পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের স্মৃতি (৭)

অশোক সেনগুপ্ত
আমাদের ভারত, ১৬ অক্টোবর: ধুলায় ধূসর রামমালা পাঠাগার
“ঐতিহ্যের রামমালা গ্রন্থাগার এখন ধুলোবালিতে ধূসর। তালপাতা, ভোজপাতা ও কাঠের মধ্যে খোদাই করা বাংলা ও ভারতীয় সংস্কৃৃতির দুর্লভ পুঁথি ধুলোবালি আর পোকা-মাকড়ে বিনষ্ট হচ্ছে।”

২০২১-এর ২৮ জুলাই এটা লিখেছিল বাংলাদেশের ‘আগামী নিউজ’। কুমিল্লা জেলার বিটঘর গ্রামের বাসিন্দা (বর্তমানে নবীনগর উপজেলার অন্তর্গত) মহেশ ভট্টাচার্যর অপরিসীম শ্রম ও দানের ওপর নির্ভর করেই এটি গড়ে ওঠে।

বাংলাপিডিয়া-তে সাইমন জাকারিয়া জানিয়েছেন, “রামমালা গ্রন্থাগার (১৯১২) ঢাকা থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরের একটি মফস্বল শহর কুমিল্লায় অবস্থিত একটি শতাব্দী-প্রাচীন গবেষণা গ্রন্থাগার। এখানে সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ভূগোল, দর্শন, ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ক দুস্প্রাপ্য ১২ হাজার গ্রন্থ ও সাড়ে আট হাজার  হাতে লেখা পুঁথির সংগ্রহ রয়েছে। সংরক্ষিত হাতে লেখা পুঁথির মধ্যে অধিকাংশই বাংলাসাহিত্যের মধ্যযুগের সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক।

কিন্তু আজ পর্যন্ত সেগুলোর মধ্যে খুব কম পুঁথিরই পাঠোদ্ধার করা গেছে। গ্রন্থাগারটির আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে- এখানে প্রবাসী থেকে আরম্ভ করে শনিবারের চিঠি, মৌচাক, পূর্বাশা ইত্যাদি বাংলাভাষার দুর্লভ পত্রিকাসমূহ সংরক্ষিত হয়েছে। এছাড়া এখানে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের বইয়ের সংগ্রহ রয়েছে। তুলোট কাগজে লেখা প্রাচীন পুঁথি, দুর্লভ বই, ধর্মগ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার অমূল্য সংগ্রশালা এই গ্রন্থাগার দেশী-বিদেশী পন্ডিত-গবেষকদের নিকট প্রিয় পাঠাগার হিসেবে গৃহীত হয়ে আসছে।

রামমালা পাঠাগার শুধু বাংলাদেশের গবেষকদের জন্য নয়, দক্ষিণ এশীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি-ধর্ম-দর্শন বিষয়ে গবেষণার প্রয়োজনে এই গ্রন্থাগার ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিশেষ করে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, জাপানের গবেষকগণ গ্রন্থাগারটি অধিক ব্যবহার করেছেন।

মহেশ ভট্টাচার্যের গ্রাম বিটঘর সুপ্রাচীনকাল থেকেই বিদ্যাশিক্ষায় অগ্রণী ছিল। কিন্তু মহেশ ভট্টাচার্যের পরিবার দারিদ্র্য-পীড়িত ছিলেন বলে তিনি পড়াশোনার বদলে ভাগ্যান্বেষে শৈশবেই কুমিল্লা চলে আসেন। জানা যায়, মহেশ ভট্টাচার্য ভালো রান্না করতে পারতেন। কুমিল্লায় এসে তিনি প্রথমে কয়েকটি বাড়িতে পাচকের কাজ নেন। কিছুদিন পর এই কাজ করে তাঁর হাতে কিছু টাকা-পয়সা জমলে তিনি স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু সেখানেও তাঁকে অর্থের অভাবে কয়েক বছরের জন্য লেখাপড়া বন্ধ করে রাখতে হয়।

পরে তিনি বিভিন্ন কাজের পারিশ্রমিক হিসেবে কিছু অর্থকড়ি রোজগার করেন এবং ‘ভট্টাচার্য অ্যান্ড কোং’ নামে একটি হোমিওপ্যাথি ওষুধের দোকান খোলেন। এবার তাঁর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়। তিনি অনেক অর্থের মালিক হন। মূলত সেই অর্থ দিয়েই তিনি মায়ের নামে নিবেদিতা স্কুল ও ঈশ্বর পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করেন এবং ছাত্রদের থাকার জন্য রামমালা ছাত্রাবাস নির্মাণ করেন।

একই সঙ্গে বিরাট একটি নাটমন্দির নির্মাণ করেন। এখানেই তৎকালীন কুমিল্লার সভা-সমিতি, সংগীত ও বিচিত্র ধরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। মহেশ ভট্টাচার্য রামমালাকে মূলত একটি কমপে­ক্স হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন, পরে রামমালা পাঠাগারের তত্ত্ববধান ও এই গ্রন্থাগারের বইপত্র কেনার জন্য রাসমোহন চক্রবর্তীকে চাঁদপুর থেকে কুমিল্লা নিয়ে আসেন।

এই রাসমোহন চক্রবর্তী আজীবন নিজ সন্তানের মতো রামমালা পাঠাগারকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। তিনি ছিলেন অকৃতদার, পড়াশোনাই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত। মূলত তাঁর নীরব- নিভৃতের তপস্যায় এবং মহেশ ভট্টাচার্যের অর্থায়নে রামমালা পাঠাগার একটি আদর্শ গবেষণা গ্রন্থাগারে রূপ নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলা একাডেমীর মতো জাতীয় প্রতিষ্ঠান ছাড়া রামমালা পাঠাগারের মতো প্রাচীন পুঁথির সংগ্রহশালা আর কোথাও নেই।”

জ্ঞানচর্চার সেই পীঠস্থানের আজ কী হাল? ‘আগামী নিউজ’-এর রিপোর্টে লেখা, “অযত্ন-অবহেলা আর সংরক্ষণের অভাবে দিন দিন ধ্বংসের পথে যাচ্ছে শতবর্ষের রামমালা গ্রন্থাগারের দুর্লভ সব পাণ্ডুলিপি।

মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা পাপন পাল বলেন, বর্তমানে এ প্রাচীন গ্রন্থাগারের বইগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আর্কাইভের মতো করে বড় আকারের আধুনিক লাইব্রেরির মাধ্যমে দুর্লভ বই ও পুঁথিগুলো সংরক্ষণ করা গেলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম উপকৃত হবে। সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও সরকার নজর  বা খেয়াল  না নিলে গ্রন্থাগারটি আরও বেহাল হয়ে পড়বে। রামমালা গ্রন্থাগারের প্রধান গ্রন্থাগারিক ইন্দ্র কুমার সিংহ বলেন, “পুথিগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ এখনই নিতে হবে, নইলে নষ্ট হয়ে যাবে।“ কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, “এগুলো জাতীয় সম্পদ, আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্বার্থে এগুলো সংরক্ষণ করা দরকার।”

উক্তিগুলো শুনে মনে এসে গেল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সেই লেখা— “লাও তো বটে, কিন্তু আনে কে?“ ওখানকার প্রশাসকরা কেউ কি খোঁজ করেছেন, ঐতিহ্যের এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ভট্টাচার্য পরিবারের খবর?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *