শান্তিপুরের রায় বাড়ির মাদুর্গার অলৌকিক কাহিনি

স্নেহাশীষ মুখার্জি, আমাদের ভারত, নদিয়া , ২৪ সেপ্টেম্বর : বাড়ির দোতলা তিনতলার ছাদ থেকে বিভিন্ন সময় বাড়ির সদস্যরা পড়ে গেলেও মা তাদের কোলে তুলে নিয়েছেন। কারো কোনও ক্ষতি হয়নি। এখানে দুর্গাপূজার ভোগ একই পাত্রে রান্না হলেও নিবেদনের পর কোনও এক অজানা কারণে তার স্বাদ পাল্টে যায়। শান্তিপুরের রায় বাড়ির এক রহস্যময়ী দেবীর দুর্গার অলৌকিক শক্তির কথা আজ আপনাদের কাছে আমরা তুলে ধরব।

পরিবার সূত্র থেকে জানা যায় ব্রিটিশ আমলের আগে এই রায় বাড়ির বংশধররা ছিলেন বন্দ্যোপাধ্যায় বংশ। আজ থেকে আনুমানিক সাড়ে ৬৫০ বছর আগে ব্রিটিশ সরকার এই বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারকের রায় উপাধিতে ভূষিত করে। সেই থেকেই এই বাড়ি রায় বাড়ি নামে পরিচিত।

তৎকালীন জমিদার স্বর্গীয় গৌড়চাঁদ রায় এই পুজোর প্রচলন করেন। অন্যান্য প্রতিমার থেকে এই প্রতিমা একটু আলাদা। বৈষ্ণব মতে পূজো হয়, সেহেতু এই প্রতিমায় লক্ষ্মী, গণেশ, কার্তিক, সরস্বতী থাকে না। এই ঠাকুরের বৈশিষ্ট্য বলতে গেলে জানা যায় এই বাড়ির কুলদেবতা গৌড়হরি ঠাকুর নামে পূজিত হন। এই কুল দেবতা এবং মা দুর্গার পুজো একসাথে পাশাপাশি হয়। ভোগ একই পাত্রে রান্না হয়। কিন্তু নিবেদন করার পর ভোগের স্বাদ পাল্টে যায়। এছাড়া যেরকম অন্যান্য বনেদী বাড়িতে পুজো হয় তেমনই হয়।

অন্যান্য বাড়ির মতই পুজোতে আখ, কুমড়ো বলি হয়। পুজোর পঞ্চমীর দিন মহিলারা সবাই মিলে আনন্দ নাড়ু তৈরি করে। সেই নাড়ু প্রতিদিনই মাকে সন্ধ্যার সময় বৈকালিক লুচির সঙ্গে দেওয়া হয়। মাকে ভোগের সঙ্গে কদবেল দেওয়ার রীতি আছে এখানে।

পরিবারের প্রধান অসিতকুমার রায় জানান, “প্রায় ৬০ বছর আগে তিনতলা থেকে আমি পড়ে গেছিলাম। তখন আমার বয়স ছিল ৮ -১০ বছর। আমি ১৫ দিন অজ্ঞান ছিলাম। কোনওরকম জ্ঞান ছিল না। ১৫ দিন মাথার উপর আইস ব্যাগ থাকতো। আধমন করে বরফ লাগত। কিন্তু মার অলৌকিক কৃপায় আমি অক্ষত ছিলাম। মা আমাদের পরিবারকে আগলে রেখেছেন।

শুধু আমি নয়, এই বাড়িতে আমাদের এক ভাড়াটিয়া থাকতো। যার দুই মেয়ে। একদিন এই ভাড়াটিয়ার বড় মেয়ে ‘ছবি’ দোতলা থেকে পড়ে যায়। তারও কোন ক্ষতি হয়নি। তখন ছবির বয়স আনুমানিক পাঁচ বছর। সে তার দিদিকে মার ছবি দেখিয়ে বলে, “দিদি জানিস আমি যেই পড়ে গেলাম মা আমাকে কোলে করে ধরে নিল।”

পরিবারের মেয়ে মৌমিতার রায় ভট্টাচার্য বলেন,”পুজোর কটা দিন খুব আনন্দ হয়, সবাই বাইরে থেকে এখানে আসে। অষ্টমীর দিন বাড়িতে প্রচন্ড আনন্দ হয়। সন্ধি পুজোর দিন আমরা সবাই মেয়েরা পদ্মফুল ফাটাই। এরপর শুরু হয় মায়ের বিদায় রজনী। শুরু হয় সিঁদুর খেলা। বাড়ির সবাই মিলে পাড়ার লোকেদের সঙ্গে একযোগে আমরা সিঁদুর খেলি।”

রায় বাড়ির সদস্য রাহুল কুমার রায় জানান, “আমাদের প্রথম যিনি পুজো শুরু করেন তার নাম স্বর্গীয় গৌড়চাঁদ রায়। গৌড়চাঁদ রায়ের হাত ধরে আমাদের এই বাড়িতে পুজো শুরু হয়। আমাদের এই পুজো আগে হতো শান্তিপুর পাবলিক লাইব্রেরির মাঠে, যেটা এখন শান্তিপুর মিউনিসিপ্যালিটিকে দান করা হয়েছে। এটা স্বর্গীয় হরিদাস রায় দান করে যান। এখন যেটা মতিগঞ্জ সেটা স্বর্গীয় উমেশ চন্দ্র রায় ওরফে মতিবাবুর নামে করা হয়েছে। এই পুজো মতিবাবুর আমল অব্দি পাবলিক লাইব্রেরিতেই পূজিত হতো। তারপর হরিদাস রায়ের আমল থেকে এই পূজো দত্ত পাড়ার গৌরহরি লেনে স্থানান্তরিত হয়। যেটা এখন দত্তপাড়া রায়বাড়ী নামে পরিচিত।

এখানে প্রায় ২৫০ – ৩০০ বছর আমাদের এই পুজো চলছে। কিন্তু তাঁর আক্ষেপ, “আমরা বহুবার পৌরসভার কাছে আবেদন রেখেছি যে রায় বাড়িকে হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করার জন্য কিন্তু সেটা আজ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। পাশাপাশি মন্দির উন্নয়নকল্পে আমরা আর্থিক সাহায্যের জন্য শান্তিপুরের বিধায়কেরও দ্বারস্থ হয়েছিলাম কিন্তু এখনো আমরা কোনও সাহায্য পাইনি।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *