রাজ্য সংগীত বিতর্ক! রবীন্দ্রনাথের গানের কথা বদলানোয় প্রবল প্রতিবাদ নেটমাধ্যমে

অশোক সেনগুপ্ত
আমাদের ভারত, কলকাতা, ৮ ডিসেম্বর: রবীন্দ্রনাথের গানের কথা বদলিয়ে তা প্রকাশ্য পরিবেশন করা নিয়ে বিতর্কে নেটনাগরিকদের একাংশ সরব হয়েছেন।

গত অগাস্ট মাসে এক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় ঘোষণাই করে ফেলেছিলেন যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটিকেই রাজ্য সংগীত হিসাবে গাওয়া হবে। কিন্তু তা নিয়েও শেষ পর্যন্ত সহমত হতে পারেননি বৈঠকে উপস্থিত বিশিষ্ট জনরা। মুখ্যমন্ত্রী চেয়েছিলেন, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটির কয়েকটি শব্দ বদলাতে। গানটির ভেতরে কয়েক জায়গায় ‘বাঙালি’ শব্দ আছে।
(বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা–

সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক হে ভগবান ॥

বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন–

এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান ॥)

সেই ‘বাঙালি’ শব্দের বদলে ‘বাংলা’ শব্দের প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই প্রস্তাব নিয়ে শেষ পর্যন্ত সহমতে পৌঁছন যায়নি। তাই এই বিষয়টি পিছিয়ে যায়।

মঙ্গলবার কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী আসরে রবীন্দ্রনাথের ঐতিহাসিক গানের কথা পাল্টে ফেলা নিয়ে এখন সমাজমাধ্যমে ক্ষোভের আবহ। রবীন্দ্রগানের বাণী পাল্টে ফেলা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফেসবুক পেজেও কেউ কেউ প্রতিবাদ করছেন। সে দিন তারকাখচিত অনুষ্ঠানের সময়ে অনেকেই গান-বিভ্রাটের দিকটি প্রথমে খেয়াল করেননি। পরে সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিয়োয় গানটির কথা-বদল শুনে সরব হয়েছেন। রবীন্দ্রগানের কথা কেন পাল্টানো হল? উৎসবের মঞ্চে অন্যতম গায়ক তথা মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেনকে ফোন করা এবং মেসেজ পাঠানো হলেও সাড়া মেলেনি।

বিশিষ্ট ভাষাবিদ ও প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক পবিত্র সরকার শুক্রবার সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, ”মনের মধ্যে এই কথাটাই ঘুরে ফিরে আসছে, রবীন্দ্রনাথের গানের কথা বদলে গাওয়া হয়েছে। তাই একটি লিমেরিক–

তুমি বাঙালি
তুমি যে বাঙালি খুব সুখে আছ, মুখে নিয়ে পান-জর্দা ;
মাথা নীচু করে, হাঁটু গেড়ে বসে প্রসাদে তৃপ্ত, বড়দা !
এদিকে তোমার রবীন্দ্রনাথ
আনাড়ির হাতে হন চিতপাত,
গানের কথাকে বদলে দিচ্ছে, সয়ে যাবে এই স্পর্ধা?“

রবীন্দ্রগানের এই বিকৃতিতে সংস্কৃতি জগৎ বা সারস্বত সমাজের বিশিষ্টরাও হতাশ। প্রবীণ অধ্যাপক তথা অর্থনীতিবিদ সৌরীন ভট্টাচার্য বলছেন, “গানের কথা পাল্টালে তো তা রবীন্দ্রনাথের গান থাকে না!” এই রাজ্য সঙ্গীতের সাংবিধানিক গুরুত্ব বা অস্তিত্ব নিয়ে তাঁর প্রশ্ন রয়েছে। আর প্রবীণ নাট্যব্যক্তিত্ব রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত সব শুনে বলছেন, “কিছু বলার নেই! যা হচ্ছে তাতে রবীন্দ্রনাথের কিছু আসে যায় না, সরকারের কারও কিছু আসে যায় না, মনে হয় কারওরই কিছু আসে যায় না!”

অর্থনীতির অধ্যাপিকা মহালয়া চট্টোপাধ্যায় শুক্রবার সামাজিক মাধ্যমে বড় হরফে লিখেছেন, ”নজরুলের সুরবিকৃতি আর রবীন্দ্রনাথের গানের কথার বদল সমান মাপের অপরাধ।”

গায়িকা-মনস্তত্ববিদ ইন্দিরা মুখার্জি বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ”এখন বাঙালিদের মধ্যে কি একজনও নেই একটা ভালো দেখে গান লিখে দিতে পারেন? এত দেউলিয়া হয়ে গেছি আমরা? একটা “মনের মত” গান লিখে ফেললেই তো হত। ফরমায়েসি। যেখানে যেমন আবদার মত শব্দ জুড়ে দেওয়া যেত। বাদাম কাকুকে বললেও লিখে দিতে পারতো। তা নয়, সেই রবীন্দ্রনাথকে ধরে টানাটানি। সেই বস্তাপচা কটা গান নিয়ে জাবর কাটা। কোনও মানে হয়? কোন যুগের সব লেখা, আজকের যুগে এর কথা সুর কোনোটাই ঠিক যুৎসই নয়। রবীন্দ্রনাথের গান ব্যান করে দেওয়া খুব দরকার। কাউকে গাইতে হবে না। কোনও দরকার নেই অমন বিচ্ছিরি জিনিসের। একটা কথাও যিনি ঠিকঠাক লিখে উঠতে পারেননি। সুরের কথা তো বলাই বাহুল্য। খালি শুধরোতে হচ্ছে পন্ডিতদের। কী কাজ বেড়েছে পন্ডিতদের এই ভুলে ভরা লোকটার জন্যে।

রহমানকে কত কথা বলা হল, কত অপমান করা হল। তিনি তো বাঙালি নন। আর কাউকে লাগবেও না।
বাঙালিদের ধ্বংস করতে বাঙালিই যথেষ্ট।”

এর প্রতিক্রিয়ায় বহু মন্তব্য এসেছে। গায়িকা মধুমিতা বসুঠাকুর লিখেছেন, ”একদম ঠিক বলেছ। ছোট বড় কেউ বাদ নেই। বুড়োটাকে ছাড়া একপা’ও যে চলতে পারবে না সেটা শুধু স্বীকার করতেই কষ্ট।” অশোক ঘোষাল লিখেছেন, ”এতো চিন্তার কোনও কারণ নেই, আমরা প্রায় শেষ করে এনেছি, পুরোটাই নিমজ্জিত, শুধু মাস্তুলের ওপরের সামান্য অংশটুকু নজরে আসছে, আর দু একটা ক্যালেন্ডার ছিঁড়ে ফেলা হলে, আর কোনো অংশও ভেসে থাকবে না,… আর সামান্য সময়ের অপেক্ষা মাত্র….।”

রবীন্দ্রনাথের গানের কথা বদলানোর যুক্তি হিসাবে গত ২৩ আগস্ট নবান্নের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘বাংলায় বিভিন্ন জাতি উপজাতি, ধর্মের মানুষ বাস করেন, তাই আজকে তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো বাঙালির পরিবর্তে বাংলা শব্দটি ব্যবহার করতেন। তাহলে সকল ধর্ম, ভাষার মানুষকে আমরা একছাতার তলায় নিয়ে আসতে পারবব। এটুকু কি আমরা অ্যাডজাস্ট করতে পারি?’

এই মন্তব্য সমর্থন করে তৃণমূলের রাজ্য মুখপাত্র কুণাল ঘোষ দাবি করেন, “এই বিষয়ে রবিঠাকুরের নিজস্ব একটি মতামত রয়েছে। সে সময তাঁর একটি গানের লাইন সিনেমায় পরিবর্তন করা নিয়ে বহু সমালোচনা হয়। যে প্রসঙ্গে কবিগুরু বলেছিলেন, শব্দটি বদলে যদি প্রাসঙ্গিকতা ঠিক থাকে এবং তা আরও বেশি লোকের কাছে পৌঁছয় তাহলে সেটা করা যেতেই পারে।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *