পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের স্মৃতি (১৮), আলেক্সান্ডার ক্যাসল

আমাদের ভারত, ২৮ অক্টোবর: প্রাকৃতিক উপায়ে ‘শীতাতপ’ নির্মিত শতবর্ষী এই স্থাপত্য এখন ধ্বংসের মুখে। অযত্ন, অবহেলা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংসের মুখে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত ময়মনসিংহের লোহারকুঠি খ্যাত আলেকজান্ডার ক্যাসেল।

প্রাকৃতিক উপায়ে ‘শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত’ এই বাগানবাড়িতে একসময় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লর্ড কার্জনের মতো দেশি-বিদেশি বরেণ্যরা। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের ধারক লোহারকুঠিটি এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলেও দেখভালের কেউ নেই।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, মুক্তাগাছার জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরীর তৃতীয় প্রজন্ম রঘুনন্দন আচার্য চৌধুরী নিঃসস্তান ছিলেন। সম্পত্তির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে তখনকার রেওয়াজ অনুযায়ী পুত্রসন্তানের প্রয়োজনে তিনি গৌরীকান্ত আচার্য চৌধুরীকে দত্তক নেন ও মৃত্যুর আগে গৌরীকান্তের হাতেই জমিদারি অর্পণ করেন। গৌরীকান্তও সন্তানহীন অবস্থায় মারা গেলে তাঁর বিধবা স্ত্রী বিমলা দেবী দত্তক নিলেন কাশীকান্তকে। ইনিও রোগে ভুগে সন্তানহীন অবস্থায় পরলোকগমন করেন। তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মী দেবী আচার্য চৌধুরানী পূর্বসূরীদের পথ অনুসরণ করে দত্তক নেন চন্দ্রকান্ত আচার্য চৌধুরীকে।

নিয়তির করুণ পরিহাসে এই চন্দ্রকান্তও দ্রুত ত্যাগ করেন পৃথিবীর মায়া। হাল ছাড়েননি লক্ষ্মী। দত্তক নেন আবার। দ্বিতীয় দত্তক পুত্রের পূর্বনাম পূর্ণচন্দ্র মজুমদার। কুলগুরুর সামনে মহাসমারোহে লক্ষ্মী দেবী নতুন নাম রাখলেন সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী। সূর্যকান্তর শাসনকালে ব্রহ্মপুত্র তীরবর্তী জনপদে যুক্ত হলো নতুন মাত্রা। প্রায় ৪১ বছর জমিদারিতে বহু জনহিতকর কাজ করেন তিনি। ময়মনসিংহে স্থাপন করলেন একাধিক নান্দনিক স্থাপনা।

ময়মনসিংহ জেলার প্রতিষ্ঠার জুবিলী উদ্‌যাপন উপলক্ষে মহারাজা সুকান্ত সুর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী এই দ্বিতল লোহারকুঠি নির্মাণ করেছিলেন। ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রাসাদটি নির্মিত হয়। এতে সে সময় ৪৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছিল। পরে তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নামে এর নাম রাখা হয় আলেকজান্ডার ক্যাসল। লোহা, কাঠ ও টিন দিয়ে এই কুঠি নির্মাণে প্রাকৃতিকভাবে শীতল রাখতে সিলিংয়ে ব্যবহার করা হয় ফ্রান্স থেকে আনা আব জাতীয় দুর্লভ এক বস্তু।

তখন ভবনটির চারপাশে ছিল দিঘি ও বাগান। জমিদারদের শাসনকাল শেষে এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আলেকজান্ডার ক্যাসেলটি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের গ্রন্থাগার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

স্থানীয় ইতিহাস হতে জানা যায় ১৯২৬ সালে এই বাগানবাড়িতে এসে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন। একই বছর এসেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। এখানে এসেছিলেন লর্ড কার্জন, চিত্তরঞ্জন দাশ, নওয়াব সলিমুল্লাহ, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু প্রমুখ। লোহারকুঠি কিংবা আলেকজান্ডার ক্যাসেল দেখতে এখনও ভিড় জমান দর্শনার্থীরা।

ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক এই লোহারকুঠির বর্তমান দূরবস্থা হতাশ করে দেওয়ার মতো। একসময়কার দৃষ্টিনন্দন আলেকজান্ডার ক্যাসেলের লোহা ও কাঠ ভেঙ্গে পড়ছে, খসে পড়ছে পলেস্তারা।সামনে থাকা নারীর ভাস্কর্যটি এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

সূত্র— প্রত্নতত্ব ও ইতিহাসের বিতর্ক গ্রুপে নামিরা সুলতানার পোস্ট, সঙ্কলন— অশোক সেনগুপ্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *