পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের স্মৃতি (২৬) শিখ-হিন্দু পঞ্জাবি-সিন্ধি জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন তথা প্রতিস্থাপন এপারে হয়েছিল দ্রুত–১

আমাদের পূর্বে লোক-বিনিময় হয় ধীর ও টানা রক্তক্ষরণের মতো, দফায় দফায়, চুঁইয়ে চুঁইয়ে—
উচ্চবর্ণ-মধ্যবিত্তরা আত্মীয়গৃহ বা জবরদখল কলোনিতে ঘাঁটি গাড়লেন, নিম্নবর্ণ-নিম্নবিত্তরা ক্যাম্প হয়ে আন্দামান-দন্ডকারণ্যের পথে রওনা দিতে বাধ্য হলেন। ট্র্যাজেডির চরিত্র ধীরে পরিস্ফূট হল, মরিচঝাঁপি সেই ট্র্যাজেডির বর্ণবিন্যাস কালে কালে আরও প্রকাশ করল।

আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়
আমাদের ভারত, ৯ নভেম্বর: দেশভাগ নিয়ে আলোচনা বাংলায় প্রথম দিকে একটু কমই ছিল। অনেকেই মনে করেছিলেন, এটা সাময়িক একটা ব্যবস্থা মাত্র, অচিরেই সব মিটে যাবে। আমাদের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে নানা স্মরণ হচ্ছে। আমাদের দেশভাগেরও এটা ৭৫ বছর। সে বিষয়েও স্মৃতি জাগরুক রাখতে হবে। দেশভাগের যন্ত্রণা আমাদের অসংখ্য পথে প্রভাবিত করেছে, সে কথা ভোলার নয়। বিশেষত, মনের ভিতর যে-সব জায়গায় আমরা ভেঙে দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছি, সে সব অনালোচিত দিক্ সম্পর্কে সচেতন হলে তবেই তো আবার সোজা হতে পারা যাবে।

দেশভাগ নিয়ে আলোচনা বাংলায় প্রথম দিকে একটু কমই ছিল। অনেকেই মনে করেছিলেন, এটা সাময়িক একটা ব্যবস্থা মাত্র, অচিরেই সব মিটে যাবে। প্রথম দিকে পাসপোর্ট-ভিসার বন্দোবস্ত ছিল না। সীমানা পেরিয়ে অনায়াসে এদিক-ওদিক করা যেত। ওদিক থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত যে ট্রেন আসত-যেত, তা ১৯৬৫ সালের ভারত-পাক যুদ্ধ পর্যন্ত কার্যত সচল ছিল। পূর্ববঙ্গ-পূর্ব পাকিস্তানের বহু হিন্দু ভদ্রলোক কিছু আত্মীয়স্বজনকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিলেও বেশ কিছু বছর নিজেরা ভিটেছাড়া হতে চাননি। বা বৃদ্ধ মা-বাবাকে ঠাঁইনাড়া করেননি। বা সম্পত্তি বিক্রিবাটা করেননি— এমন অজস্র কাহিনি আছে।

ওদিক থেকে ব্যবসায়ী সাহা পরিবারগুলির অনেকেই বহু পরে এদিকে আসেন। নমঃশূদ্র-রাজবংশী চাষীরাও সহজে জমি ছাড়তে চাননি। এ দিকের মুসলমানও সহজে সব কিছু ছেড়ে ওদিকে যেতে চাননি (পড়ুন হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’ এবং আনিসুজ্জামানের ‘কাল নিরবধি’)। দুই তরফেই অনেকদিন পর্যন্ত ধারণা ছিল, কিছু একটা সমঝোতা অচিরেই হয়ে যাবে, পূর্বাবস্থা ফিরে আসবে! দেশভাগের পর ফজলুল হক সাহেব যে বন্ধুবান্ধব ও আড্ডার টানে কলকাতায় ফের ঘুরতে এসেছিলেন, তার মধ্যে একটা ভরসার গল্পও ছিল।

ভারতের পশ্চিম সীমান্তে দেশভাগ ও লোক-বিনিময় হয়েছিল রাতারাতি, প্রায় অস্ত্রোপচারের ভঙ্গিতে— চকিত, রক্তাক্ত, মর্মন্তুদ। সেই বিপুলসংখ্যক উদ্বাস্তু শিখ-হিন্দু পঞ্জাবি-সিন্ধি জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন তথা প্রতিস্থাপনও এপারে হয়েছিল দ্রুত। দিল্লির গা-ঘেঁষা সেই সব প্রকল্পে ভারত সরকারের অর্থসাহায্য ছিল অকুন্ঠ, উদ্যোগ-অভ্যস্ত শরণার্থীরা নিজেদের পায়ে তাড়াতাড়িই দাঁড়িয়ে যান। ও সব দিকে জনবসতির আপেক্ষিক কম ঘনত্বও পশ্চিমাঞ্চলে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনে সহায়ক হয়। তুলনায় আমাদের পূর্বে লোক-বিনিময় হয় ধীর ও টানা রক্তক্ষরণের মতো, দফায় দফায়, চুঁইয়ে চুঁইয়ে— ভারত সরকারের পুনর্বাসন কর্তাদের অবিশ্বাস ও বিরক্তি উৎপাদন করে।

পূর্ববঙ্গ-পূর্ব পাকিস্তানের বহু হিন্দু ভদ্রলোক কিছু আত্মীয়স্বজনকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিলেও বেশ কিছু বছর নিজেরা ভিটেছাড়া হতে চাননি। অচিরেই নেহরু চাইলেন, সংখ্যালঘুরা নিজ নিজ দেশে থেকে যান। ফলে পূর্ব সীমান্তের ধারাবাহিক অশ্রুপাতের অনিবার্য নির্মমতা কেন্দ্রীয় পরিকল্পনায় যথার্থ সহমর্মিতা পায়নি। বিধান রায় ত্রাণ ও পুনর্বাসনে অনেক কাজ করলেও পশ্চিমবঙ্গের অভিজাত মধ্যশ্রেণিও উদ্বাস্তু স্রোতে বিরক্ত ও শঙ্কিত ছিলেন। বিশেষ করে গোড়ার দিকে উদ্বাস্তুরা কম সহানভূতি পান, পরের দিকেও দলিতরা বিচার-বঞ্চিত থাকেন, দেশভাগের গুরুত্ব বুঝতে এ-দেশে কোথাও ভুল হয়ে যায়।

ক্রমে বোঝা গেল, ব্যবচ্ছেদ কোনও সাময়িক ব্যবস্থা নয়, এই কাঁটাতারের বেড়া চিরকালীন। পাসপোর্ট-ভিসা চালু হল, সীমানায় প্রহরা কড়া হল, বাংলার স্বর্গসম্ভব জলপথ অব্যবহারে রুদ্ধ হল, যশোহর রোডে যশোহর যাওয়া বন্ধ হল, রেলও শেষে থমকাল। উদ্বাস্তুর সংখ্যা ধীরে ধীরে পর্বতপ্রমাণ হল, উচ্চবর্ণ-মধ্যবিত্তরা আত্মীয়গৃহ বা জবরদখল কলোনিতে ঘাঁটি গাড়লেন, নিম্নবর্ণ-নিম্নবিত্তরা ক্যাম্প হয়ে আন্দামান-দন্ডকারণ্যের পথে রওনা দিতে বাধ্য হলেন। ট্র্যাজেডির চরিত্র ধীরে পরিস্ফূট হল, মরিচঝাঁপি সেই ট্র্যাজেডির বর্ণবিন্যাস কালে কালে আরও প্রকাশ করল। দেশভাগের তথা বাস্তুচ্যুতির কিছু সুদূরপ্রসারী অন্দরশায়ী মানসিক-সাংস্কৃতিক প্রভাব বোধহয় অধরাই থেকে গিয়েছে। (ক্রমশঃ)


সূত্র— আনন্দবাজার পত্রিকা। ৩০ এপ্রিল, ২০২২। সঙ্গের
ছবি— পুরনো, পরিত্যক্ত অসংখ্য বাড়ি এখন ঐতিহ্য সফরের বিষয়। অয়ন তরফদারের তোলা।
সূত্র— ‘সেভ দি হেরিটেজেস অফ বাংলাদেশ’।
সঙ্কলন— অশোক সেনগুপ্ত।

‘মনেপ্রাণে হিন্দুত্ববাদী’দের কাছে অনুরোধ। আমাদের সাহায্য করুন। খুব আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে সাড়ে পাঁচ বছর ধরে ২৫ জন রিপোর্টার, বাংলায় একমাত্র আমরাই প্রতিদিন এই ধরণের খবর করছি। 🙏
ব্যাঙ্ক একাউন্ট এবং ফোনপে কোড:
Axis Bank
Pradip Kumar Das
A/c. 917010053734837
IFSC. UTIB0002785
PhonePay. 9433792557
PhonePay code. pradipdas241@ybl

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *