জোড়া লাগানো গিয়েছে।
হাসপাতালের অধিকর্তা মনিময় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, পূর্ণ দলগত চিকিত্সকদের সাফল্য। একজন মানুষ তার কাজের দুটো হাত ফিরে পেলেন। সরকারি হাসপাতাল সেই কাজ করে দেখাল।’ বিভাগীয় প্রধান গৌতম গুহ বলেন, ” আমরা সকলে একসঙ্গে কাজ করেছি। মানুষটাকে সাধারণ জীবনে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ছিল আমাদের। সাফল্য পেয়ে আমরা সত্যিই খুশি।” শংকরবাবু বলেন, “ভেবেছিলাম জীবনটাই শেষ। এখন আবার নতুন করে বাঁচব। বাড়িতে সন্তান, সংসার আছে। আমি উপার্জন করতে পারব। ডাক্তারবাবুদের দয়ায় জীবনে ফের নতুন আশার আলো দেখলাম।”