অশোক সেনগুপ্ত
আমাদের ভারত, ১৩ নভেম্বর: সীমাহীন সমৃদ্ধি, প্রাচীন পেল্লাই বসতবাড়ি— পদ্মার কড়াল গ্রাসে অন্তর্হিত। তেলিরবাগ ছিল ঢাকা জেলায় বিক্রমপুরের একটি গ্রাম। বহুকাল আগেই পদ্মার তলদেশে বিলীন হয়ে গেছে। এই পরিবারের সদস্য ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, সুধী রঞ্জন দাশ (প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি), সরল রঞ্জন দাশ (নেপালের মহারানাদের চিকিৎসক এবং বিধান চন্দ্র রায়ের সহকর্মী) এবং অন্য কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি।
সম্ভ্রান্ত এই পরিবারের প্রবীন সদস্য দেবরঞ্জন দাশগুপ্ত (৭৪)। তিনি জানান, “আমার বাবার জন্ম ১৯১১-তে। আমার জন্ম কলকাতায়, ১৯৪৮-এ। বড়রা আর নেই। ওপার বাংলার যে সব কথা শুনেছিলাম এখন আর সেরকম মনে নেই। সম্বল বলতে কিছু ধূসর স্মৃতিমাত্র।“ বিক্রমপুর পরগণার তেলিরবাগ গ্রামের এই বংশে বহু খ্যাতনামা ব্যক্তি জন্মেছিলেন। পরিবারের প্রবীন সদস্য কালীমোহন দাশ ছিলেন প্রসিদ্ধ ব্যবহারজীবী। ১৮৩৮ খ্রী: জুলাই মাসে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। দুর্গামোহন দাশ ছিলেন তাঁর কনিষ্ঠ সহোদর। দেশবন্ধু চিত্ত রঞ্জন দাস তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র।
অর্জিত সম্পত্তির অধিকাংশ দেশবন্ধু দেবসেবা ও জনহিতকর কাজে দান করে যান। ১৯২৫ খ্রিঃ অব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। পরিবারের অন্যতম সদস্য ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের বোন উর্মিলা দেবী (১৮৮৩-১৯৫৬ খ্রি )। বাবা ভুবনমোহন দাস, মা নিস্তারিণী দেবী। অসহযোগ আন্দোলনে যে তিনজন বাঙালী মহিলা প্রথম আইন অমান্য করে স্বাধীনতা-সংগ্রামের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন, উর্মিলা দেবী তাঁদের অন্যতম। এই পরিবারের মেয়ে ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের কন্যা অপর্ণা দেবী (৬-১১-১৮৯৯ – ১০-৭-১৯৭৩)। স্বামী ছিলেন ব্যারিস্টার সুধীরচন্দ্র রায়।
১৯১৬ সালে তাঁর বিয়ে বাঙলায় হিন্দু শাস্ত্রানুসারে প্রথম অসবর্ণ বিয়ে। ১৯১৯ খ্রী. থেকে নিখিল ভারত কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন। তাঁদের বাড়ি দেশকর্মী ও বিপ্লবীদের আশ্রয়স্থল ছিল। বৃন্দাবনের বিখ্যাত নবদ্বীপচন্দ্ৰ ব্ৰজবাসীর ছাত্রী। বৈষ্ণব দর্শন সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান ছিল। বাঙলা দেশে কীর্তনের পুনরুজ্জীবনের ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। শিক্ষিত অভিজাত মেয়েদের নিয়ে তিনি ‘ব্রজমাধুরী সঙ্ঘ’ নামে সম্প্রদায় গঠন করেন। তিনি ও তাঁর স্বামী কীর্তন প্রচারের জন্য ত্ৰিশের দশকে ইউরোপ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ সফর করেছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থের মধ্যে ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন এবং কীর্তন পদাবলী জনপ্রিয়।
১৯২১ খ্রীষ্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর উর্মিলা দেবী, সুনীতি দেবী ও দেশবন্ধুর সহধর্মিণী বাসন্তী দেবী সরকারি নিষেধ অমান্য করে রাজপথে খদ্দর বিক্রি করে তৎকালীন যুবরাজের আগমন উপলক্ষে ২৪ ডিসেম্বর হরতাল পালন করার আহ্বান জানান। পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করে। এর ফলে বিশেষ আলোড়ন তৈরি হয়। এই দৃষ্টান্তে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলার অন্যত্র অনেক মহিলা অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। এই সময়ে উর্মিলা দেবী কলকাতায় ‘নারী-কর্মমন্দির’ প্রতিষ্ঠা করেন। পরিবারের আরও কিছু বিশিষ্ট সদস্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছেন।
বহু পুরুষ ধরে পূর্ববঙ্গের স্মৃতিমাখা এই পরিবারের আর কোনও যোগাযোগ নেই সাত পুরুষের ভিটের সঙ্গে। নদীগর্ভে তেলিরবাগ গ্রাম নিশ্চিহ্ণ হয়ে যাওয়ার পর ফরিদপুরে দ্বিতল ভবন তৈরি করায় দাস পরিবার। তেলিরবাগে দাস পারিবারের দুর্গাপূজা প্রায় ৩০০ বছর আগের। সরল রঞ্জন দাস গত শতকের ত্রিশের দশকে মধ্য কলকাতায় শশীভূষণ দে স্ট্রিটে তৈরি করেন ‘তেলিরবাগ ভবন’। চল্লিশের দশকের প্রথমার্দ্ধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পুজোটিকে এই বাড়িতে নিয়ে আসেন। আজও তার বংশধররা তা বাঁচিয়ে রেখেছে। দেবরঞ্জনবাবু জানান, পূর্ববঙ্গে “আমাদের বাড়ির পুজোয় যাঁরা ঢাক বাজাতেন, পরে তাঁরাই কলকাতায় এই বাড়িতে ঢাক বাজাতে আসতেন। দেশভাগের ঠিক পরেও মহালয়ার সময় ওপার বাংলার অনেক ঢাকি দল বেঁধে ট্রেনে করে চলে আসতেন আমাদের বাড়িতে। তখন পুজোপ্রাঙ্গণ ছিল একতলায়। ওঁরাও এখানে কদিন থাকতেন। তারপর শহরের নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়তেন ঢাক বাজানোর বরাত নিয়ে।
সরল রঞ্জন দাশ নেপাল থেকে একটি বড় দুর্গার পট নিয়ে আসেন। প্রথমদিকে ২-৩ বছর সেটায় পুজো হয়। পরে প্রতিমা তৈরি হত কুমোরটুলিতে। কিন্তু ওই ভবন আর পুজোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গিয়েছে তেলিরবাগ স্থাননাম। ইতিহাস এভাবেই বুঝি চিরস্থায়ী হয়ে ওঠে।
দেবরঞ্জনবাবু জানান, “দেশভাগের আগে সেটি ছিল দুখিরাম নামে পরিবারের এক কাজের লোকের হেফাজতে। বাড়িটির একটা অংশ সরকারি দফতরকে ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। ভাড়ার টাকা পাওয়ার বালাই নেই। কারণ, শত্রু সম্পত্তি হিসাবে বাড়িটি যায় সরকারের হাতে। আর কোনও খবর রাখেননি পরিবারের বর্তমান শরিকরা।“
এই লেখায় ব্যবহৃত ছবিটি জমিদারবাবু শৈলেন্দ্রনাথ সাহার বাড়ি। শত্রু সম্পত্তি (পরিত্যাক্ত সম্পত্তি) জনস্বার্থে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অধিগ্রহণ করেন। ঢাকা, কুমারী আলমডাঙা চৌডাঙায়।
সূত্র- ফাউজুল আহসান।
সেভ দি হেরিটেজেস অফ চট্টগ্রাম।