কল্যাণ চক্রবর্তী
আমাদের ভারত, ১৩ জানুয়ারি: গ্রামীণ জীবনে ধানই ছিল ধন, তাই মানুষের মনোভূমে ধান্যলক্ষ্মীর আবির্ভাব। আর মান্যতা পেত গো-ধন–
“ধান ধন বড় ধন আর ধন গাই।
সোনারূপা কিছু কিছু আর সব ছাই।”
এই ধান্যসম্পদের প্রতি, গো-সম্পদের প্রতি গ্রামীণ ভারতের চিরকালীন কামনা; তাকে গোলায় গোলায় পূর্ণরূপে ভরার সনির্বন্ধ আকুতি, নিজের সন্তানকে দুধে ভাতে রাখার এক অসামান্য মিনতি — “গোরু জরাধান/রাখো বিদ্যমান।” বাঙ্গালীর যখন গোলায় গোলায় ধান, তখনই গলায় গলায় গান। অন্তরের কথা যেন কথাসাহিত্য হয়ে বের হয়ে আসে আলগোছে “যার আছে গোলায় ধান/তার আছে কথার টান।” পৌষ পার্বণ ও আনুপূর্বিক কৃষি-সাংস্কৃতিক কৃত্য হচ্ছে ধান কেন্দ্রিক অখণ্ড কৃষির পরিপূর্ণ রূপ; ধান্যলক্ষ্মীর অনাবিল উপাসনা। এ হল শালীধানের পৌষালি কৃত্য; হৈমন্তিক ধানের বাস্তবিক সত্য, আমনের ধান চাল হয়ে বেরিয়েছে — এ সেই ব্রীহি ধানের সাংস্কৃতিক চালচিত্র।
পৌষ-সংক্রান্তিতে পূজিতা হন পৌষলক্ষ্মী; কোথাও পৌষ-পার্বণের নাম-ই ‘নবান্ন’ — “প্রথম অগ্রহায়ণ মাসে নয়া হেউতি ধান।/কেউ কাটে কেউ ঝাড়ে কেহ করে নবান।” শাস্ত্রীয় ও লৌকিক আচার মিলেমিশে একাকার। উৎসবের নাম যাই হোক, তা আদতে ধান্যোৎসব, যার ভরকেন্দ্র জুড়ে আছে নানান শালীধানের স্তূপ — “পাকে ধান্য নানা জাতি/কতো হীরা লীলামতি।” দেবীর আবরণ ও আভরণ হয়ে ওঠে নানান ধান-বৈচিত্র্য; কোনোটি দেবীর আলতা, কোনটি পাসুলি, কোনটি আবার গলার সাতনরী হার; চুলের সৌকর্য, সিঁথির অলঙ্কার আর পায়ের নূপুর —
“পারিজাত ধান্যের পরিলা বক্ষহার।
ঊরুর উপরে পরেন বড় শোভা তার।।
সূর্যভোগ চন্দ্রমণি কোমরে পরিল।
নয়ানে অঞ্জন লক্ষ্মীকাজল করিল।।
মুক্তাশাল সিঁথায় সিন্দুর শোভা পায়।
করবী আঁটিল ধান্য কামিনীজটায়।”
বাঙ্গলার মনীষা ভেবেছে, ধান প্রকৃতির দান, ঈশ্বরের কৃপা, সে তো কারও ব্যক্তি সম্পদ নয়! ধানের উৎপাদন-বন্যা যেন ভগবতীর বাৎসল্য ধারা; সে করুণাধারা ধান্যসম্পদ হয়ে আমাদের গোলায় অধিষ্ঠান করে, উদর পরিতৃপ্ত করে। তাই ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় লিখছেন, নবান্নের অন্ন আমরা একা গ্রহণ করি না। আত্মীয়স্বজনকে দিই, পাড়া-প্রতিবেশীকে বিলাই, গ্রামের সকলকে সাধিয়া বিতরণ করি, পশু-পক্ষী, কীট-পতঙ্গ সকলকে অর্পণ করি। কেন?… আমার যে ক্ষুধা, তাহা যে বিশ্বেরও ক্ষুধা.. । তিনি লিখছেন, লক্ষ্মীকে লক্ষ্মীরূপেই বরণ করিতে হয়, আর যাঁহার করুণা ধান্যের স্বর্ণাবরণের অন্তরালে শস্যরূপে প্রাণপদ, তাঁহারও পূজা করিতে হয়। তবে ইহার মহিমা থাকে। এই জন্যই বুঝি নবান্ন ও পৌষ সংক্রান্তিতে ধান্যলক্ষ্মীর পুজো আর পাল-পার্বণ। আর এজন্য পৌষ কৃষকের উৎসব।
কৃষিজীবী মানুষ পৌষ সংক্রান্তির পূর্বদিবসে পালন করে ‘আউড়ি-বাউড়ি’-র লোকাচার। সে যেন দেবী লক্ষ্মীর মর্ত্য-জীবনচক্র; ইকোসিস্টেমের জলচক্র আর সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ার গ্রামীণ-সংবিৎ। সিন্ধু-সাগরে দেবী লক্ষ্মীর আবাসন, সাগরের জল উবে ধোয়াডানা মেলে মেঘ হয়ে যান দেবী, মেঘে ভরকরে দেবীর উড্ডীন রাঢ়বঙ্গের নীলাকাশে; বর্ষার মেঘমালা বর্ষণ হয়ে জন্ম নেয় মাটির কৈশিক জল আর তারই কাদামাটিতে লালিতপালিত হন ধান্যলক্ষ্মী, কৃষকের সবুজ ক্ষেত্রে। অবশেষে সবুজ হিন্দোল রূপান্তরের পথে হয়ে ওঠে সোনালি ফসল; কৃষকের কাস্তেতে চয়িত হয়ে দেবী গো-যানে চেপে আবির্ভূত হন কৃষকের গৃহে। এটাই হল ‘আউনি’ বা আগমন, কথ্য ভাষায় ‘আউড়ি’। তারপর দেবী সস্নেহে চেয়ে দেখেন বাংলার ঘর-গেরোস্থালী, বুভুক্ষু মানুষের উদরের জঠরের জ্বালা। এটাকেই বলা হয় ‘চাউনি’, বা চেয়ে দেখা, লোকভাষায় ‘চাউড়ি’। তারপর গৃহলক্ষ্মী-বধূর পরম আহ্বানে চঞ্চলা লক্ষ্মী বাঁধা পড়েন গৃহের আনাচে কানাচে, গোলাঘরে, বাক্স-তোরঙের ডালায়, রান্নঘরে, নানান গৃহ-তৈজসে — গোবরের সঙ্গে মুঠকাটা খড় পাকিয়ে অচ্ছেদ্য বন্ধনে দেবীকে অচলা করার মেয়েলি আচার পালিত হয়। এরই নাম ‘বাউনি’ বা বন্ধন, লোকভাষায় ‘বাউরি’। এ তিন লোকসাংস্কৃতিক কৃত্য মিলিয়ে ‘আউড়ি-বাউরি’ লোকাচার। রাঢ়-বাংলায় তার নানান অধিরূপ।
বাঙ্গলার কৃষিক্ষেত্রে ধান-সম্পৃক্তিতে নানান সময়ে লক্ষ্মী উপাসনার যে বহুতর ধারা পরিলক্ষিত হয়, তার অন্তিম পর্ব হল পৌষ-পার্বণ। কখনো ধানের ক্ষেতে বৃষ্টি আনার মেয়েলি অনুষ্ঠান ভাঁজো; ভাদ্র-আশ্বিনে ইন্দ্র-দ্বাদশী তিথিতে বৃষ্টির দেবতা ইন্দ্রকে তুষ্ট করে নৃত্যগীত পরিবেশন; কখনো গর্ভিণী ধানের সাধ-ভক্ষণ অনুষ্ঠান নল-সংক্রান্তি, ধান ফুলের ছড়া আবৃত্তি; কখনো মুঠকাটা ধান নিয়ে জলের ঝারা ছিটিয়ে, শাঁখ বাজিয়ে, উলুধ্বনি দিয়ে গৃহকর্তার মাথায় চেপে দেবীর গৃহে আগমনবার্তা। আশ্বিন সংক্রান্তির ‘ধান ডাকা’-র সময় ধানের ডগা পোয়াতি মায়ের পেটের মতোই ফুলে ওঠে, এটি ধানের থোর দশা বা Booting stage, এটিই হল ‘ধানের গর্ভসঞ্চার’। কৃষিজীবী মানুষ এই সময় থেকেই পৌষ-পার্বণের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। ধানক্ষেতে নলপুজো করে নল-খাগড়ার প্রভূত প্রজনন ক্ষমতাকে ধান-ফসলে সঞ্চারিত করতে চায়, ফলাতে চায় প্রচুর ধান; এ এক অনুকরণাত্মক যাদু বিশ্বাস। সশিষ নলগাছ কেটে নানান বনৌষধি ও অন্যান্য সামগ্রী বোয়াল পাতায় মুড়ে রাঢ়বঙ্গে ধানজমিতে নলগাছের পাতায় বাঁধা হয়; থাকে বুনো ওল, কেশুতের শেকড়, রাই সরষে, হলুদ, নিম, শুকতো পাতা, চালের ক্ষুদ। নলের গোড়া ধুয়ে শালুক ফুলে জড়িয়ে ধানক্ষেতে নল পুজো করেন কৃষক।
কার্তিক সংক্রান্তিতে উত্তরবঙ্গ ও সন্নিহিত বাংলাদেশে শস্যদেবতা কার্তিককে পুজো করা হয়, কাটোয়া মহকুমায় তিনিই (নবানে কার্তিক) পূজিত হন নবান্ন-এর উৎসবে। কার্তিক সংক্রান্তিতে গাওয়া হয় ফসল-সুরক্ষার গান — “কাল না ছেলেটায় ডাক দিয়া কইয়া যায়/
বাবুই পড়িছে খেতে/
আরে রে বাবুইরে/
খেতের পাকে ধান না খাইলে।”
কার্তিক থেকে অঘ্রান সংক্রান্তি পর্যন্ত হৈমন্তি ধান মাড়াই ও ঝাড়াই-এর শুভপর্বে উৎযাপিত হয় ইতুলক্ষ্মী ব্রত। সূর্য দেবতা কখন যে লৌকিক বিবর্তনে হয়ে উঠেছেন ধানকেন্দ্রিক শস্য দেবতা ইতুলক্ষ্মী, তার ইতিহাস অধরাই থেকে যায়। রবিবার ইতুর সাপ্তাহিক পুজো; এরই মধ্যে উৎযাপিত হয় নবান্ন; ইতু উৎযাপনের একেবারে শেষ পর্বে নিবেদিত হয় নতুন চালের পিঠে, মুঠপিঠে আর পরমান্ন; আর বাংলার কোথাও কোথাও এরই নাম ‘সাধ’।
নবান্নের পূর্বে পাকাধানের আড়াই মুঠ কেটে, বাড়িতে এনে অনুষ্ঠিত হয় লক্ষ্মীপুজো। তারপর নবান্নে লঘু চাল থেকে প্রস্তুত হয় নানান পিঠেপুলি; তা থরে থরে সাজিয়ে দেওয়া হয় দেবভোগ আর পিতৃভোগের জন্য। ধান্যলক্ষ্মী ঘরে এসেছে যে! গৃহাঙ্গন লেপে-পুছে আলপনার নান্দনিকতায় শিল্প-মুখর; ভরা মরাই-এর পাশে তার নানান চিহ্ন-সংকেত; কৃষিজীবী মানুষের কামনার ভাষা নন্দনতত্ত্ব হয়ে দেখা দেয়। তাতে ধানের ছড়া আঁকা, লক্ষ্মীর জু-মর্ফিক ফর্ম প্যাঁচাই-লক্ষ্মীর চিত্র, পদ্মাসন, গো-সম্পদের রূপক-সংকেত, দালান কোঠার সরল অবয়ব, গৃহস্থালি নানান সামগ্রীর চালচিত্র পিটুলির টানে প্রকাশিত। অবশেষে এসে যায় পৌষ সংক্রান্তি;
সূর্য ধনু রাশি থেকে মকরে সঞ্চারিত হন, তাই এর নাম ‘মকর সংক্রান্তি’; এই দিন থেকেই সূর্য দেবতার উত্তরায়ণ যাত্রা, তাই এর নাম ‘উত্তরায়ণ সংক্রান্তি’। বাঙ্গলায় এটি ‘পিঠেপরব’ আর বসতভিটায় বাস্তুপূজার দিন। পৌষপার্বণের দিন কিংবা তার পূর্বদিনে তুলসীমণ্ডপে অনুষ্ঠিত হয় এই পূজা। কোথাও ‘ঝিকা’ গাছের ডাল কেটে এনে তার তলায় পুজো হয়, মাটির হাঁড়িতে পাটশলমির আগুনে দুধ-চাল-বাতাসা ফুটিয়ে ‘চরু’ রেঁধে বাস্তুদেবতার ভোগ তৈরি করেন পুরোহিত। পৌষ-পার্বণের দিন উঠোনে মড়াই-এর পাশে পূজিতা হন পৌষলক্ষ্মী।
পৌষমাসের শেষ সপ্তাহব্যাপী গ্রাম-বাঙ্গালায় পিঠেপুলির সমারোহ। নতুন চালের গুঁড়ি বা ‘সবেদা’ (সবেদা ফলের শাঁস জিভে যেমন দানাময় অনুভূতি আনে, চালের গুঁড়িও সেই গ্রোথনে ভাঙ্গা হয়, তারই অনুষঙ্গে এই নাম), খেজুরগুড়, নারকেল কোড়া, কলাই ডালের মণ্ড, মুগডাল সিদ্ধ, ক্ষীর ইত্যাদি দিয়ে প্রস্তুত হয় নানান সুস্বাদু খাবার। পৌষপার্বণের দিন তার এলাহি সমারোহ — চন্দ্রপুলি, মোহনবাঁশি, ক্ষীরমুরালী, চন্দনপাটা; তৈরি হয় সেদ্ধ পিঠে, ভাজা পিঠে, সরুচাকলি; নানান বৈচিত্র্যের চিতোই পিঠে, গোকুল পিঠে, পাটিসাপটা, পাকান, ভাপা, কুলশি পিঠে, কাটা পিঠে, চাপড়ি, চুটকি, নকশি, হাঁড়ি পিঠে, ঝুড়ি পিঠে, পাতা পিঠে, তেজপাতা পিঠে, পোয়াপিঠে, ফুলঝুরি পিঠে, খেজুরপিঠে, চুষিপিঠে ইত্যাদি। বাংলার কোনো বনবাসী কৌমসমাজে তৈরি হয় মাংসপিঠে আর সব্জি পিঠে।
পৌষপার্বণের দিন বাঙ্গলার উঠোন-এগনা এক আশ্চর্য নান্দনিকতায় ভরে ওঠে; গোবরজলে নিকোনো গোটা উঠোন জুড়ে আলপনার নানান সৌকর্য। ধানের ছড়া, লক্ষ্মীর পদচিহ্ন, দেবীর গয়না, চাষের উপকরণের চিত্র — গোরু, লাঙল, জোয়াল, মই আঁকা হয় পরম আনন্দে; পৌষ গাদা থেকে পুজোর সামিয়ানা, পুজোস্থল থেকে গৃহ-সিংহাসন — সর্বত্রই মা লক্ষ্মীর শুভ পদচিহ্ন আঁকা। পিটুলিগোলা পায়ে পা ফেলে ফেলে দেবী কৃষকের গৃহে আসবেন, হবেন অচলা। যেহেতু বাইরে পুজো করে গৃহে লক্ষ্মী আনার ব্যবস্থা তাই কোথাও এর নাম ‘বাহির লক্ষ্মীপূজা’। লক্ষ্মী পূজিত হবার পর রাতে যখন তাঁর বাহন পেঁচা বা শেয়াল (দক্ষিণ দামোদর অঞ্চলের বিশ্বাস) ডেকে ওঠে তখন গৃহকর্ত্রী লক্ষ্মী তুলে ঘরে আনেন তাঁকে। বাঙ্গলার কোনো কোনো অঞ্চলে পৌষপার্বণের সমাপ্তি অনুষ্ঠান হল ‘পৌষ-আগলানো’। বাঙ্গালি রমণী পৌষ বন্দনা করে গেয়ে ওঠে,
“এসো পৌষ যেও না
জন্মে জন্মে ছেড়ো না।
পৌষের মাথায় সোনার বিঁড়ি,
হাতে নড়ি কাঁকে ঝুড়ি,
পৌষ আসছে গুড়ি।
আনবো গাঙের জল
ঘরে বসে নেয়ো খেয়ো।
বাহান্ন পেটটি হয়ো
ঘরে বসে পিটে খেয়ো।
এমন সোনার পৌষ জন্ম জন্ম হয়ো।”
কোথাও বানানো হয় ‘পৌষবুড়ি’-র গোবরমূর্তি। সোনার পৌষকে ছাড়া যাবে না, তাকে বাঁধতে হবে, শস্য-সম্পদের শ্রীবৃদ্ধি কামনা করতে হবে। বাঙ্গলার নারী তাই ঘরের আঙিনায় সোহাগি পৌষকে নানান মৌখিক সাহিত্যের ঝাঁপি নিয়ে আগলায়। বাঙ্গলার গ্রামে গ্রামে পৌষমাসের শুক্লপক্ষের বৃহস্পতিবার পৌষলক্ষ্মীর পুজো অনুষ্ঠিত হয়। এ দেবীর অ্যানথ্রোপোমর্ফিক প্রতিমাপূজা নয়, নতুন ফসলের নৈবেদ্যে, নতুন ধানের অলঙ্কার নির্মাণ করে, নতুন চালের গুঁড়িতে প্রস্তুত লক্ষ্মীদেবীর পদচিহ্ন এঁকে দেবীর আরাধনা — শস্যদেবীর বোটানিক্যাল ফর্ম যা ‘কোজাগরী লক্ষ্মী’ থেকে দৃশ্যতই আলাদা। ধনের দেবীর তুলনায় ধানের দেবীর প্রকাশ মূর্ত হয়ে ওঠে, সমগ্র বাঙ্গলা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এক শস্যদেবীর ঐতিহ্য। পৌষপার্বণের অপরিহার্য আঙ্গিক তার অনুপম আলপনা। আলপনার ঠাট, রূপক সংকেত নিয়ে অনেক গবেষণাই হয়েছে। আলপনা যখন ‘the art of drawing ails (embankment)’ তখন তার কৃষি-সম্পৃক্ততা অবশ্য বিবেচিত। বর্তমানের আলপনায় যে জ্যামিতির প্রকাশ, তার সূত্রপাত হয়তো জমি তৈরি আর তা সমতল করে তোলার প্রাচীন প্রক্রিয়া থেকে। জোয়াল-বাহিত আদি লাঙ্গলের মৃত্তিকা খননে তৈরি হয়েছিল মাঠের আলপনা, তার দুপাশে বলদ-গরুর পদচিহ্ন, জমি কর্ষণে উঠে আসা পোকামাকড়ের লোভে ধেয়ে আসা পাখ-পাখালির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পদচিহ্ন, সর্বোপরি মাঠভর্তি পাকা ফসলের স্বতন্ত্র সমারোহ — সব মিলিয়ে মানুষের সহজাত নান্দনিকতায় গড়ে উঠেছে ব্রত-পূজার আলপনা, তাতে অনবধানে মিলেমিশে একাকার অন্তরে উদ্ভাসিত প্রকৃতির কৃষি-বাস্তুতন্ত্র। মানুষের মনে জারিত হয়ে আলপনা হয়ে ওঠে কৃষিজীবী মানুষের জাদুবিশ্বাস আর নান্দনিকতার মিলিত ফসল।
শুধু যে পৌষলক্ষ্মীর পুজোর স্থলেই আলপনা আঁকা হয়, তা নয়; আলপনা দেওয়া হয় সংরক্ষিত বীজধান রাখার মাটির কলসিতে এবং তার বেদীতে। আলপনা দেওয়া হয় পৌষ সংক্রান্তির পর দিনও; এদিন কোনো কোনো জায়গায় অনুষ্ঠিত হয় ‘যাত্রালক্ষ্মীর পুজো’। কোথাও এর নাম ‘বাউনি পুজো’। উঠোনের মাঝে কৃষিসরঞ্জাম রেখে চারপাশ জুড়ে আঁকা হয় আলপনা। যে সরঞ্জাম দিয়ে এ যাবৎ কৃষিকাজে সাফল্য এসেছে, আজ তারই ধন্যবাদাত্মক চিন্তন-পূজন; আজ সেগুলিরই কাদামাটি ধুয়ে পরিচ্ছন্ন করার দিন। এই আলপনা-বিলাসে কী না নেই! জোয়াল, লাঙল, নিড়ানি, কাচি, খুরপি, কাস্তে, কোদাল, শাবল, দা, কুড়ুল। কোথাও তার প্রতিরূপগুলিও সহজ সরল টানে আঁকা হয়; যেন গৃহের শিশু, বালক-বালিকাকে কৃষিযন্ত্রপাতির অবয়ব চেনানোর ও কার্যকারিতা বোঝানোর এক বার্ষিক মরশুম। ক্ষেতের ধান প্রথমে এসে কৃষকের খামারে ওঠে, তারপর মাড়াই-ঝাড়াই-এর পর যায় গোলায়। ধান-রক্ষিত খামারেও তাই মা লক্ষ্মীর অধিষ্ঠান। কৃষক-রমণী তাই খামারেও আঁকেন নানান আলপনা — লক্ষ্মীর পদচিহ্ন, পদ্মফুল।
যেদিন প্রথম ধান খামারে মাড়াই করা হবে, সেদিন খামার পুজো করার অনুষঙ্গেও মেহীখুঁটি, মুঠ-ধানের মুঠি, ধামাকুলো, দাওনদড়ি ও বলদের পাশে দেওয়া হয় ‘রেখা-আলপনা’। নবান্নের দিন কোনো কোনো জায়গায় চাল দিয়ে গুঁড়ি আলপনা দেওয়ার চল আছে। বাড়ির সদর দুয়ার থেকে লক্ষ্মীর আসন পর্যন্তও আঁকা হয় আলপনার নানান ঠাট। এছাড়া লক্ষ্মী-গোলাকে কেন্দ্র করে বিন্দু দিয়ে শুরু করে উপর্যুপরি ক্রম বর্ধমান বৃত্তাকার আলপনা, তাতে জুড়ে থাকে মই-এর নকশা। গোলার গায়েও আলপনা দেওয়া হয়। এছাড়া পৌষ-পার্বণ উপলক্ষে লক্ষ্মীব্রতের চালিতে আঁকা হয় প্যাঁচার ঠাট। মকর-স্নান আলস্য, নিদ্রা, তন্দ্রা, জড়তা-জড়িমা-তামসিকতার অবাধ্য-রিপুকে জয় করার সংগ্রাম। বাংলার কুমারীকূলও একসময় মাসব্যাপী মকরস্নান-ব্রত শুরু করতো; ঠাণ্ডার ভোরে দিদা-ঠাকুমার হাত ধরে পাঁচডুবি স্নান আর মকর-স্নানের ছড়ার আবৃত্তি —
“এক ডুবিতে আই-ঢাই।দুই ডুবিতে তারা পাই।।
তিন ডুবিতে মকরের স্নান।
চার ডুবিতে সূর্যের স্নান।
পাঁচ ডুবিতে গঙ্গাস্নান।”
দেশ জুড়েই মকর সংক্রান্তির দিন নদী বা সাগরে পুণ্যস্নান। প্রয়াগ, হরিদ্বার, গড় মুক্তেশ্বর, গঙ্গাসাগরে স্নান উপলক্ষে জমজমাট মেলা। প্রয়াগে পূর্ণ ও অর্ধকুম্ভের সূচনা আর তাতে দেশব্যাপী সাধুসন্তের পুণ্য-আগমন।
কৃষকের অন্নের ভাণ্ডার যখন পূর্ণ, গোলায় সম্বৎসরের রসদ যখন মজুত, তখনই আসে ‘পৌষপার্বণ’। কাজেই এ এক শান্তি আর সমৃদ্ধির উৎসব। ভারতবর্ষের নানান অঙ্গরাজ্যে তার বহুধা বিস্তৃতি। কোথাও এর নাম ‘পোঙ্গাল’, কোথাও ‘লোহরি’, কোথাও ‘ভোগালি বিহু’, আবার কোথাও ‘ইল্লুবিল্লা’। এরকমভাবে কোথাও এর নাম ‘খিচরি’, ‘উত্তরায়ণ’, ‘মাঘী’, ‘তিলগুল’, ‘সকরাত’ প্রভৃতি। তামিল জনগোষ্ঠী এই সময়েই (১৪ থেকে ১৭ ই জানুয়ারি) পালন করে ঐতিহ্যবাহী ফসলোত্তর ‘পোঙ্গাল’ উৎসব। অনুষ্ঠানকৃত্য অনেকটা নবান্নেরই মত। এই গ্রামীণ উৎসবে সালোকসংশ্লেষের দেবতা সূর্যের প্রতি জানানো হয় অপরিসীম কৃতজ্ঞতা, ফসল ও গবাদি পশুর প্রতি জ্ঞাপিত হয় অকুণ্ঠ ধন্যবাদ। কর্ণাটক প্রদেশে এই উৎসবেরই ভিন্ন নাম ‘ইল্লুবিল্লা’ এবং ‘মকর সংক্রমণা’। চারদিন ব্যাপী পোঙ্গালের চারটি ভিন্ন নাম — ভোগি পোঙ্গাল, সূর্য পোঙ্গাল, মাতু পোঙ্গাল এবং কানুম পোঙ্গাল। তামিল ও তেলেগুতে ‘পোঙ্গাল’ শব্দের অর্থ হল ‘হাঁড়িতে সেদ্ধ ভাত’; অতএব এ ভাতের-ই উৎসব। নতুন চালের ভাত খেয়ে নববর্ষ উৎযাপনের এক কৃষিকৃষ্টি। এদিন সেই চালের গুঁড়ো দিয়েই বানানো হয় ‘কোলম’ আর তা দিয়েই আঁকা হয় আলপনা। পরিধান করা হয় নববস্ত্র, বন ফায়ার করে পুড়িয়ে ফেলা হয় অপ্রয়োজনীয় জিনিস, হতে পারে তা ফসলের খড়-নাড়াও; তার ছাই দিয়ে কৃষিজমি উর্বরা হবে। এদিন বাড়ির প্রবেশদুয়ার সাজানো হয় কাটা আখগাছের কাণ্ড দিয়ে, তাই বাজার জুড়ে আখের ব্যাপক আমদানি। বাড়িতে তৈরি হয় তিল ও নারকেলের নানান ভোজ্যবস্তু।
তথ্যসূত্র : ১. মনাঞ্জলি বন্দ্যোপাধ্যায় ও কল্যাণ চক্রবর্তী (২০০৪) প্যাঁচাই লক্ষ্মী — ইঁদুর অলক্ষ্মী, লোকসংস্কৃতি গবেষণা, ১৭ (২):৩২৪-৩৩৫। ২. মনাঞ্জলি বন্দ্যোপাধ্যায় ও কল্যাণ চক্রবর্তী (২০০৪) আলপনার জৈববৈচিত্র্য, লোকসংস্কৃতি গবেষণা ১৮(১):৬৯-৭৫। ৩. লীনা চাকী -সম্পাদনা (২০১৫) বাংলার ধান ও ধান সংস্কৃতি, পুনশ্চ, কলকাতা। ৪. কল্যাণ চক্রবর্তী (২০১৮) সূর্যদেবতার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উৎসব মকর সংক্রান্তি।