সোমনাথ বরাট, আমাদের ভারত, বাঁকুড়া, ২১ সেপ্টম্বর: বিখ্যাত শিল্পী বেলিয়াতোড়ের সন্তান যামিনী রায় পরিবারের দুর্গা পূজা এক ব্যাতিক্রমী পূজা।বেলিয়াতোড়ের জমিদার রায় পরিবারের দুর্গা পূজায় দেবীর পূর্নাবয়ব কোনোও মূর্তি নেই। শুধু মাত্র দেবীর মুন্ড পূজিত হয়। সিংহাসনের আদলে তৈরি বেদির ওপর বসানো দেবী দুর্গার আকণ্ঠ বা মুন্ড মূর্তি। নেই দেবীর সন্তান-সন্ততিদের মূর্তিও। দেবীর মুখাবয়বের দু’পাশে দেওয়ালে আঁকা অবস্থায় রয়েছেন লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্ত্তিক ও শিব।এখানে এভাবেই পূজিত হন দেবী। দেবীর শুধু মস্তক পূজা হয় বলে এই পুজা ‘মুণ্ড পুজো’ নামে জনপ্রিয়। কথিত আছে এই পুজোর যোগসূত্র রয়েছে বাংলাদেশের যশোরের রাজবাড়িতে। রাজা প্রতাপাদিত্য রায়ের কুলদেবী হিসাবেই পূজিত হতেন দেবী। সেই সময় পরিচিত ছিলেন যশোরেশ্বরী নামে। তখন অষ্টধাতুর পূর্ণাবয়ব দেবী চণ্ডীর মূর্তির পুজো হত যশোর রাজবাড়িতে।
ভারতে তখন মোঘল রাজত্বের দাপট। রাজ্যবিস্তারের জন্য যশোর আক্রমণ করেন মোঘল সেনাপতি। সেই যুদ্ধে পরাজয় হয় প্রতাপাদিত্য। মোঘল সময়ে কুলদেবীর আরাধনায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে সেকথা ভেবে দেবী যশোরেশ্বরীকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন প্রতাপাদিত্য। তবে যশোর ছাড়ার অনুমতি ছিল না তাঁর। তবে মানসিংহেরই সাহায্যে রাজা প্রতাপাদিত্যের কনিষ্ঠ পুত্র রাজীবলোচন দেবীকে বুকে নিয়ে রওনা দেন পুরীর উদ্দেশ্যে। সেখানে দেবীর মন্দির গড়ে তোলা লক্ষ্য ছিল তার। কিন্তু এতটা পথ হেঁটে যাওয়ার সময় সাময়িক বিশ্রামের জন্য থামেন বিষ্ণুপুরের নিকটবর্তী এক জায়গায়। ছদ্মবেশ ধরেও পরিচয় লুকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি রাজীব লোচনের। রাজপুরুষোচিত চেহারা ও বাগ্মিতা তাকে আলাদা করে দিয়েছিল অন্যান্য পরিব্রাজকদের থেকে। সেকথা বিষ্ণুপুরের মল্লরাজ বীর হাম্বিরের কাছে পৌঁছালে তার ডাক পড়ে রাজদরবারে। রাজীবলোচনের ব্যক্তিত্বে গুণমুগ্ধ হয়ে রাজীবলোচনকে বিষ্ণুপুরের দেওয়ান পদের জন্য মনোনীত করেন বীর হাম্বির। তবে তার অনুরোধ ছিল কুল দেবী দশভূজার জন্য মন্দির তৈরি করে দেওয়া। সেই অনুরোধ মেনে বিষ্ণুপুরের গোপালগঞ্জে মন্দির গড়ে তোলেন মল্লরাজ। আজও সেখানে পূজিত হন অষ্টধাতুর তৈরি সেই যশোরেশ্বরী।
গোপালগঞ্জে মন্দির প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বেলিয়াতোড় এলাকায় রায় পরিবারকে বিস্তীর্ণ জমি দান করেন মল্লরাজ। রাজীবলোচন গোপালগঞ্জ ছেড়ে না গেলেও পরবর্তীতে বেলিয়াতোড়ে গড়ে তোলেন রায় পরিবারের বাড়ি। তবে যশোরেশ্বরী থেকে যান গোপালগঞ্জেই। বেলিয়াতোড়েও আয়োজন করা হয় দুর্গাপুজোর।বেলিয়াতোড়ে রাজবাড়ি প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই মুণ্ডপুজো হত কিনা তার কোনো স্পষ্ট নথি নেই। তবে জনশ্রুতি, রায় পরিবারের কর্তাকে স্বপ্নাদেশ দিয়েছিলেন যশোরেশ্বরী। যেহেতু দশভুজারূপে তিনি পূজিত হন বিষ্ণুপুরে তাই অন্যত্র তাঁর পুজো করতে গেলে শুধু মুখমণ্ডলের পূজা করতে হবে। সেই থেকে পরিবারের দুর্গাপুজো এমন ভাবেই হয়ে আসছে।যশোরেশ্বরীর আদলে ‘মুণ্ড পুজো’ হয় বলেই দেবীর পাশে অনুপস্থিত থাকেন তাঁর চার সন্তান। সেগুন কাঠের রথঘরের কাঠের দেওয়ালে রং-তুলিতে আঁকা রয়েছে লক্ষ্মী, গণেশ, কার্ত্তিক, সরস্বতী ও শিবের প্রতিকৃতি।একটা সময় পর্যন্ত বেলিয়াতোড় এবং গোপালগঞ্জ দুই দুর্গাপুজোতেই অংশ নিতেন রায় পরিবারের সদস্যরা।বর্তমানে দুর্গাপুজো চলাকালীন বেলিয়াতোড়ে যান না রায় পরিবারের সদস্যরা। ‘বাহক’ দিয়ে পাঠানো হয় পুজোর সামগ্রী। সেই উপকরণ পাওয়ার পর দেবী যশোরেশ্বরীর পুজো শুরু হয়।
ঢাকের বদলে এখানে বাজে কাড়ানাকাড়া। প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী যামিনী রায় এবং ঐতিহাসিক তথা বড়ু চণ্ডীদাসের লেখা ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এর আবিষ্কর্তা বসন্তরঞ্জন রায়ও এক সময় সক্রিয়ভাবে অংশও নিতেন এই ‘মুণ্ড পুজোয়’। এমনকি যামিনী রায়ের আঁকা দেবীর অনেক চিত্র রয়েছে।

