আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়
আমাদের ভারত, ১০ নভেম্বর: নবাবি আমলে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা মিলিয়ে ছিল মুঘল সুবা, ইংরেজ আমলেও বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি ছিল আজকের উত্তরপ্রদেশের পূর্ব সীমান্ত থেকে বর্মামুলুকের ধার পর্যন্ত। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কলকাতা থেকে শাসিত হত পেশোয়ার থেকে রেঙ্গুন, সাম্রাজ্যসঙ্গী ভদ্রলোকও এই বিস্তীর্ণ ভূখন্ডে মধ্যবর্গে একচেটিয়া অধিকার নিয়ে প্রসারিত।
ক্রমে বহু প্রতিবেশী এলাকা বাংলা থেকে খসে গেল। ১৯১১ সালে রাজধানী গেল দিল্লিতে, ১৯১২ সালে বিহার ও ওড়িশা বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন, ১৯৪৭ সালে সেই সংক্ষিপ্ত বঙ্গভূমিরও দুই-তৃতীয়াংশ পূর্ব পাকিস্তানে পর্যবসিত। বিংশ শতকের গোড়ায় বঙ্গীয় ভদ্রলোকের যে বিস্তৃত চারণভূমি ছিল, পঞ্চাশ বছরের মধ্যে তা গোষ্পদে পরিণত। তালপুকুরে তখন ঘটি ডোবে না। ইতিহাসের ন্যায়, কিন্তু বঙ্গীয় মধ্যবিত্ত শিক্ষিত চাকুরিজীবীর অর্থনীতিতে ও অহমিকায় দারুণ আঘাত।
বৃহত্তর ক্যানভাসে, সুজলা-সুফলা বঙ্গভূমির অধিকাংশ কৃষি সীমান্তের পূর্বে, তুলনায় শহরকেন্দ্রিক এবং জনবহুল পশ্চিমবঙ্গ খাদ্যহীন। ফলত খাদ্য আন্দোলনে উত্তাল। পাটের উৎপাদন পূর্বে, চটকল প্রায় সব পশ্চিমে, কাঁচামালের অভাবে দীর্ণ। কলকাতা বন্দর পশ্চাদ্ভূমি থেকে বঞ্চিত, কলকাতা মহানগর উদ্বাস্তুসঞ্চিত। উত্তরবঙ্গের সমাজচিত্রও উদ্বাস্তুস্রোতে নাড়া-খাওয়া। লুপ্তগৌরব ও হৃতশক্তি পশ্চিমবঙ্গ দিল্লিতে প্রভাব খাটাতে পারে না, কেন্দ্রীয় মাশুল সমীকরণ নীতি ইত্যাদিতে বাংলা আরও ধাক্কা খায়। উদ্বাস্তু সাংবাদিক রণজিৎ রায়ের ‘অ্যাগনি অব ওয়েস্ট বেঙ্গল’ তার দলিল।
পশ্চিমবঙ্গীয় রাজনীতিতে ক্রমশ উদ্বাস্তু কলোনির বৈধতাসন্ধান এবং শরণার্থীদের ‘লিজহোল্ড’ পাট্টাকে ‘ফ্রিহোল্ড’ পাট্টায় পরিণত করার আন্দোলন প্রবল হল, পরবর্তী স্তরে নাগরিকতার দাবিও উত্তুঙ্গতা পেল। যা ছিল গোড়ায় অসংগঠিত খন্ড-ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত উদ্বাস্তুদের কলোনি-ওয়াড়ি বাঁচার লড়াই, তা সংগঠিত আন্দোলনে হয়ে দাঁড়াল বঙ্গীয় জনজীবনের চালিকাশক্তি। প্রফুল্ল চক্রবর্তী তাঁর প্রভাবশালী ‘প্রান্তিক মানব’-এ দেখান, উদ্বাস্তুরাই বাংলায় বাম রাজনীতির ভ্যানগার্ড, উদ্বাস্তু পরিচালনাতেই বাংলা বাম হল।
পাসপোর্ট-ভিসা চালু হল, সীমানায় প্রহরা কড়া হল, বাংলার স্বর্গসম্ভব জলপথ অব্যবহারে রুদ্ধ হল, যশোহর রোডে যশোহর যাওয়া বন্ধ হল, রেলও শেষে থমকাল। প্রথম দিকে পাসপোর্ট-ভিসার বন্দোবস্ত ছিল না। ওদিক থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত যে ট্রেন আসত-যেত, তা ১৯৬৫ সালের ভারত-পাক যুদ্ধ পর্যন্ত কার্যত সচল ছিল।
কিন্তু এই সব নিয়ে আলোচনা হলেও দেশভাগের তথা বাস্তুচ্যুতির কিছু সুদূরপ্রসারী অন্দরশায়ী মানসিক-সাংস্কৃতিক প্রভাব বোধহয় অধরাই থেকে গিয়েছে। উদ্বাস্তুদের মধ্যে চলচ্চিত্রে ঋত্বিক ঘটকরা এবং কথাসাহিত্যে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়-প্রফুল্ল রায়রা তাঁদের ছিন্নমূল স্মৃতিসত্তার ছবি এঁকেছেন। ক্যাম্পের দলিত কাহিনি লিখেছেন মনোরঞ্জন ব্যাপারী। দুঃখিনী নারীর ছবি আছে সুনন্দা শিকদারে, অধীর বিশ্বাস ব্যাকুলতাময়। কেউ কেউ উদ্বাস্তু পরিচয় নিয়ে লিখতে সঙ্কুচিত হয়েছেন, কেউ কেউ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পুরাতন পাপকে স্মরণ করে নিম্নবর্গীয় চর্চায় উত্তীর্ণ হতে চেয়েছেন। কেউ আঁকড়ে ধরেছেন ঘনাদা-টেনিদার মতো অতীতচারী আকাশছোঁয়া ফ্যান্টাসিকে, কেউ মুক্তি খুঁজেছেন সাম্যদর্শনে। কিন্তু প্রাত্যহিক আচরণ ও বাগ্বিধিতে নিজেদের অজান্তে আপন রক্তাক্ত ক্রোধে নিজেদের ভাঙতে ভাঙতে প্রজন্মের পর প্রজন্মে আমরা কতদূর তির্যক ও বঙ্কিম হয়ে গেলাম, সে নিয়ে সজাগ চৈতন্যচর্চা জরুরি। (ক্রমশঃ)
সূত্র— আনন্দবাজার পত্রিকা। ৩০ এপ্রিল, ২০২২।
ছবি— সনিয়া রহমানের তোলা লোহাগড়ার হাজরা বাড়ি ও মন্দিরের বেশ কিছু ছবির একটি। পাশেই চিত্রা নদী বয়ে যাচ্ছে। অপূর্ব নির্মাণ শৈলী বাঁধাঘাট। এর কথা উল্লেখ না করলেই না। কলকাতার গঙ্গার ধারে অবস্থিত ‘প্রিন্সেপ ঘাট’ এর সাথে বাঁধাঘাটের নির্মাণ শৈলীর মিল চোখে পড়লো। যা গ্রিক স্থাপত্য রীতিতে
ডোরিক কলাম স্টাইলে তৈরি করা। খুবই নান্দনিক একটা ছাউনি; যা রাজবাড়ি ঘাট নামেও পরিচিত।
‘সেভ দি হেরিটেজেস অফ বাংলাদেশ’ ফেসবুক গ্রুপ।
সঙ্কলন— অশোক সেনগুপ্ত।