আমাদের ভারত, ২৪ নভেম্বর: আমার জন্মভূমি ছিল ঝালকাঠির বাগমরা গ্রাম।আজ সত্তর বছর পর আমি আমার সেই ভিটা খুঁজে পেয়েছি। তবে তার এখন আর বাগমরা নাম নেই, আজকের নাম হল সংগ্রামনীল।
এই জীবনে দেশভাগের সময় ফেলে আসা ঘরবাড়ির দুয়ারে আবার যে ফিরে যেতে পারব তাই তো ভাবিনি। কিন্তু অনেক সাধ্য সাধনার পর আজ যখন খুঁজে পাওয়া ভিটার দুয়ারে পা দিয়ে যে কি আনন্দ হয়েছিল তার বলে বোঝাতে পারবো না। যে বাড়িতে আমি জন্মেছি, খেলাধূলা করেছি, লেখা পড়া করেছি, গাছে গাছে আম জাম কুড়িয়েছি, ফুল পেড়েছি, ধান রোদে দিয়েছি যে উঠোনে,স্নান করেছি যে পুকুরে — সবই যেন আজ কোথায় হারিয়ে গেছে। বাড়ির পিছনে একটি খাল ছিল, নৌকো ভিড়ত সেই খালে, খালের উপর একটি পোল ছিল, যা আজ আর নেই। আমার স্বপ্ন ছিল বাড়ি গেলে সব জায়গায় ঘুরে বেড়াব, পুকুরের জল ছুঁয়ে দেখব, মন্দিরের ভিতে প্রণাম করব– যেমন ছোটবেলায় করতাম। উঠানের উপর হেঁটে বেড়াব —- কিন্তু না, আমার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল। পূরণ হল না। আসলে পূরণ বুঝি হয় না — মধ্যখানে এতগুলো বছর পার হয়ে গেছে যে।
আমাদের ঘরের ভিতের উপর ছিল বাতাবি লেবু গাছ, যেখানে ফুল, আম, জাম কুড়াতাম সেই বাগানে এখন মেহগনি গাছ। মন্দিরের ভিত এখন চলাফেরার রাস্তা। যে পুকুরের জল ছিল টলটলে, তা আজ কালো হয়ে আছে। যেখানে মাছে ঘাঁই মারত আর আমরা আনন্দে উৎফুল্ল হতাম — তা আজ কোথায়? আজ আর খালে নৌকা আসে না। জঙ্গলে কচুরিপানায় ভরা সেই খাল। আজ গাছে গাছে ভরা উঠোনে রৌদ্রের আলোও প্রবেশ করতে পারে না। আঠাশ বিঘা জমিতে ছিল দাদামশাইয়ের তৈরি করা সম্পত্তি, যা এখন শুধুই গাছে গাছে ভরা। আমি সত্তর বছর আগে যেদিন বাগমরা গ্রাম শেষ ছেড়ে আসছিলাম সেই স্মৃতি আজো চোখে ভাসে। আমার দাদামশাই তখনও দেশে রয়ে গিয়েছিলেন। তিনি আমাদের ঘরের দাওয়ায় খুঁটি ধরে উদাস নয়নে তাকিয়ে ছিলেন, আর আমি ওঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিলাম।
আজ এই সব স্মৃতি মনে পড়ছে, সত্তর বছর পেরিয়ে যখন কোনো ছবিই মেলাতে পারছি না, তখন খুব কষ্ট হচ্ছে, খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে, বলতে ইচ্ছে করছে কেন এমনটা হল?
আমার মামার বাড়ি ছিল স্বরূপকাঠি। বড় মামার নাম ছিল ললনা ভূষণ দত্ত। এত বছর পর যখন আমি সেই মামাবাড়ি খুঁজে পেলাম দেখি আমরা যে পুকুরের ঘাটে স্নান করতাম সেই পুকুরঘাটটি আজ আর নেই। আশপাশের লোকজন সেই ঘাট, সেই জমি, ভিটাতে বসবাস করছে। ছোটবেলায় মামাবাড়ি আসার দিনগুলোর কথা আজ মনে পড়ে যাচ্ছিল।বসেই খালের উপর আজ কত বড় ব্রিজ, বাজারঘাট, শোরুম– কত না পরিবর্তন এই এত বছরে! বুঝলাম সেই মামার বাড়িও আজ আর নেই।
এছাড়াও এবারের ভ্রমণের আরেক পাওয়া আমার স্বামীর ভিটেমাটির সন্ধান— কুমিল্লার বিজরা বাজারের কাছে উধোর গ্রামে। যেখানে বাড়ি, পুকুর, দিঘি, আত্মীয়ের বাড়ি– সবই খুঁজে পাওয়া গেল। আমার স্বামী তো আনন্দে এমন আত্মহারা হয়ে পড়লেন, যেন তিনি দশবছরের ছেলে। কোথায় কোন বন্ধুর বাড়ি, কোথায় ঢেকি ঘর, কোথায় বৃদ্ধ বটগাছ, কোথায় সত্তর বছর আগে বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল সব ওঁর চোখে যেন ভেসে উঠলো। এই গ্রামের এক ভদ্রলোক ওঁকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গ্রাম দেখালেন, কত গল্প করলেন।বএরপর আমরা গেলাম আমার স্বামীর সেই স্কুলে যেখান থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন। তারপর আমার শ্বশুরমশাই সম্পত্তি বদল করে আগরতলা চলে যান। সেই স্কুলের নাম হরিশ্চর হাই স্কুল, যেটি বর্তমানে একটি কলেজও। সেই স্কুলে আজ যখন ঢুকলেন সে এক অসাধারণ দৃশ্য— আমার স্বামী নিজের পুত্র, নাতিকে নিয়ে স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে একটি স্মারক কলম উপহার পেলেন। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে ফেলে যাওয়া স্কুলের উপহার একটি বিরাট পাওনা। আজকের ছাত্ররা, শিক্ষকরা অবাক হয়ে সে এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছিলেন।
আমাদের এই পুর্বপুরুষের ভিটামাটির সন্ধানে ভ্রমণের পরিকল্পনা ও সৃজন যার সাহচর্যে সম্পন্ন হল তিনি হলেন আমার ভাই সুদীপের ওদেশের বন্ধু চিন্ময় রায়। ওঁর স্ত্রীর সহকর্মী ঝালকাঠি সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার চিত্ত বড়াল এবং নার্স স্ত্রী অপর্ণা বড়াল আমাদের ঝালকাঠি ভ্রমণকে মসৃণ করেছেন তাদের অকৃত্রিম আতিথেয়তা দিয়ে। এছাড়াও ঢাকা ভ্রমণে আমাদের পারিবারিক বন্ধু রাজীববাবু ও জয়ের অবদান ভোলার নয়।
————–
বিনীতা:– মমতা মজুমদার কলকাতা-৭০০০৭০
সূত্র— ‘বাংলায় লিখুন’ ফেসবুক গ্রুপ। সঙ্কলন— অশোক সেনগুপ্ত।

