পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের স্মৃতি (৪২), মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ি

আমাদের ভারত, ৪ ডিসেম্বর: এককালের দাপুটে জমিদারদের বসবাসের বাড়িগুলোই বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসাবে খুঁজে পাওয়া যায়। কালের বিবর্তনে টিকে থাকা তেমনি এক শতবর্ষী জমিদার বাড়ি নারায়ণগঞ্জের রুপগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ি বা মঠেরঘাট জমিদার বাড়ি। যা বর্তমানে টিকে থাকা জমিদার বাড়িগুলোর মধ্যে বেশ আকর্ষণীয়। ডে আউটিং বা দিনে ঘুরতে গিয়ে দিনেই ফিরে আসবার জন্য মুড়াপাড়া হতে পারে আদর্শ নির্বাচন।

১৮৮৯ সালে প্রায় ৬২ বিঘা জমির উপর বাবু রামরতন ব্যানার্জির প্রতিষ্ঠিত এই জমিদার বাড়ি বেশ কয়েকবার সংস্কার করা হয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে বাবু রামরতন ব্যানার্জির বংশধরেরা মূল ভবনের সামনের ও পেছনের অংশ সম্প্রসারণ, পুকুর খনন ও দালানের উঁচুতলার কাজ করেছেন। মুড়াপাড়া জমিদার বাড়িতে কারুকার্যমন্ডিত ৯৫ টি কক্ষ, মন্দির, ভান্ডার, কাছারি ঘর, অতিথিশালা ও বৈঠকখানা, আস্তাবল, দৃষ্টিনন্দন নাচের ঘর এবং সামনে ও পিছনে দুইটি পুকুর রয়েছে। ভবনের প্রবেশের মুখে বিশাল ফটক জমিদার বাড়ির বিশালতার আভাস দেয় আগে থেকেই। এছাড়া দালানের মন্দিরের চূড়াটি প্রায় ৩০ ফুট উঁচু।

মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানার অতি পরিচিত একটি স্থান। এটি ঢাকা থেকে ২৫ কি.মি. দূরে নরসিংদী রোডে অবস্থিত। জমিদার রামরতন ব্যানার্জি ১৮৮৯ সালে ৪০ হেক্টর জমির উপর নির্মাণ শুরু করেন মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ি। তিনি নাটোর স্টেট এর কোষাধ্যক্ষ ছিলেন এবং তার সততার কারণে একটি উচ্চ পদে উন্নীত হন। কিন্তু প্রচলিত আছে, রামরতন ব্যানার্জি শুধু এই বাড়িটির ভিত্তি ও কাঠামো তৈরি করেছিলেন, কিন্তু তার মৃত্যুর পর তার পুত্র প্রতাপ চন্দ্র ব্যানার্জি ১৮৮৯ সালেই তার পুরনো বাড়ি ছেড়ে পেছনে আরো একটি প্রাসাদ তৈরি করেন। বিশাল এই জমিদার বাড়িতে প্রায় একশত’র উপরে কক্ষ রয়েছে, যার প্রায় সবগুলোতেই পাবেন কারুকার্যের ছোঁয়া।

এই জমিদার বাড়িতে রয়েছে কাছারিঘর, অতিথিশালা, নাচঘর, পুজা মণ্ডপ, বৈঠকখানা, ভাঁড়ার সহ বিভিন্নভাগে ভাগ করা অংশ। ১৯০৯ সালে জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জি ভবনটি সম্পন্ন করেন এবং নিজেই একজন জমিদার হয়ে ওঠেন। জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জি একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন, কারণ তিনি দুই বার দিল্লীর কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত হন। জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জি তাঁর শাসনামলে অনেক কিছু তৈরি করেছিলেন প্রজাদের জন্য। অন্যদিকে তিনি সেই প্রজাদের প্রতি ছিলেন অনেক কঠোর। তিনি একজন শক্তিশালী জমিদার ছিলেন। তাঁর শাসনামলে কোনো প্রজা যদি সময়মতো খাজনা না দিতো তাহলে তিনি তাদের মাথার চুল কেটে দিতেন এবং অনেক সময় তাদের ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিতেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির সময় জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জি কলকাতা চলে যান।

এখনো টিকে থাকা জমিদার বাড়িগুলোর মধ্যে ঢাকার খুব কাছেই রয়েছে বেশ কয়েকটি, যার মধ্যে এই মুড়াপাড়া জমিদার বাড়িটি অন্যতম। জমিদার বাড়ির মূল ভবনটিই মুরাপাড়া ডিগ্রী কলেজ ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তার পাশে ১৯৯৫ সালে আরও একটি প্রশাসনিক ভবন নির্মিত হয়। আরও অনেক জমিদার বাড়ি’র মত এটিও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে। তবে দেশের বেশিরভাগ জমিদার বাড়ির চাইতে তুলনামূলক ভালো অবস্থায় রয়েছে এই জমিদার বাড়িটি। কিন্তু মূল ভবনের পেছন দিকে চলে গেলে দেখা যায় কিভাবে ক্ষয়ে যাচ্ছে এই জমিদার বাড়িটিও।

লেখা— আদার ব্যাপারী, ভ্রমণ গাইড।
ছবি— ভ্রমণ গাইড।
সঙ্কলন— অশোক সেনগুপ্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *