দেবারতি মূখোপাধ্যায়
আমাদের ভারত, ২ মার্চ: আমার দিদিমা ছিলেন পূর্ববঙ্গের বরিশালের ঝালকাঠি গ্রামের মেয়ে। দিদিমার বাবা ছিলেন গ্রামের ডাক্তার। বনেদিয়ানা ছিল না মোটেই, দিদিমার বাবা খুব কষ্ট করে দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। আর্থিক স্বচ্ছলতা খুব বেশি না থাকলেও সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিবেশ ছিল বাড়িতে।
দিদিমারা দুই বোন, দুই ভাই। আরেক দাদা ছিল, মারা গেছে কৈশোরে। দিদিমারা ভাইবোন সকলেই ভাল গান গাইতেন, আর দিদিমা তো বেশ কয়েকবার রেডিওতেও গেয়েছেন। সাতচল্লিশে ভারতবর্ষ স্বাধীন হল, কেটে দু’টুকরো করা হল দেশটাকে। অকূল পাথারে পড়লেন দিদিমার বাবা। গ্রামে ডাক্তারির ভাল পসার কিন্তু আত্মীয়স্বজন সবই কলকাতায়। প্রতি সপ্তাহে দিদিমার বাবা বরিশাল এক্সপ্রেসে চেপে আসতেন কলকাতায়। দমদমের চেম্বারে রুগী দেখে আত্মীয়দের বাড়ি রাত্রিবাস করে আবার ফিরে যেতেন। দেশভাগ হওয়ার পর আচমকাই সেই আত্মীয়রা অন্য দেশের বাসিন্দা হয়ে গেলেন। রাতারাতি গৃহহীন হয়ে পড়ল হাজার হাজার মানুষ। বরিশাল হয়ে গেল পূর্ব পাকিস্তান।
দেশের পরিস্থিতি ক্রমেই অচেনা হয়ে উঠছিল। কলকাতার আত্মীয়রা বারবার ডাকছিলেন, “সোমত্ত মেয়েরা রয়েছে ঘরে, এ’দেশে চলে এসো নিশিকান্ত! একা একা কেন পড়ে থাকবে ওদেশে? যা সব হচ্ছে!”
দিদিমার বাবা পড়েছিলেন বেশ মুশকিলে। চার সন্তান, সামান্য কিছু জমিজমা সমেত বাড়ি, পুকুরভর্তি মাছ, বাগান ভর্তি আমগাছ… চলে এসো বললেই কি সব সুতো টান মেরে ছিঁড়ে ফেলে চলে যাওয়া যায়? এখানে নিজের কত পরিচিতি, বন্ধুবান্ধব, এই নাড়ির টান অগ্রাহ্য করবেন কী করে? তাছাড়া কলকাতায় যাওয়ার কথা বললেই গ্রামের মুসলমানরা সবাই হাহা করে ওঠে। এতদিনের পড়শি সব, ডাক্তারবাবুকে তারা কিছুতেই দেশ ছেড়ে যেতে দেবে না, কিছু বিপদ হলে তারা প্রাণ দিয়ে রক্ষা করবে।
দোনোমনাতে কেটে গেল আরো বছর দুয়েক। দেশ দু’ভাগ হওয়ার পরও বরিশাল এক্সপ্রেস চলত দিব্যি। শিয়ালদহ থেকে বেনাপোল, যশোর হয়ে খুলনা পর্যন্ত। এদিকে পেট্রাপোলে আর ওদিকে বেনাপোলে দু’দফায় যাত্রীদের ভিসা পাসপোর্ট চেক করা হতো। সে’সময় ইস্ট বেঙ্গল মেইল এবং ইস্টার্ন বেঙ্গল এক্সপ্রেস নামে আরো দুটো ট্রেন দুই দেশের মধ্যে চলাচল করত। তখনো মানুষের মনে প্রত্যয়ী আশা, ট্রেনে আসতে যেতে আলোচনার ঝড়। এভাবে কদ্দিন আলাদা রাখবে? আবার দুই বাংলা এক হয়ে যাবে। কিন্তু সেই দিন আর কোনদিনও আসেনি।
১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হল। বরিশাল এক্সপ্রেসও চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল। ফিরে আসি দিদিমার প্রসঙ্গে। ধীরে ধীরে চেনাপরিচিত সবাই চলে যাচ্ছিল পশ্চিমবঙ্গে। চোখের জলে পেছনে ফেলে রেখে যাচ্ছিল ঘরবাড়ি, গাছপালা, গরুছাগলদের আর সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিল পাহাড়প্রমাণ স্মৃতি! দিদিমার বাবাও টালমাটাল হতে হতে দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্তটা একসময় নিয়েই ফেললেন। খানসেনাদের দৌরাত্ম্য দিনদিন বাড়ছে। দিদিমার বয়স তখন চোদ্দ। ছোটবেলার খেলার সঙ্গী, গ্রামোফোনের কয়েকশো রেকর্ড আরো অনেক কিছু ফেলে চলে এলেন ভারতে। গায়ে লেগে গেল ’রিফিউজি’র তকমা।
কয়েকদিন আত্মীয়ের বাড়িতে ছড়িয়েছিটিয়ে থেকে শুরু হল শূন্য থেকে মাথার ওপর ছাদ পাওয়ার সংগ্রাম। আমার দিদিমা বেশ স্মার্ট ছিলেন, এদেশে আসার পর খুব দ্রুত রপ্ত করে নিয়েছিলেন কলকাত্তাই বাংলা। বিয়েও হয়েছিল এদেশীয় ঘটি বাড়িতে। কিন্তু জন্মভিটে ছেড়ে চলে আসার গভীর দুঃখ দিদিমার মনে আমৃত্যু প্রোথিত ছিল। স্বল্পবাক ছিলেন, কিন্তু আমার মত নাছোড়বান্দারা শুনতে চাইলে ঝাঁপি উজাড় করে দিতেন। মিনতি নামক বান্ধবীর সঙ্গে রোজ নদী উজিয়ে ওপারের স্কুল। ঝিল ভর্তি ফুটে থাকা শাপলা ফুল। লাকুটিয়ার জমিদারবাড়ির বাগানে গিয়ে চড়ুইভাতি। কত গল্প! কত আবেগ! কত হাসি! কত চোখের জল!
তবে লক্ষ্য করতাম, বাড়ি, জমি, পুকুর, বন্ধু সব ছাপিয়ে দিদিমার মনে দুঃখ ছিল একটা অদ্ভুত মিষ্টির জন্য। “জানিস দিদিভাই, আমাদের ঝালকাঠিতে একধরণের মিষ্টি পাওয়া যেত। পুটুদাদা খেতে বড় ভালবাসত! যেদিন মরে গেল, ওর খাটে এক হাঁড়ি দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মা নিজের হাতে ওর মুখে দিয়েও দিয়েছিল!”
দিদিমার প্রতিটি স্মৃতিচারণে অবধারিত উপস্থিতি ছিল তাঁর অকালপ্রয়াত পুটুদাদার। আমি জিজ্ঞেস করতাম, “কী মিষ্টি?”
“দুপাশে ছানার জিলিপির মত চাপড়, মাঝখানে পুরু করে দেওয়া ক্ষীর আর রাবড়ির স্তর। একেকটা বড় আমড়ার মত সাইজ। জিভে দিলেই মিলিয়ে যেত।” মিষ্টিপাগল আমার শুনেই জিভে জল আসত, “সে তো দারুণ খেতে হবে গো। কী নাম মিষ্টিটার?”
দিদিমার লোলচর্ম মুখে যেন এক আলোর আভা খেলে যেত, প্রায়ান্ধ চোখদুটো ঝিকমিক করত, “মিষ্টিটার নাম ছিল উপঢৌকন। শুধু আমাদের ওখানেই পাওয়া যেত, জানিস। ছোটবেলায় আমাদের রেজাল্ট বেরোলে বাবা নিয়ে আসতেন। কিন্তু পুটুদাদা চলে যাওয়ার পর থেকে আর ও মিষ্টি বাড়িতে ঢোকেনি। সব ভুলে গেছি, শুধু ওই উপঢৌকনের স্বাদ কেন ভুলতে পারি না বল দিকি! এই চিতায় ওঠার বয়সেও খেতে বড় সাধ হয়। পুটুদাদার মুখখানা মনে পড়ে। তোদের ওই আমাজন না কী বলে, ওরা দিয়ে যেতে পারবে না?” আন্তর্জাতিকস্তরে মিষ্টি সাপ্লাই করা আমাজনের ক্ষমতা নয়, তাছাড়া উপঢৌকন কোনও বিখ্যাত মিষ্টিও নয়। আঞ্চলিক কোনও খাবার এইভাবে আনব কী করে? আমি আর দাদাভাই আলোচনা করে নেতিবাচক মাথা নাড়তাম। ….
গত একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতির আমন্ত্রণে পেট্রাপোল বেনাপোল সীমান্ত পেরিয়ে গিয়েছিলাম ওপারে। তুমুল আতিথেয়তা আন্তরিকতা পেরিয়ে বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া প্রকাণ্ড মিষ্টির হাঁড়িসহ আরো নানা উপহার নিয়ে বাড়ি ফিরলাম, আমার বাড়িতে যিনি থাকেন সেই মাসি হাঁড়ি খুলেই চমকে উঠল, “ওরে বাবা, এতো একমাস ধরে খাওয়ার মিষ্টি। কতরকম মিষ্টি গো, সঙ্গে গুড়ও রয়েছে।”
“চাপ নিও না। একমাসের মিষ্টি হোক আর এক বছরের, তিনদিনে সাবড়ে দেব। শিগগীরই একটা করে স্যাম্পল দাও দেখি!”
“খাও আর দিনে দিনে ওজন বাড়াও।“
মাসি গজগজানির মধ্যেই প্লেট সাজায়। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে মিষ্টির প্লেট নিয়ে বসতেই আমার চোখ আটকে যায় একদিকে। নানারকম চেনা অচেনা মিষ্টির মাঝে একজন যেন বড় পরিচিত। দুপাশে ছানার জিলিপির মত চাপড়, মাঝখানে পুরু করে দেওয়া ক্ষীর আর রাবড়ির স্তর!
উত্তেজনায় আমার বুক কেঁপে ওঠে, হাতে তুলে নিয়ে ভাল করে পরখ করতে থাকি। হ্যাঁ, কোনও সন্দেহ নেই। এই সেই ‘উপঢৌকন’ যা দিদিমা বারবার খেতে চাইতেন। এই সেই মিষ্টি, যা দিয়ে ছুঁতে চাইতেন ছোটবেলায় মরে যাওয়া পুটুদাদাকে।
পুটুদাদা সেই কবে ওদেশের শ্মশানে ছাইধুলোমাটি হয়ে প্রকৃতিতে মিশে গেছে। দিদিমাও না ফেরার দেশের টিকিট কেটেছেন ২০১৯ সালে। তবু এতদিন পর তাঁর সাধের উপঢৌকন পেয়ে আমার চোখ জলে ভরে এল। বাংলাদেশ সরকার প্রেরিত এই ‘উপঢৌকন’ এর জন্য তাঁদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ রইলাম!
জীবন কী বিচিত্র! প্রজন্মের পর প্রজন্ম এভাবেই সে ঘুরপাক খায়। আপন গতিতে। আপন ছন্দে। আমরা ক্রীড়নক মাত্র!
বিশিষ্ট লেখিকা, ইঞ্জিনিয়ার, ম্যানেজমেন্ট উত্তীর্ণ, বহুজাতিক সংস্থার প্রাক্তন আধিকারিক।
সূত্র— ফেসবুক।
সঙ্কলন— অশোক সেনগুপ্ত।