কবি এবং বামপন্থী-কবি

কল্যাণ গৌতম

আমাদের ভারত, ২২ জানুয়ারি: বঙ্গদেশে এক-আধটু কবিতা লেখা জলবায়ুগত বৈশিষ্ট্য। যারা প্রবল কাব্য-বিরোধী তারাও আদতে কবি। পঞ্চাশ বছরের কবিতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় কবিতা মূলত ত্রিবিধ — প্রেমের কবিতা, সেকুলারি-কবিতা আর প্রকৃতি-প্রেমের কবিতা। ইদানীং দেশপ্রেমের কবিতা বাঙ্গলা কাব্যচর্চায় এক বিশেষ আঙ্গিক। এর বিস্তার অপ্রতিরোধ্য; সোশ্যাল মিডিয়া এর অতুল্য দুনিয়া। এক দশক আগেও বাঙ্গলার বুদ্ধিজীবী ছিল দ্বিবিধ — কবি এবং সেকুলার কবি।

সেকুলারি কবিতা আবার কী? সেকুলার কবিরা কাব্যে ছোটোগল্পের মত বিশেষ বৈশিষ্ট্য এনে দিয়েছিল, তাকে বলা যায় ‘সেকুলারি টুইস্ট’। ‘ধর্মনিরপেক্ষ-মোচড়’। অনেকটা ‘বাবরের প্রার্থনা’ কবিতার ধরনে মফস্বলি-সংস্করণ। বিগত কয়েক দশক জুড়ে বাঙ্গলার শহরে, মফস্বলে এবং অতি অবশ্যই মহানগরীতে যে বনফুলের মত পত্রিকা জন্মাতো আর আপনিই মরে যেত তার সিংহভাগ জুড়েই ছিল ‘সেকুলারি কবিতা’, তার শব্দচয়ন দেখলেই বুঝে যাবেন। নিজের ধর্মকে খাটো করা, অন্য ধর্মকে, তাদের সংস্কৃতিকে মহান করে দেখানো, মধ্যে মধ্যে বস্তুবাদী রসদের যোগান — তারপর থোড়-বড়ি-খাড়া, খাড়া-বড়ি-থোড় এবং কপি-পোস্তের তরকারি। ব্যাস, সেকুলারি কবিতা কমপ্লিট।

কারা পড়েন এই কবিতা? কবি নিজে, পত্রিকার বস্তুবাদী-সম্পাদক (কবিতার প্রুফ দেখার সময়) এবং জুলুমি-পাঠক (কবিতা পড়ার জন্যে কবি কর্তৃক পত্রিকাটি জোরজুলুম করে বেচা গো-বেচারি হিন্দু বাঙ্গালিটি)। আজকাল সেই পাঠক পাড়ার মোড়ে দাপিয়ে বেড়ানো রাজনৈতিক-কবিদের থেকে খানিক রেহাই পেয়েছেন। বাব্বা! সে কী বাঁচা!

বারাকপুর শিল্পাঞ্চল বরাবরই সেকুলার কবি-সাহিত্যিকেদের আবাসস্থল বলে খ্যাত। জলবায়ুও উত্তম। মানে জমা-জল, অপ্রবাহিত নদর্মায় উৎপাদিত মশা, দংশনের পূর্বে তার পক্ষান্দোলনের সুবাতাস — কবিকূলকে কবিতা রচনায় যথেষ্ট উৎসাহিত করত। প্রাক্তন খড়দাবাসী হয়ে আমারও কিছু কবিতা লিখতাম। কাগজ-পেন আর শ-খানেক মশার মৃতদেহ সাজাতে পারলেই একটি জম্পেশ কবিতা হয়ে উঠত। কিন্তু আমার সম্পাদক জুটতো না, কারণ কাব্যে যথেষ্ট ‘সেকুলারি ঘাটতি’-র অভাব ছিল। ফলে তা আর কবিতা হয়ে উঠতো না। ফলে তা ‘বিকোতো’-ও না। কবিতার খাতার পাতা অবশেষে আবাপত্রিকার পুরাতন কাগজের সঙ্গে ফেরিওয়ালার কাছে চলে যেত।

একবার আমার এক বাল্যবন্ধু সহসা চানাচুরের ঠোঙায় আমার এক কবিতা আবিষ্কার করে আমায় ফেরত দিয়ে গেল। ওটাই আমার কলেজ জীবনে লেখা একমাত্র রক্ষাপ্রাপ্ত পাণ্ডুলিপি। কি ছিল সেখানে? “কথার অতলে আর কথা/মানুষের কথা বুঝে ওঠা দায়, / মানুষের মনের কথা।/ মানুষের মনের কথা শুধু নরকের কীট থেকে ধার করে আনা।……”। বাব্বা! এখন ভাবি কী সাংঘাতিক কথা! বাম-যাপনের মানুষগুলোকে নিয়ে নয়ের দশকে কী হতাশাই না ছিল!

আসলে হতাশা ছিল কবিদের আচরণে। ওই কবিরা একটি কবিতাও কবিতা-পাঠের আসরে পড়তে ডাকেনি, লিখতেও বলেনি। কারণ ওতে বামপন্থার বারুদ ছিল না। না ছিল ভিয়েতনামী ভাত, না ছিল হাভানা-চুরুট, না ছিল চীনের চেয়ারম্যান না ইদ-মুবারক!

বেশ তো! প্রেমের কবিতাও তো লিখতাম! এক দুটো তো ছাপতে পারতো! ছাপলো না। কারণ? এ আবার প্রেমের কবিতা কী? “সুহাসের সাথে বোলো না তুমি কথা/সুহাসের সাথে/ অতৃপ্ত মনের সাধ মেটাবে সে একরাতে।” বলে কী! বাম নয়, লাল নয়, প্রেমের কবিতা! পার্টি-ঘনিষ্ঠ না হলে কীসের প্রেম! আর কোথাকার কোন হরিদাস প্রেমিক! তো সেইসব কবিরা, ছড়াকাররা যথা নিয়মে বামাবলী উল্টেপাল্টে, গায়ে সবজে লেপ্টে আজও কবিতা-যাপন করে চলেছে সেকুলার মুক্তমঞ্চ দখল করে।

সেকুলারি কবিতা লিখিয়েরা এখন গেরুয়া রঙ আলতো করে মাখতে চায়! কিন্তু চোখ-কান-নাক নানান রন্ধ্রগুলিকে সজাগ রাখে। আমার সঙ্গে ইদানিং আবার আলাপ হল তাদের। সেই কবি-সম্রাট, সেই স্বঘোষিত ছড়াকার, সেই বুদ্ধিজীবীর দল! বললো, কবিতা আজকাল কেউ পড়ে না তেমন, বুঝলে! এবার গা-গর্মি দেশাত্মবোধক কবিতা লিখতে হবে। বললাম, কেন? বললো, কারণ রামনবমী বাড়ছে। তাই দিলুম তাদের দেশের মাটিতে এড করে।

বুদ্ধিখরচ করে হিন্দু হিন্দু কবিতা লেখে, ধমক খেলে তাতে আরবী খেজুরের রস ঢেলে দেয়। আমি হেসে কুল পাইনে। সে এক ধরণের কবিতা বটে — কি যে তার অর্থ জানি না। বললো, দিয়েছি কষে হিন্দুয়ানি! বললাম, কে বললো তোমায় হিন্দুত্ব করতে? এর চেয়ে হিন্দু-বিরোধী কবিতাগুলো তো তবুও ভালো! লিকার চা দিয়ে বেশ খাওয়া যায়, বরং ওসবই লেখো। কথা শুনে খুব গোঁসা হল কবিয়ালদের। আমাকে বেশ কয়েকটি সাহিত্য সভায় ডেকে নিয়ে, আড়াই তিন ঘন্টা বসিয়ে, একটা সিঙ্গারা খাইয়ে কোনোদিন কবিতা পড়তে ডাকতো, কোনোদিন সে সৌজন্যও থাকতো না। কিন্তু আমি বসে থাকতাম। কবিদের সেকুলারি কবিতার ভোল-বদল দেখতে। আয়োজকরা চায় বাম-মশলা, চুরমুর।

এখন কবি কোনটা ছেড়ে কোনটা পড়ে! আমিও উপস্থিত। একটু গেরুয়া গেরুয়া কালার না হলেও তো চলে না। আবার ধমকেরও ভয়। কবি-সম্রাট, কবি-বাহাদুর পদবীটা না চলে যায়! আমি তাদের বলি, আহা, একটু রোসো। জিরেন-রসটুকু পান করেই জাতীয়তাবাদী হওয়া চলে, চিটেগুড় নয়। তারপর পকেট থেকে স্বরচিত কবিতাখান পড়ে চলে আসি। সে কবিতার নাম ‘আরবী-খেজুর’, ‘দাড়িভিটের দাঁড়ি’, ‘একুশে নয়, বিষের বিশ’, কিংবা ‘কালাচ-সাপ’। কবিতা পাঠের সময় এক ঘোর নিঃস্তব্ধতা, দাঁত-চেপে কামড়; তারপর ইতিউতি চাহনি, হট্টগোল আর বাইরে বেরিয়ে অজস্র ‘সুভাষণ’।

সব শুনেটুনেও, সাহিত্য-বাসর শেষে অনুরোধ করে আসি, আমার কবিতাটি দয়াকরে ছেপো। তারপর নানান পত্রিকার নানান সংখ্যা আসে আর যায়, কবিতা ছাপার ডাক আর আসে না। কিন্তু আমার ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টের সংখ্যা বাড়ে, “কল্যাণ, ফেস-বাসায় আছো?” “চুপিচুপি কথা বলো/মুখে কিছু বলো না..”। এবার কিন্তু স্পষ্ট করে বলতে হবে, কল্যাণকে চাও? না অকল্যাণকে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *