Hotel, Mandarmani, শতাধিক হোটেল ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ, তার মাঝেই মন্দারমণিজুড়ে বেপরোয়া গতিতে মাথা তুলছে আরও বহুতল

পার্থ খাঁড়া, আমাদের ভারত, পূর্ব মেদিনীপুর, ২১ নভেম্বর: পরিবেশ আদালতের নির্দেশে অনিশ্চয়তার ঘেরাটোপে মন্দারমণির প্রায় ১৪০টি অবৈধ হোটেল রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপে সাময়িকভাবে ভাঙ্গার ক্ষেত্রে স্থগিতাদেশ জারি করা হয়েছে। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা পাকাপাকিভাবে হোটেলগুলি বাঁচাতে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন। আগামী শুক্রবার এই মামলার শুনানি। কিন্তু এত অনিশ্চয়তার মধ্যেও এতটুকুও ভাটা পড়েনি হোটেল নির্মাণে। এই মুহূর্তেও মন্দারমণিতে অবলীলায় মাথা তুলে চলেছে আরও বিপুল পরিমাণে বহুতল। তাও আবার কোনও রকম অনুমোদনের তোয়াক্কা না করেই।

স্থানীয় সূত্রে খবর, মন্দারমণি লাগোয়া ৫ থেকে ৬টি
মৌজাজুড়ে এই মুহূর্তে মাথা তুলেছে প্রায় পাঁচ শতাধিক হোটেল। এক সময় যেখানে হাজার হাজার একরজুড়ে বালিয়াড়ি, লাল কাঁকড়া, বাদাবন, কেয়াঘাসের জঙ্গলে ভরা মনোরম পরিবেশ ছিল, এখন সেখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে তিন- চার তলা শতাধিক হোটেল। গত কয়েক বছরে এই হোটেলের পরিমাণ বেড়েছে লাগামছাড়া হারে। আর পাল্লা দিয়ে ধ্বংস হয়েছে পরিবেশের নৈসর্গিক দৃশ্য। এই মুহূর্তে মন্দারমণিতে লাল কাঁকড়া প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে। বাদাবন, কেয়াঘাসের জঙ্গলও উধাও। তার জায়গায় সৈকত লাগোয়া এলাকায় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে পেল্লাই হোটেলগুলি।

স্থানীয় দাদনপাত্রবাড় মৎস্যখটির সম্পাদক শ্রীকান্ত দাস জানান, “হোটেল শিল্পের প্রসারে মন্দারমণি সহ আশপাশের এলাকার বাসিন্দাদের আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটেছে সন্দেহ নেই। বহু মানুষের জীবন জীবিকা এই হোটেল ব্যবসার ওপর নির্ভর করছে। কিন্তু তারজন্য প্রকৃতির ওপর যেভাবে কোপ পড়েছে তা অত্যন্ত নিন্দাজনক”।

শ্রীকান্তবাবু জানান, “বছর কয়েক আগেও
মন্দারমণিজুড়ে ছড়িয়ে ছিল বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ি। ঝাঁকে ঝাঁকে লাল কাঁকড়ার দেখা মিলত সৈকতে। কিন্তু এখন সেসব উধাও। সিআরজেড রেগুলেশন মেনে যদি সমুদ্র তীরবর্তী এলাকা ছেড়ে নিয়ম মেনে হোটেল তৈরি হত তাহলে এত বড় বিপর্যয় নেমে আসত না।”

শ্রীকান্তবাবুর মতে, “সমুদ্র এখন অনেকটাই এগিয়ে এসেছে। গত কয়েক বছরে প্রায় ২৫০ মিটার এগিয়ে এসেছে সমুদ্রের জল। ভরা কোটালে এখানকার অধিকাংশ হোটেল চত্বর জলে ডুবে যায়। আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রাম সহ মৎস্যখটিগুলির অস্তিত্ব চরম সঙ্কটে”। তিনি জানান, “হোটেলগুলি ব্যক্তিগত উদ্যোগে পাড়্গুলিকে বোল্ডার দিয়ে বেঁধে রাখলেও আশপাশের বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ি প্রায় উধাও। বাদাবন, কেয়াঘাস হারিয়ে যেতে বসেছে। এরফলে আশপাশের জনপদ নিশ্চিহ্ন হওয়ার আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে”।

শ্রীকান্তবাবু জানান, “২ থেকে ৫ বছরের মধ্যেই মন্দারমণির চরিত্র সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে। যথেচ্ছ হারে সৈকতে গাড়ি ছুটছে। সেই সঙ্গে অবাধে চলছে হোটেল নির্মাণের কাজও।”

স্থানীয় হোটেল ব্যবসায়ীদের দাবি, মন্দারমণির অধিকাংশ হোটেল নির্মাণ হয়েছে বাম আমলের শেষ দিকে। স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েতের থেকে পাওয়া অনুমোদনের ভিত্তিতে এই হোটেল নির্মাণ হয়েছে। আইন মেনে জমির চরিত্র বদলের পাশাপাশি হোটেল ব্যবসার সমস্ত নিয়ম কানুন মেনেই এই হোটেলগুলি তৈরি হয়েছে।

যদিও স্থানীয় সূত্রে খবর, সিআরজেড আইনের গেরোয় ২০১১ সাল থেকে মন্দারমণি লাগোয়া সমুদ্র তীরবর্তী এলাকার জমির চরিত্র বদলের কাজ বন্ধ রয়েছে। সেই সঙ্গে পঞ্চায়েত থেকেও আর হোটেল তৈরির অনুমোদন দেওয়া হয় না। এমনকি হোটেল ব্যবসার যাবতীয় অনুমোদন নবীকরণের কাজও বন্ধ। তারপরেও মন্দারমণিতে হোটেল তৈরিতে ভাটা পড়েনি এতটুকুও। গত ১০ থেকে ১২ বছর আগে যেখানে ৭০ থেকে ৮০টি হোটেল ছিল এখন সেখানে হোটেলের পরিমাণ অগুনতি।

মন্দারমণি হোটেলিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশানের সভাপতি মীর মমরেজ আলির দাবি, “সিআরজেড অনুযায়ী এলাকা চিহ্নিতকরণ না হওয়াই সমস্যার মূল কারণ”। তিনি জানান, “এই মুহূর্তে মন্দারমণিতে প্রায় ১৮০ থেকে ২০০টির আশপাশে হোটেল রয়েছে। যেগুলো অনেক বছর আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছে”। মমরেজের দাবি, “একটা সময় হোটেল নির্মাণের জন্য পঞ্চায়েত থেকে প্রয়োজনীয় অনুমোদন পাওয়া যেত। সেই সঙ্গে হোটেল ব্যবসা চালানোর আনুষঙ্গিক ট্রেড লাইসেন্স, ফায়ার, ফুডের মতো গুরুত্বপূর্ণ অনুমোদনও পাওয়া যেত। সেই অনুমতির ভিত্তিতেই এখানে হোটেল ব্যবসা গড়ে উঠেছে। যার অধিকাংশই ২০০০ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে গড়ে উঠেছে” বলেই দাবি জানিয়েছেন তিনি। যদিও স্থানীয়দের দাবি,
মন্দারমণিজুড়ে বিপুল পরিমাণে নতুন হোটেল গজিয়েছে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই। এই মুহূর্তেও বিপুল পরিমাণে নতুন হোটেলের কাজ চলছে বলেও অভিযোগ এলাকাবাসীর।

তবে এই প্রশ্নের জবাবে মোমরেজ জানান, “এখন হয়তো হাতেগোনা দু’ চারটে নতুন হোটেল তৈরি হচ্ছে। তবে অধিকাংশ হোটেলেই নিয়মিত ভাবে মেরামতির কাজ চলছে”। তাঁর দাবি, “এই হোটেলগুলি নির্মাণের অনুমোদন অনেক আগেই নেওয়া হয়েছিল। বেশ কয়েক বছর ধরে একটি হোটেল তৈরি করতে সময় লাগে। তাই সব মিলিয়ে এখন অবৈধ নির্মাণ হচ্ছে এটা বলা ঠিক হবে না”। মোমরেজ জানান, “অধিকাংশ রায়ত জমিতে হোটেল হয়েছে, সামান্য কিছু পাট্টা জমি রয়েছে। জমির শ্রেণির চরিত্র বদল ২০১১ থেকে বন্ধ রয়েছে। বাড়ি নির্মাণ থেকে ব্যবসা চালানোর অনুমোদন নতুন করে দেওয়া হচ্ছে না। কোনও লাইসেন্স পুর্ননবীকরণও হচ্ছে না। তাই নতুন করে কোনও হোটেল তৈরি হচ্ছে না”। যদিও স্থানীয় মৎস্যজীবী সংগঠনগুলি হোটেল ব্যবসায়ীদের এই দাবির সঙ্গে সহমত পোষণ করতে রাজি নন।

মন্দারমণিতে অবৈধ হোটেলের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন চালাচ্ছেন দক্ষিণবঙ্গ মৎস্যজীবী ফোরামের সভাপতি দেবাশিষ শ্যামল। তিনি জানান, “অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য মন্দারমণির হোটেল শিল্পে অগ্রগতি দরকার। কিন্তু এখানে পরিবেশ ধ্বংস করে সিআরজেড আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একের পর এক বহুতল নির্মাণ হয়ে চলেছে লাগামছাড়া হারে। এখনও সেই কাজে ভাটা পড়েনি এতটুকুও”।

দেবাশিষবাবু জানান, “সিআরজেড রেগুলেশনের দোহাই দিয়ে দাদনপাত্রবাড় পঞ্চায়েতের অন্তর্গত সমুদ্র লাগোয়া উত্তর সোনামুই, মন্দারমণি, দাদনপাত্রবাড়, দক্ষিণ পুরুষোত্তমপুরের মতো মৌজাগুলিতে ২০১৪ সাল থেকে আবাস যোজনায় টাকা পাওয়া উপভোক্তাদের বাড়ি তৈরির অনুমোদন দেওয়া হয়নি। দীর্ঘ সংগ্রামের পর কয়েক বছর আগেই তাঁরা বাড়ি তৈরির অনুমতি পেয়েছেন। অথচ সেই মৌজাগুলিতেই অবলীলায় তৈরি হয়ে চলেছে একের পর এক সুবিশাল হোটেল”।

দেবাশিষবাবুর প্রশ্ন, “কোস্টাল রেগুলেশনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এই এলাকায় হোটেল তৈরির অনুমোদন দিচ্ছেন কারা? কাদের মদতে হোটেলগুলি নির্মাণে কোনও বাধা দেওয়া হয়নি”। তাঁর দাবি, “প্রশাসনের উচিত, পরিবেশের ভারসাম্য বজার রেখে হোটেল তৈরির অনুমোদন দেওয়া। আর তা না হলে অচিরেই সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে মন্দারমণির মতো জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রটি”।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *