বিজেপিতে পরিবারতন্ত্রের রমরমা! ছেলে, বউ, বাড়ির জামাই এমনকী বেয়াইমশাই এবং তাঁর শ্যালকও পদাধিকারী

নীল বণিক, আমাদের ভারত, ২৮ জানুয়ারি: বিজেপিতে এখন পরিবারতন্ত্রের রমরমা। ছেলে, বউ, বাড়ির জামাই, ছেলের শ্বশুর, এমনকি সেই শ্বশুরের শ্যালকও বিজেপির পদাধিকারী। শুধু একটি পরিবার নয় এরকম একাধিক পরিবার রয়েছে। সংগঠনে এখন তারাই ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। এই দেখে বহু মানুষ বিজেপি থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন বলে পুরনো নেতা কর্মীদের দাবি।

বিজেপির নেতাকর্মীদের অভিযোগ, নতুন যারা আসছে তারা বিভিন্নভাবে জেলা সভাপতি এবং মন্ডল সভাপতিদের নানান ভাবে হাত করে কমিটিতে ঢুকে পড়ছে। শুধু ঢুকেই ক্ষান্ত থাকছেন না, তাঁর পরিবারের সদস্যরাও মন্ডল এবং জেলা কমিটিতে জায়গা করে নিয়েছেন। কলকাতা লাগোয়া বিজেপির উত্তর কলকাতা শহরতলী জেলাতেও এই জিনিস প্রকট ভাবে ফুটে উঠেছে।

কলকাতা উত্তর শহরতলী জেলার খড়দহ বিধানসভা এলাকায় মন্ডল–৩ নিয়ন্ত্রণ করছে এমন চারটি পরিবার। এই মণ্ডলের পাঁচটি গ্রামপঞ্চায়েত এলাকায় এই চারটি পরিবারের ১৫ জন নেতা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এই ৫ টি পরিবারের একাধিক সদস্য বিজেপির বিভিন্ন কমিটির দায়িত্বে রয়েছেন।

যেমন জয়ন্তী মন্ডল জেলা কমিটির সহ-সভানেত্রী, তাঁর স্বামী মন্ডল কমিটির সদস্য, ছেলে জেলা মেডিকেল সেলের কনভেনার, এমনকি তাঁর ছেলের বউ মৌমিতা মণ্ডল বিজেপির মহিলা মোর্চার আইটি সেলের দায়িত্বে রয়েছেন। শুধু তাই নয় জয়ন্তী মণ্ডলের বেয়াইমশাই এবং তাঁর শ্যালকও দায়িত্বে রয়েছেন। বেয়াইমশাই তথা ছেলের শ্বশুর সঞ্জয় বিশ্বাস জেলা এসসি মোর্চার সাধারণ সম্পাদক, শ্বশুর সঞ্জয় বুশ্বাসের শ্যালক নিউটন রায় মণ্ডল কমিটির সম্পাদক।

একইভাবে প্রভাস কর হয়েছেন মন্ডল সহসভাপতি। তাঁর স্ত্রী শ্যামলী কর মণ্ডল মহিলা মোর্চা সাধারণ সম্পাদক, এমনকি বাড়ির জামাই এবং তাঁর ভাইও মন্ডল কমিটি দায়িত্বে রয়েছেন। তাঁর মেয়েজামাই সুরজিৎ সরকার ওই মন্ডলের যুব মোর্চা সাধারণ সম্পাদক এবং প্রভাস করের শ্যালক প্রদীপ বালা পোদ্দার ওই মণ্ডল কমিটির আমন্ত্রিত সদস্য। অভিযোগ, যুবমোর্চার প্রথম কমিটিতে সুরজিত সরকারকে জায়গা না দেওয়ায় জেলা থেকে সেই কমিটি স্থগিত রাখা হয়েছিল। পরে সুরজিত সরকারকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়ায় কমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়।

একইভাবে লক্ষ্মী মিস্ত্রী মণ্ডল মহিলা মোর্চার সহ-সভাপতি, তাঁর স্বামী সুশান্ত মিস্ত্রি ২২৫ নম্বর বুথের সভাপতি।

অনিমা সাহা মণ্ডল একই মণ্ডলের মহিলা মোর্চার সম্পাদিকা এবং তাঁর স্বামী সোমনাথ সাহা মন্ডল কমিটির সদস্য।

স্বাভাবিকভাবেই এই চারটি পরিবারের থেকে ১৫ জন বিভিন্ন দায়িত্বে রয়েছেন। এদের কেউ প্রমোটার বা জমির দালালি বা অন্যকোনও ব্যবসা করেন। স্বাভাবিকভাবেই পুরনো নেতাদের অনেকেই বিজেপির নতুন কমিটিতে জায়গা পাননি।

এ ব্যাপারে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন এই মন্ডলের তপশিলি মোর্চার সভাপতি প্রদীপ বিশ্বাস। তিনি বলেন, ৪ মাস আগে রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের সভায় যাবার জন্য যে তৃণমূল নেতা আমাদের মারধর করেছিল সেও এখন বিজেপির নেতা হয়ে গেছে। মানুষ এটা ভালোভাবে নিচ্ছে না। সাধারণ মানুষ আমাদের জিজ্ঞাসা করছে, তোমরা বিজেপি করতে না? এখন যারা আসছে তারা কারা? সাধারণ মানুষ বলছে, এই বিজেপিকে মোদীজিও ঠিক করতে পারবেন না। প্রদীপবাবু বলেন, আসলে সব গুপ্তধনের ব্যাপার, এখানে টাকার খেলা চলছে। মন্ডল সভাপতির কাছে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের হাতে মার খাওয়া থেকে কোনও রকমে বেঁচে গিয়েছি। যারা তৃণমূল থেকে এসেছে তারা হুমকি দিয়ে বলছে আর কয়েক মাস যাক, ক্ষমতায় আসি তারপর তোদের টেংরি খুলে নেব। তার অভিযোগ জেলা সভাপতি কিশোর করকে বলেও কোনও কাজ হয়নি, প্রতি ক্ষেত্রেই তিনি “দেখছি” বলে এড়িয়ে যান।
একই অভিযোগ বিজেপির আরএক নেতার। তিনি বলেন, তৃণমূল থেকে আসা নেতাদের দলে নেওয়ায় সাধারণ মানুষ ধীরে ধীরে বিজেপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এখন টাকা খরচ করলেই দায়িত্ব পাওয়া যাচ্ছে। দেড় মাস আগেও যে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যোগ দিয়েছে তাকেও মন্ডলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তার দাবি, এই দেড়মাসে ওই নেতা প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা খরচ করে দলের দায়িত্ব পেয়েছে। দুজনেরই বক্তব্য, এই এলাকায় প্রায় সাড়ে তিনশ কারখানা রয়েছে, যেখান থেকে এতদিন শাসকদলের লোকজন তোলা আদায় করত। এখন সেই তোলাবাজরা বিজেপিতে ঢুকছে।

একইভাবে খড়দহ এক নম্বর মণ্ডলের সম্পাদক করা হয়েছে গোবিন্দ মিস্ত্রিকে এবং তাঁর স্ত্রী মিনি মিস্ত্রী ওই মন্ডলের মহিলা মোর্চার সহ-সভানেত্রী হয়েছেন। পিয়ালী সেনগুপ্ত ওই মণ্ডলের আর একজন সহ সভানেত্রী, তাঁর ভাই প্রমিত সেনগুপ্ত ওই মণ্ডলের ৩১ নম্বর বুথসভাপতি। আবার তার থেকেও অবাক করা কান্ড ঘটেছে বলে ওই মন্ডলের এক প্রাক্তন নেতা জানালেন। তিনি বলেন, এক বুথের বাসিন্দাকে অন্য বুথের সভাপতি করা হয়েছে। ২১ এবং ২২ নম্বর বুথে যাদের সভাপতি যাদের করা হয়েছে তারা ওই বুথের ভোটার নন, তারা ২৬ নম্বর বুথের বাসিন্দা, অথচ ২৬ নম্বর বুথে কোনও সভাপতি নেই।
একইভাবে যিনি দুই নম্বর মণ্ডলের শক্তি প্রমুখ, তাঁকে এক নম্বর মণ্ডলের যুব সভাপতি করা হয়েছে। ওই নেতা বলেন, এখন কর্মীর অভাব নেই অথচ এক ব্যক্তিকে একাধি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যেমন, গোবিন্দ মিস্ত্রী, যিনি মণ্ডলের সম্পাদক, তাকেই আবার সহ শক্তিকেন্দ্র প্রমূখ এবং অন্য একটি শক্তিকেন্দ্রের পর্যবেক্ষক করা হয়েছে। সদ্য বিজেপিতে আসা সুজয় বাইনকে মণ্ডলের তপশিলি মোর্চার সম্পাদক এবং ২৭ নম্বরের বুথ সভাপতি করা হয়েছে। এরকম অনেক ব্যক্তিকেই একাধিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে ওই নেতা জানান।

একই অবস্থা উত্তর দমদম তিন নম্বর মণ্ডলের। সেখানে মণ্ডল কমিটির সম্পাদক রামু রায়, তাঁর স্ত্রী পায়েল রায় মণ্ডলের যুব সম্পাদক হয়েছেন। এই মণ্ডলের তপশিলি মোর্চার সভাপতি গীতা সাহা, তাঁর ভাই লক্ষ্মীনারায়ণ সাহা ওই মোর্চার সহ–সভাপতি। অভিজিৎ চৌধুরী এই মন্ডলের সহ-সভাপতি এবং তার স্ত্রী জয়া চৌধুরী এই মন্ডলের মহিলা মোর্চার সম্পাদিকা।

এব্যাপারে বিজেপির জেলা সভাপতি কিশোর করের বক্তব্য, কয়েকটি জায়গায় এক পরিবারের কয়েকজন সদস্য কমিটিতে এসেছেন। নির্বাচনের জন্য তাড়াতাড়ি কমিটি করতে হয়েছে। আর দলের এই পদগুলি সবই ক্ষনিকের। বিকল্প পেলে তখন দেখা যাবে। দলে নীচুতলায় একসঙ্গে এই পদগুলিতে এক পরিবারের একাধিক সদস্য বসলে আপত্তি কোথায়? এব্যাপারে দলের ভিতর থেকে পরিবারতন্ত্রের যে অভিযোগ উঠেছে সে সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য, এক পরিবার থেকে ৪ বা ৫ জন বিধায়ক হলে তখন পরিবারতন্ত্র বলা চলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *