সাথী প্রামানিক, পুরুলিয়া, ১ মার্চ: সিধো কানহো বিরসা বিশ্ববিদ্যালয় এবার ডিলিট সন্মান দিচ্ছে পুরুলিয়ার নাচনি শিল্পী পস্তুবালাদেবীকে। ৪ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এই সন্মান তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হবে।
পুরুলিয়ায় বহু নাচনী শিল্পী রয়েছেন। বেশিরভাগ নাচনী শিল্পী কোনও কাজ পাননি। যারা পেয়েছিলেন তারাও পারিশ্রমিক পেয়েছেন নামমাত্র। নাচনীনাচ পুরুলিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকশিল্প। এই শিল্পে মহিলা নাচনী শিল্পীরাই সব। বিশেষ এই নাচে নিতে হয় তালিম। আয়ত্ব করতে হয় তাল লয় ছন্দ সব কিছু। তবু সেই কদর আর নেই তাদের। পুরুলিয়ায় নাচনীদের সংগঠনের সম্পাদিকা পস্তুবালাদেবী জানালেন, বাস্তবে এখন পুরোপুরি সরকারী সাহায্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে গেছেন তাঁরা। আধুনিক সভ্যতা বিনোদনের সংজ্ঞাই বদলে দিয়েছে। ইন্টারনেট আর অ্যাণ্ড্রয়েডে মজে আছে মানুষ। প্রবল পুরুষালী ছৌনাচ এখনও তার মধ্যে দর্শকদের আকর্ষণ করতে পারলেও নাচনীদের কদর চলে গেছে। বহু কষ্ট করে নাচের বিভিন্ন মুদ্রা ও ঝুমুর গান শিখলেও তার মর্যাদা পাওয়া যাচ্ছে না। চরম আর্থিক সমস্যার মধ্যে দিন কাটছে নাচনী শিল্পীদের। এই কারণে এই পেশায় আর কেউ আসতেও চাইছেন না।
নাচনীদের বর্তমান অবস্থার কথা বলতে গিয়ে পস্তুবালা দেবী বলেন, বাস্তবে শিল্পী হলেও সামাজিক জীবনে কোনও সম্মান এই মহিলা শিল্পীরা পান না। যৌবন চলে গেলে অবস্থা হয় করুণ থেকে আরও করুণ। তখন দু’বেলা পেটের ভাত পর্যন্ত ভালো ভাবে জোটে না তাদের। পুরুলিয়ার নাচনীদের বর্তমান অবস্থা যে কি তার সব থেকে বড় উদাহরন তিনি নিজে বলে জানান পস্তুবালাদেবী।
পুরুলিয়া শহরের এক প্রান্তে শুরুলিয়ায় ডিয়ার পার্কের সামনে এক টুকরো জমিতে দুর্বার সমিতির স্থাপন করেছে নাচনী রিসার্চ সেন্টার। সেখানেই একটি ঘরে থাকেন এই পস্তুবালা। পেটের ভাত জোটাতে তিনি নিজে খুদ যোগাড় করেন। তাঁর আশ্রয় স্থলের পাশে রয়েছে একটি চাল কল। সেখান থেকে কুড়ো এক জায়গায় ফেলে দেওয়া হয়। সেই কুড়ো থেকে খুদ বেছে তিনি রান্না করে খান। নিজেদের পরিস্থিতির কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন ২০০৭ সালে এই পেশায় যুক্ত শিল্পীদের স্বীকৃতি দিয়েছে রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার। তবে আর্থিক অবস্থা এখনও রয়ে গেছে তেমনই করুণ। যে সামান্য কয়েক জন নাচনী সরকারী পরিচয়পত্র পেয়েছেন তারা নামমাত্র ভাতা পান। মাসিক হাজার টাকার এই ভাতাও জোটে ন’মাসে ছ’মাসে। সরকারী নীতি অনুযায়ী বিভিন্ন সরকারী অনুষ্ঠানে লোক শিল্পীরা ডাক পান। এজন্য পারিশ্রমিকও পান তাঁরা। কিন্তু অদ্ভুতভাবে নাচনীরা এসব অনুষ্ঠানে বেশীরভাগ সময় থেকে যান ব্রাত্য।
পুরুলিয়া জেলায় বিগত যৌবনা নাচনীর সংখ্যা বর্তমানে প্রায় দুশো। এদের ৯০ শতাংশই কোনও সরকারী পরিচয় পত্র পাননি। সীমাহীন দারিদ্র থাকলেও ইন্দিরা আবাস বা অন্ত্যোদয় যোজনা কোনও কিছুই জোটেনি তাদের। এই পরিস্থিতিতেই বলতে গেলে না খেয়ে মারা গেছেন এককালের প্রখ্যাত নাচনী হাজারীদেবী। শেষ জীবনে মানবাজারের হাটে ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবনধারণ করেছিলেন তিনি। মাগুড়িয়ার কাললা দেবী, কোটলইয়ের মীরাদেবী গান গেয়ে ভিক্ষা করে দিন যাপন করছেন। আড়ষার সিরকাবাদ গ্রামে বয়সের ভারে মৃত্যুর দিন গুনছেন শুকুরমনি সর্দার। বাকিরা কোনওমতে জীবন ধারন করছেন আত্মীয় স্বজনদের দাক্ষিণ্যে।
সামাজিক দিক থেকেও খুব একটা উন্নতি হয়নি তাদের। আগে কোনও নাচনী মারা গেলে তার দেহ দড়ি দিয়ে বেঁধে টেনে নিয়ে গিয়ে ভাগাড়ে ফেলে দেওয়া হত। এখন অবশ্য তা করা হয় না। তবু এখনও অনেক অসম্মান বহন করতে হয় তাঁদের। নাচনীদের পুরুষশিল্পী বা রসিকের সাথে থাকতে হয়। এটাই হয়ে আসছে। একসাথে থাকলেও স্ত্রীর মর্যাদা তারা পান না। এমনকী নাচনীদের সন্তানরাও পায় না পিতৃ পরিচয়। এসব নিয়ে জনমত গড়ার সাথে সাথে সরকারী পদক্ষেপ করাও জরুরী বলে মনে করেন পস্তুবালা দেবী। জগজ্জননী দশভুজা মর্তে এসে সব সন্তানের মুখে হাসি ফোটালেও এবারও শুধু কান্নাই ঝরে পড়েছে পুরুলিয়ার নাচনীদের নয়নে। আগামী বছর যেন তাদের দুর্দশা মুক্তি হয়ে সে প্রত্যাশা নিয়েই এখন ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছেন পুরুলিয়ার নাচনীরা।