আমাদের ভারত, আলিপুরদুয়ার, ২২ আগস্ট: গোটা দেশের কাছে রাজ্যের প্রত্যন্ত জেলা আলিপুরদুয়ারকে গর্বিত করলেন এক শিক্ষিকা। দেশের যে কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষিকা জাতীয় শিক্ষকের শিরোপা পেয়েছেন সেখানেই উঠে এল জেলার দুর্গমতম হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকার হাতে।
জেলার টোটোপাড়ায় ধনপতি মেমোরিয়াল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মিশা ঘোষাল আগামী ৫ই সেপ্টম্বর রাষ্ট্রপতির হাত থেকে এই পুরস্কার পেতে চলেছেন। দেশের ভেতর থেকে এবার মোট ৪৭ জনকে বেছে নেওয়া হয়েছে।পশ্চিমবঙ্গ থেকে রয়েছেন মাত্র দুজন। অপরজন দুর্গাপুরের নেপালিপাড়া হিন্দি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক কলিমূল হক।পুরস্কারের খবরটি ছড়িয়ে পড়তেই খুশির হাওয়া আলিপুরদুয়ারের শিক্ষানুরাগী মহলে।
জানা গেছে, দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করছেন মিশাদেবী। ২০০৮ সালে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব নিয়ে টোটোপাড়ায় আসেন মিশা ঘোষাল। মাধ্যমিক পর্যায়ে থাকা স্কুলটিকে উচ্চমাধ্যমিকে রূপান্তর করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। ধনপতি মেমোরিয়াল স্কুলে টোটো ছাত্রদের পাসের হার ছিল খুবই কম। ধীরে ধীরে পাসের হার বেড়ে এখন ৮০ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছে। উল্লেখ্য, ৭টি নদী-ঝোরা পার করে টোটোপাড়ায় স্কুলে চাকরি করতে যাওয়াটাই একটা চ্যালেঞ্জ বলে জানিয়েছেন আলিপুরদুয়ারের শিক্ষক মহলের একাংশ। এশিয়ার ক্ষুদ্রতম জনজাতি বলে পরিচিত টোটোদের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে দিতে টানা ১১ বছর কাজ করছেন। জেলার মাদারিহাটে যেমন নিজের বাড়ি রয়েছে, তেমনি প্রতিদিন স্কুলে যাবার তাগিদে টোটোপাড়ায় একটি ঘর ভাড়া করে থাকছেন প্রধান শিক্ষিকা। টোটো ছাত্রদের নিজেদের মাতৃভাষাতে পারদর্শী করে তুলতে গত ১১ বছর ছাত্রদের উৎসাহ দিয়ে গিয়েছেন এলাকার পরিচিত শিক্ষিকা। শুধু পড়াশোনা নয়, ছাত্রদের মধ্যে জীবনবোধ, সামাজিক দায়িত্ববোধ তৈরি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন।
জানা গেছে, প্রধান শিক্ষিকার অনুপ্রেরণায় ইতিমধ্যেই একাধিকবার দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নানা ধরনের অনুষ্ঠানেও অংশ নিতে গিয়েছে টোটো ছাত্ররা। আলিপুরদুয়ার জেলার দুর্গমতম হাইস্কুলটিতে এখনো পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাব থাকায় উচ্চমাধ্যমিকের পঠন পাঠন শুরু হয়নি। তবে এইবছর থেকে একাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু হতে পারে বলে জানা গেছে। তৃণমূল মাধ্যমিক শিক্ষক সংগঠনের জেলা সভাপতি কনোজ বল্লভ গোস্বামী বলেন, স্কুলের উন্নয়ন, এলাকায় যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার বিষয় নিয়েও আমাদের সঙ্গে সব সময় কথা বলেছেন তিনি। আমরা গর্বিত আজ। দেশের শিক্ষা মানচিত্রে আলিপুরদুয়ার জেলাকে তুলে ধরলেন মিশা ঘোষাল। টোটোপাড়া এলাকায় শিক্ষানুরাগী মহলে পরিচিত সেখানকার গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান আশা এস বমজান। আশা এস বমজান বলেন, সবচেয়ে আনন্দ হচ্ছে আমি নিজেও একজন মেয়ে। এতবড় একটি পুরস্কারের সঙ্গে আমাদের গর্বের হাইস্কুলের নাম জড়িয়ে গেল। টোটো ছাত্রদের জন্য নিবেদিত প্রাণ একজন প্রধান শিক্ষিকাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি আমরা। শুভেচ্ছা জানিয়েছেন দলমত নির্বিশেষে সকল রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে শিক্ষ্যানুরাগী মহল।
উল্লেক্ষ্য, এশিয়ার ক্ষুদ্রতম জনজাতি বলে পরিচিত টোটোদের জনসংখ্যা বর্তমানে ১৬০০-র কিছু বেশি।টোটোদের নিজস্ব ভাষা,সংস্কৃতি নিয়ে বহু চর্চা রয়েছে।সামগ্রিকভাবে টোটোপাড়ায় ক্ষুদ্রতম জনজাতিদের রক্ষা করতে গত ১০ বছর ধরে কাজ করছে রাজ্য সরকার। জানা গেছে, রীতিমতো পরীক্ষা দিয়ে ধাপে ধাপে শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যান মিশা ঘোষাল। ২০০৮ সালে মালদার সুজাপুরে সহ শিক্ষকের চাকরি ছেড়ে এসএসসি দিয়ে টোটোপাড়ায় বর্তমান স্কুলে আসেন। দুর্গম এলাকায় থাকা স্কুলটি বর্ষার সময় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। প্রায় ২০ কিমি রাস্তা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গিয়ে পাহাড়ের কোলে স্কুলে পৌঁছাতে হয়। মাদারিহাট থেকে প্রতিদিন গাড়ি পাওয়া যায় না বর্ষায়। সেই সময় স্কুলে পৌঁছে শিক্ষাদান বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়ে। প্রতিকূল পরিস্তিতিতেও সব কিছু মানিয়ে নিয়ে স্কুলের ছাত্রদের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়েছেন গত ১১ বছরে। মিশা ঘোষালের স্বীকৃতিকে কুর্নিশ জানিয়েছেন শিক্ষানুরাগীরা।
মিশাদেবী জানান, খুবই খুশি হয়েছি। আমার বিদ্যালয়ের ছাত্র, সহকর্মী থেকে আপামর জেলাবাসী তথা রাজ্যবাসীকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এই পুরস্কার আমাকে নতুন উদ্যোমে কাজ করার অনুপ্রেরণা জোগাবে। আমার ছাত্রদের কাছে, স্কুলের জন্য দায়িত্ব আর বেড়ে গেল।”