ড. রাজলক্ষ্মী বসু
২০ এপ্রিল: একটা আধার কার্ড নাম্বার বলি— 7941959128640, আন্দাজ করার উপর নেই কার। আলী আহমেদের। ইনি কে? ছদ্মনামধারী খুনী মাজেদ। বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের খুনী। শুধু তাই নয় তার পাসপোর্টও ছিল, এজন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনও হয়েছিল।
ফিরে তাকাই একটু অন্যভাবে।
বাংলাদেশের ক্যাফেটেরিয়ার ঘটনা খেয়াল আছে? ২০১৬-তে বিখ্যাত বনেদি হোলি আর্চিমান কাফেতে বিস্ফোরণ, ১৬০ মিলিয়ন মানুষকে হতচকিয়ে দেয়। ২০১৬-এর ১ জুলাই যখন এই জঘন্য ঘটনা ঘটে, তখন আট ঘাতকের দলের থেকে উচ্চারিত হয়েছিল ‘আল্লাহ আকবর’। ঢাকার বনেদি এবং সেই ক্যাফেটেরিয়াতেও ওই পরিকল্পিত দুর্ঘটনা ঘটে, যেখানে কূটনৈতিক পণ্ডিত এবং বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা লেগেই থাকত। এমন ক্যাফেতে পরিকল্পিত জঘন্যতা ঘটালে সারা বিশ্বের কাছে জঘন্যকারীদের বার্তা খুব সহজে পৌঁছে দেওয়া যায়। আতঙ্ক সৃষ্টি করা খুব সহজ হয়। সন্ত্রাস ঘটিয়েছিল কারা? জামাত-উল-মুজাহিদিন নামক চরমপন্থী গোঁড়া সংগঠন বাংলাদেশে কঠোর শরিয়ত নিয়মের অনুশাসন চালুর উদ্দেশ্যেই এই জেহাদি বার্তা। ঘাতকদেরর দু-জনের সরাসরি ইসলামিক স্টেট অব ইরাক (আইএসআইএস) এবং লিভান্ট-এর সাথে যোগ ছিল। আশ্চর্যজনকভাবে ওই ঘাতকদের সকলেই শিক্ষিত এবং আন্তর্জাতিক যোগ ছিল। তাদের এই ঘটনার আগের মুহূর্ত পর্যন্তও কোনওভাবেই সন্দেহ করা যায়নি যে তারা এমন ঘৃণ্য ঘটনার জন্য প্রায় এক বছর ধরে আঁটোসাঁটো পরিকল্পনা করছিল। তথ্য বলে ১৯৮০ সালের পর থেকেই বাংলাদেশে জিহাদি দলের জন্ম হয়। প্রায় তিন হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি সৌদি অনুপ্রাণিত রাশিয়া বিরোধী জেহাদে আফগানিস্থানে অংশগ্রহণ করে। পাকাপাকি জেহাদের শুরু তখন থেকেই।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের হত্যা হয় ১৯৭৫-এ। তাই যে তথ্য প্রচলিত ইতিহাসে পাওয়া যায়, অর্থাৎ ১৯৮০-র পূর্বেই জেহাদি দলের সূচনা এবং তারা পাকা মাথার খেলোয়াড়। কারণ এত বছর পর মুজিব হত্যার আরও এক দস্যুকে গ্রেফতার করা হল এবং ফাঁসি হল তার। এ গলি সে গলি, এ দেশ, ওদেশ ঘুরে ফিরে বেড়িয়েছে সেই হত্যাকারী। ঠান্ডা মাথার ওই খুনী ছদ্মবেশে ঘাপটি মেরে ছিল আমার আপনার মধ্যেই–কলকাতায়। ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আব্দুল মাজেদ।
এতটাই পাকাপাকিভাবে নিজেকে নির্দোষ প্রতিষ্ঠিত করেছিল যে কলকাতায় নতুন ফ্ল্যাট কেনার পরিকল্পনা করেছিলেন। বাংলাদেশের সাংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী তিনি ২৫ লক্ষ টাকা অগ্রিমও দেন।
মুজিব হত্যা। তারপর এদেশ-ওদেশ। এখন দানা বাঁধছে অনেক প্রশ্ন। উনি তো বাংলাদেশি নাগরিক। এ রাজ্যে ফ্ল্যাট কেনার পাকা বন্দোবস্ত মানে এই যে এখানের হোমরাচোমরা কেউ নির্ঘাত রক্ষাকবচের মতো ছিলেন। তার জন্যই কলকাতায় খুঁটি এত শক্ত হয়। ১৯৯৬-তে বাংলাদেশে আওয়ামী লিগ সরকার আমলে পাকাপাকি পলাতক হয় এই খুনী। প্রথমে ভারত, তারপর লিবিয়া হয়ে পাকিস্থান। কোনও দেশেই পাকাপাকি বসবাসের সুবিধা করতে পারেনি। তা সে ভাষার সমস্যাই হোক বা অন্য কিছু। নির্ভরযোগ্য আশ্রয় ঠিকানা তারপরই হয় কলকাতা।
এ রাজ্যে কেবল অনুপ্রবেশকারীই নয় দুর্বৃত্তকারীদের রক্ষা করার সবরকম সুবিধা এক শ্রেণির মানুষ যে দেয় তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ আর নেই। কলকাতার প্রভাবশালী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের মদত না থাকলে কোন যুক্তিতে মুজিব খুনি মাজেদ খুব অল্প সময়ে ভারতীয় পাসপোর্ট পান? ২০১৭ সালে তিনি নামবদল করে আলী আহমেদ নামে ভারতীয় পাসপোর্টের মালিক হন। পার্ক স্ট্রিট থানা থেকে ভেরিফিকেশন পর্যন্ত হয়। এমন মিথ্যা কারসাজি করেও পার পেয়ে যায় মাজিদ কিভাবে? কার মদতে?
এখানেও জিজ্ঞাসা একটাই যে বা যারা এ রাজ্যে ওকে আশ্রয়, নিরাপত্তা ইত্যাদি সবকিছু দিয়েছিল, তাদের কারও কথাই কিন্তু প্রকাশ্যে আসেনি। স্বাভাবিক বুদ্ধিতে ভাবা যেতেই পারে যে, খুনী মাজিদ এ রাজ্যের কোনও না কোনও রাজনৈতিক নেতার এবং তার সহচরের সান্নিধ্যেই এতগুলো বছর ‘ভারতীয়’ এবং পশ্চিমবঙ্গবাসী হিসেবে কলেজ স্ট্রিট বা নিউ মার্কেটে দিব্যি হেঁটে চলে বেড়িয়েছে। পুলিশ গোয়েন্দা সব কিছুকে ফাঁকি দিয়ে প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় দিব্যি কাটছিল দিন।
ছবি: প্রতিবেদক ড. রাজলক্ষ্মী বসু।
খুনী মাজেদের শিকড় কতটা গভীরে তার প্রমাণ সবরকম নাগরিকত্বের আসল নথি ছিল তার। হাওড়ায় বুঝি তার জন্ম, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড কি ছিল না তার। মাজেদের জন্য টাকার সরবরাহ হত বাংলাদেশ থেকেই। এ ধরনের ক্রিমিনালরা সাধারণত ব্যাঙ্কিং ট্রানজাকশন করে না। তবে বাংলাদেশের সাথে তার ছিল নিয়মিত যোগাযোগ। কারণ স্ত্রী সেলিনা ওরফে জেরিনা বেগম ওপাড়েই বসবাস করেন। ২২ ফেব্রুয়ারির পর খুনী নিখোঁজ হয়, বেডফোর্ট লেনের বাড়ি থেকে। তাহলে কি অপহরণ ছিল? মোটেই না। সবটাই ছিল সাজানো ঘটনা। মোবাইল টাওয়ার লোকেশন সর্বশেষ পাওয়া যায় মালদহে। সেখান থেকে ট্রেনে গুয়াহাটি, শিলং এবং ডাওকি সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশ। মোবাইলে বেশ কিছুদিন ধরে ট্রাক করার চেষ্টা হচ্ছিল না এমনটা নয়, বেশ কয়েকবার আড়ি পাতার চেষ্টাও করা হয়েছিল। কিন্তু কেবল ফোন দিয়ে পাকামাথার খেলোয়াডকে ধরা যাচ্ছিল না। প্রশ্ন একটাই, করোনার গেঁড়ো না থাকলে এবারও কি ধরা যেত? খুব বড়ো জিজ্ঞাসা এটাই। মার্চের মাঝামাঝি খুনী বাংলাদেশে ঢোকে। তারপরই তো খেলা শেষ। কারণ আর ফেরার পথ নেই। আগে কে বা জানত! করোনার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি
মানুষ যে আগে কখনই হয়নি। তাই বোধহয় ওখানেই হিসাবে কোথাও একটা ভুল হয়েছিল মুজিবর ঘাতকের।
এমনটা ভাবতেও পারেনি যে ট্রেন, বাস, বিমান সবরকম যোগাযোগ সারা বিশ্বে এত দীর্ঘ এবং অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ থাকবে। গা ঢাকা দেবে কিভাবে? যাবে কোথায়? লকডাউনে তো ভিড়ে মিলিয়ে যাওয়ার উপায়টাও অবশিষ্ট রইল না। গোয়েন্দা সংস্থা ঝোপ বুঝে কোপটি মেরেছে। আমার ধারণা, ক্রাইম বলতে আমরা যা বুঝি লকডাউনের সময় তা এক পলকে কমে গেছে। ফ্রি মুভমেন্ট না থাকা মানেই হল ক্রিমিনালদের প্রথম দফায় ডানা ছাঁটা। দ্বিতীয় দফা হল জমায়েত, আনাগোনা বন্ধ, প্রতি পদক্ষেপে জবাবদিহির ভয়। ক্রিমিনালরা সর্বদাই সাধারণের মধ্যে মিশে থেকে দুষ্কর্ম করে। কিন্তু সেই সাধারণের সংখ্যা পথেঘাটে নেই তাই ধরাটি পড়লে তাদের যে অসাধারণ রূপটি ধরা পড়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। এ বছরেই মুজিবর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ছিল। লকডাউনের জন্য করোনা আতঙ্কে বাংলাদেশ তাও সমারোহের সাথে করতে পারল না। সেই অপ্রাপ্তি কড়ায়গণ্ডায় মিলিয়ে দিল বঙ্গবন্ধু খুনীর গ্রেফতার এবং মৃত্যুদণ্ড। অনেক অপ্রাপ্তির মাঝেও এক প্রাপ্তি। কিন্তু নিবন্ধে উল্লিখিত জিজ্ঞাসাগুলোর উত্তর এখনও অজানা। (মতামত লেখকের নিজস্ব)