আমাদের ভারত, ২১ অক্টোবর: ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট রাত ১২টায় রাজশাহীতে বসে এক তরুণ লিখেছেন কলকাতার এক তরুণীকে। চিঠিতে দুজনের কারোরই নাম নেই। সম্বোধনের জায়গায় মেয়েটার ছবি। একইভাবে ছয় পাতার চিঠির শেষে নাম না লিখে ‘ইতি’র পরে ছেলেটি নিজের ছবি দিয়েছেন। কলকাতার ফুটপাতের বইয়ের দোকানে বছর দেড়েক আগে একটি পুরোনো বইয়ের ভেতরে চিঠিখানা আবিষ্কার করেন সংগ্রাহক উজ্জ্বল সরদার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত চিহ্নমেলায় ‘কলকাতার কথকতা’ সংগ্রাহক দলের স্টলে সবার দৃষ্টি কাড়ে সেই চিঠি, যা একনজর দেখার জন্য ভিড় লেগে ছিল। নিছক প্রেমপত্র হলেও পড়ে বোঝা যায়, দেশভাগের কারণে মেয়েটা রয়ে গেছেন কলকাতায় আর ছেলেটা রাজশাহীতে। চিঠির ছত্রে ছত্রে সেই বিয়োগান্ত কথা ঘুরেফিরে এসেছে।
চিঠিটি বইয়ের ভেতরে যেভাবে ভাঁজ করা ছিল, সেভাবেই রাখতে হয়েছে। কারণ, ৭৫ বছরের ব্যবধানে চিঠির কাগজ পাঁপড় ভাজার মতো মচমচে হয়ে গেছে। সবটা পড়া যায় না। খুলতে গেলেই ভেঙ্গে যায়। উজ্জ্বল পলিথিনের জ্যাকেট পরিয়ে সংগ্রাহক পরম যত্নে রেখেছেন অমূল্য এই চিঠিখানা।
চিঠিতে মেয়েটার ছদ্মনাম ‘মিত্তি’ আর ছেলেটার নাম ‘মানা’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সে সময় রাজশাহী বানানে দন্ত্য-স লেখা হতো। চিঠিতে ওভাবেই লেখা। তারিখের জায়গায় ‘রাজসাহী, ১৫ই আগস্ট রাত বারোটা।’ ভেতরের আরেকটা পাতায় সাল লেখা ১৯৪৭।
ছেলেটা শুরুতে লিখেছেন, ‘এখানে এসে অবধি তোমায় তিনখানা চিঠি লিখেছি, এটা হলো চতুর্থ। তুমি লিখেছ মাত্র একটা। তার জন্য অনুযোগ করব না।’ নিজের ঘরের বর্ণনা দিতে বলেছেন, ‘এখানে আমার ঘরটা বড্ড বড়, আমার একার পক্ষে। পড়ার টেবিল, খাট, ড্রেসিং টেবিল। এ ছাড়া এত জিনিস আছে ঘরটার ভেতরে, তা-ও মনে হয়, একেবারে ফাঁকা।’ লিখতে লিখতে রাত একটা বেজে গেছে। আলো নিভে গেছে। ফ্যান বন্ধ হয়ে গেছে। মোম জ্বালিয়েছেন। এই জায়গায় লিখেছেন, ‘বলতো, মোমের শিখায় এসে পোকাগুলো মরছে, এ দোষ কার, আলোর না পোকাগুলোর?—উত্তর পেলে কলকাতায় তুমি একদিন আমাকে কতগুলো কথা বলেছিলে, আমি তার উত্তর দিব।’ ছয় পাতার চিঠিতে জর্জ বর্নার্ড শ’র একটি নাটক সদ্য শেষ করে তার কয়েকটি সংলাপ ইংরেজিতে লিখেছেন। নিঝুম রাতের ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ, কলকাতার কোনো এক বেনুদার ঝগড়া, কাকে যেন ‘বেলুন’ সম্বোধন করে জানতে চেয়েছেন তার খবর। লিখেছেন আরও অনেক কিছু।
শেষাংশে লিখেছেন, ‘খুব পড়াশোনা করছো নিশ্চয়ই! আর আমায় ফেলে ফেলে বেড়াচ্ছোও নিশ্চয়-খুব।’ শেষে লিখেছেন, ‘প্রীতি নিও। ইতি।’ তারপরে শুধু নিজের ছবিটা লাগিয়ে দিয়েছেন।
‘অক্ষর শুদ্ধ বানান ও ভাষাচর্চা’ ফেসবুক গ্রুপ থেকে।
সঙ্কলন— অশোক সেনগুপ্ত।