‘এখনও কীর্তনখোলা? এখনও কি আছে সেই নাম? …আমার শরীর শুধু জেগে ওঠে তার কাছে গেলে।’
আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়
আমাদের ভারত, ১১ নভেম্বর: দেশভাগের ক্ষত যে সমাজ-শরীরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে আমাদের জীবনবোধ ও ব্যবহারবিধিকে, আমাদের শব্দ ব্যবহার ও আবেগভঙ্গিকে আমূল বদলে দিয়েছে, তার কিছু বিক্ষিপ্ত বিধৃতি আছে সাহিত্যে। পূর্ববঙ্গের ভিটে থেকে উৎখাত হয়ে এপারে কিছুকাল দমদমে উদ্বাস্তু কলোনির গা ঘেঁষে ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ‘অর্জুন’ তাঁর বিখ্যাত কলোনিভিত্তিক উপন্যাস। তাঁর একটা কবিতা এইরকম—
‘…আমরা সকলেই ভাঙনের প্রবক্তা/ ধ্বংসেই আমাদের উল্লাস/ ঈশ্বর থেকে সুধীন্দ্রনাথ-বুদ্ধদেব বসুর ছন্দ পর্যন্ত আমরা ভাঙতে ভাঙতে এসেছি/ কৃষ্ণনগরের পুতুলের মতন আমরা ভেঙেছি বাবা ও মাকে/ প্রেমকে ভেঙেছি অতিরিক্ত শরীর মিশিয়ে/ শরীরকে ভেঙেছি আত্মহননের নেশায়/ দেশকে যারা ভেঙেছে আমরা মহানন্দে ভেঙেছি তাদের ভাবমূর্তি/ কাচের গ্লাস ভাঙার মতন সুমধুর শব্দে/ আমাদের পায়ের তলায় গুঁড়ো হয়েছে এক-একটা মূল্যবোধ…।’
‘স্মৃতির শহর ২০’ নামে এই কবিতায় ষাটের দশকের সেনেট হল ভাঙা নিয়ে লিখতে গিয়ে সুনীল স্মরণে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, ওঁরা ওই সময় সবই ভাঙছিলেন। বিংশ শতকের ওই দশকে কাউন্টার কালচার, ভিয়েতনাম, হিপি আন্দোলন, হাংরি জেনারেশন, গিনসবার্গের কলকাতা ভ্রমণ, বিশ্বজোড়া ছাত্রবিদ্রোহ, নকশালবাড়ির বজ্রনির্ঘোষ এবং মনীষীদের মূর্তিভাঙ্গার মধ্যে বাংলায় চারিয়ে যাচ্ছিল যে পিতৃমাতৃঘাতী ক্রোধ, তার তলায় অন্তঃসলিলা ফল্গুনদীর মতো কি আসলে কাজ করেনি ওই দেশভাঙার, ভিটেছাড়ার, আমূল দুঃখ?
সুনীল বোধহয় সেই হদিশই দিয়েছেন। সমস্ত শ্রদ্ধা, শৃঙ্খলা, ব্যাকরণ, ছন্দ ও নিয়ম ভাঙার প্রস্তাব নিহিত ছিল বাধ্যতামূলক দেশত্যাগে। শরীর, মন সবই তো ভেঙে যায়, মরে যায়, বাধ্যতার পরবাসে। যেমন বলেছেন উদ্বাস্তু শঙ্খ ঘোষ, বাল্যের নদীকে স্মরণ করে—
‘এখনও কীর্তনখোলা? এখনও কি আছে সেই নাম? …আমার শরীর শুধু জেগে ওঠে তার কাছে গেলে।’
আত্মার মৃত্যু কি জন্ম দেয় তুমুল ঘৃণার? বাস্তুচ্যুত অশোক মিত্র যে বারবার শ্রেণিঘৃণার কথা বলতেন এবং জানান দিতেন, যে তিনি ভদ্রলোক নন, কমিউনিস্ট — তার মধ্যেও আমি ওই বাল্যক্রোড় বিচ্ছেদবেদনাকে আবিষ্কার করি। সর্বস্বচ্যুত উদ্বাস্তুর জমি জবরদখল, জমিদারের জমিতে, সরকারের এস্টেটে, নদীর তীরে, ক্যানালের ধারে, রাস্তার পাশে ও ফুটপাথের উপর, নির্ধনের কলোনি স্থাপন প্রভৃতি বৈপ্লবিক কাজ ধীরে ধীরে নেহাতই এলাকায় উপনিবেশ পত্তনে পরিণত হয়। কিন্তু সেই দখলদারির আদি নৈতিক বা ঐতিহাসিক সূত্র-সংযোগটিও হয়তো পাওয়া যাবে ’৪৬-’৪৭ সালের হানাহানি-দেশভাগে। পূর্ববঙ্গের আরেক ভিটেছাড়া কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী অন্তত এই রকম একটা ইঙ্গিত দিয়েছেন তাঁর ‘ভাগাভাগির খেলা’ কবিতায়। ২০০৭ সালে তাঁর মনে পড়ে যায় দেশভাগের কথা—
‘ভাগাভাগির খেলা, সাতচল্লিশে দেশভাগ। তখন / ঘরছাড়া হয়ে/ রাতারাতি যাঁরা সীমানা পেরিয়ে / আশ্রয়-শিবিরে এসে উঠেছিলেন, / তাঁদের অনেকেই আজ আর / বেঁচে নেই। / যাঁরা মরেননি, তাঁরা এখন আবার / নতুন করে দেখতে পাচ্ছেন / ভাগাভাগির খেলা।
‘এ-খেলা আপাতত এলাকা ভাগাভাগির। এবং / নতুন করে ফের / মানুষকে তার ভিটেমাটি থেকে উৎখাত করে / আশ্রয়-শিবিরে ঢুকিয়ে দেবার। / তুমি তো আমার লোক নও, তা হলে / এখানে তোমার জায়গা হবে না, / ভাগো। / এ-খেলা যেমন কেশপুরে আর গড়বেতায় চলেছিল, এখন / তেমনি চলছে খেজুরি আর নন্দীগ্রামে।
‘মরিনি বলেই এই খেলাটা আমিও দেখে যাচ্ছি। / দেখছি আর ভাবছি যে, / সাতচল্লিশ থেকেই বোধহয় ভাগাভাগি-খেলার এই / নেশাটা আমাদের রক্তের মধ্যে ঢুকে গেছে। / দেখছি আর ভাবছি যে, / ভাগের মা গঙ্গা না-ই পাক, এই ভাগাভাগির / নেশাই আমাদের গঙ্গাযাত্রা করিয়ে ছাড়বে।’
সুনীল বলছেন, আমাদের ভাঙনের নেশা দেশভাগজনিত। শঙ্খ বলছেন, আমাদের আত্মার মৃত্যুবোধ দেশভাগজনিত। নীরেন্দ্রনাথ বলছেন, আমাদের ভাগাভাগির নেশাও দেশভাগজনিত। আমাদের বাক্যে-ব্যবহারে-আচরণে-আবেগপ্রকাশে দেশভাগের নিত্যকার এইসব ধারাবাহিক প্রভাব নিয়ে সচেতন হওয়া ভাল নয়? একদা আপন-আপন বাড়ি, জমি, গ্রাম, গোষ্ঠী, কৌম সমাজ থেকে আমাদের উৎপাটিত করা হয়েছিল বলেই কি আমরা এখন মাঝে মাঝে একটু বেশি শ্রদ্ধাহীন, বাচিক ও কায়িক হিংসার একটু বেশি বশবর্তী ও অন্যের জমিজিরেত-জীবনযাপনের প্রতি একটু বেশি ক্রোধদৃষ্টিপরায়ণ হয়ে পড়ি? ভাবা দরকার, শোধরানোও দরকার।
(লেখক রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব, বাংলা ভাষার আলোচক)
সূত্র— আনন্দবাজার পত্রিকা। ৩০ এপ্রিল, ২০২২।
সঙ্গের ছবিতে আবদুল্লাপুর গ্রামে অবস্থিত পাল বাড়ি। একগুচ্ছ ছবি-সহ মহম্মদ আরমান লিখেছেন, মুন্সীগঞ্জ জেলার টংগিবাড়ী উপজেলার এই বাড়ির নির্মাণশৈলী দেখে অনুমান করা যায় বাড়িটি প্রায় শতবর্ষী প্রাচীন।
সঙ্কলন— অশোক সেনগুপ্ত।