স্নেহাশীষ মুখার্জি, আমাদের ভারত, নদিয়া, ২ মে: সালটা উনিশশো নিরানব্বই। নদিয়ার মাজদিয়ার সুজিত কুমার রায়ের কাছে এসে পৌঁছেছিল মান্না দে’র নিজের হাতের লেখা চিঠি। সুজিত বাবুকে অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে ওই চিঠিতে মান্না দে লিখেছিলেন,’ মা আমার মা’, সত্যিই আমার প্রাণের গান। আমার প্রতিটি কাজেই আমি আমার মায়ের আশীর্বাদ পাই। পুলকবাবু সুন্দর লিখেছিলেন গানটি। পুলকবাবু যেন আমার মনের কথাটি নিজের কলমের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।’ মান্না দে’র লেখা সেই চিঠিটি অতি যত্ন সহকারে নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন সুজিত বাবু। তার ইচ্ছে রয়েছে, তার মৃত্যুর পর চিঠিটি যেন নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। বিখ্যাত গায়ক মান্না দে’র নিজের হাতের লেখা চিঠি বলে কথা। মান্না দে, গানের জগতে এক অবিস্মরণীয় নাম। যদিও তাঁর আসল নাম ছিল প্রবোধ চন্দ্র দে। তাঁর জন্ম ১মে, ১৯১৯। বিখ্যাত ওই গায়কের মৃত্যু হয়েছিল ২৪ অক্টোবর, ২০১৩।
মান্না দে ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম সেরা সঙ্গীত শিল্পীদের একজন। জানা গিয়েছে, তিনি হিন্দি, বাংলা, মারাঠি, গুজরাটি সহ অজস্র ভাষায় প্রায় ষাট বছরেরও বেশি সময় ধরে সঙ্গীত চর্চা করেছিলেন। বৈচিত্র্যের বিচারে তাকেই হিন্দি গানের ভুবনে সবর্কালের অন্যতম সেরা গায়ক হিসেবে মানেন সঙ্গীতপ্রেমী প্রচুর মানুষ। আধুনিক বাংলা গানের জগতে তাঁর গান সর্বস্তরের শ্রোতাদের কাছে ভীষণভাবে আজও জনপ্রিয়। সবারই বক্তব্য, ‘মান্না দে’র গান আমাদের প্রাণের গান।’ হিন্দি এবং বাংলা সিনেমায় গায়ক হিসেবে তাঁর সুনাম অবিস্মরণীয়। তিনি ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ -এর দশক পর্যন্ত ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে কার্যত রাজত্ব করেছেন।
তথ্যসূত্রে জানা যায়, সঙ্গীত জীবনে তিনি সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি গান রেকর্ড করেছিলেন। তাঁর অসামান্য অবদানের কথা স্বীকৃতি স্বরূপ ভারত সরকার ১৯৭১ সালে ‘পদ্মশ্রী’, ২০০৫ সালে ‘পদ্মবিভূষণ’, ২০০৭ সালে ‘দাদা সাহেব ফালকে’ সম্মাননা প্রদান করে। ২০১১ সালে রাজ্য সরকার মান্না দে’কে ‘বঙ্গবিভূষণ’ সম্মানে সম্মানিত করে। মান্না দে’র বাবা ছিলেন পূর্ণ চন্দ্র দে এবং মা মহামায়াদেবী। বাবা-মায়ের সংস্পর্শ ছাড়াও তাঁর ছোট কাকা সঙ্গীতাচার্য কৃষ্ণ চন্দ্র দে ভাইপো মান্না দে’কে সবথেকে বেশি অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করেছেন।
‘ইন্দু বাবুর পাঠশালা’ নামে একটি ছোট প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে মান্না দে’র শিক্ষা জীবন শুরু। এরপর তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশোনা করেন। পরে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্নাতক হয়েছিলেন। জানা যায়, স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়ার সময় তিনি তার সহপাঠীদের গান শুনিয়ে মুগ্ধ করে রাখতেন। তিনি তাঁর কাকা কৃষ্ণ চন্দ্র দে এবং উস্তাদ দাবির খানের কাছ থেকে গানের শিক্ষা লাভ করেন। তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় তাঁর প্রাণভোলানো গান। ১৯৪২ সালে কাকা কৃষ্ণ চন্দ্র দে’র সঙ্গে মুম্বাই গিয়ে কাকার সহকারি হিসেবে কাজ শুরু করেন।
এরপর তিনি সংস্পর্শে আসেন শচীন কর্তা অর্থাৎ শচীনদেব বর্মণের। তাঁর অধীনে শুরু করেন কাজ। একটা সময় তিনি ওস্তাদ আমান আলি খান এবং ওস্তাদ আবদুল রহমান খানের কাছ থেকে হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নেন। পরে অবশ্য একাধিক সঙ্গীত পরিচালকের সান্নিধ্যে আসেন তিনি। ‘তামান্না’ চলচ্চিত্রে গায়ক হিসেবে মান্না দে‘র অভিষেক ঘটে। সুরাইয়া’র সাথে দ্বৈত সঙ্গীতে গান রেকর্ড হয়়় তাঁর। যে ছবির সুরকার ছিলেন কৃষ্ণ চন্দ্র দে। সেই সময়ে গানটি ভীষণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। ‘মশাল’ ছবিতে শচীন দেব বর্মণের গীত রচনায় ‘ওপার গগণ বিশাল’ নামে একক গান গেয়েছিলেন।
১৯৫২ সালে মান্না দে বাংলা এবং মারাঠী ছবিতে একই সঙ্গে কাজ করেন। ভীমসেন যোশির সাথে তাঁর একটি জনপ্রিয় দ্বৈত গান ‘কেতকী গুলাব জুহি’। এছাড়াও, তিনি কিশোর কুমারের সঙ্গে গেয়েছিলেন আলাদা গোত্রের দ্বৈত গান। যেমন শোলে ছবিতে ‘ইয়ে দোস্তী হাম নেহী তোড়েঙ্গে ‘ এবং পোডসন ছবিতে ‘এক চতুর নার’ গান। এছাড়াও, মান্না দে শিল্পী ও গীতিকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (হেমন্ত কুমার) সহ আরও বেশকিছু গীতিকারের সাথে বাংলা ছবিতে গান গেয়েছিলেন। দ্বৈত সঙ্গীতে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে গিয়েছিলেন একাধিক গান। সুর দিয়েছিলেন একাধিক গানে। কেরলের মেয়ে সুলোচনা কুমারনকে ১৯৫৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর বিয়ে করেন। সুরমা ও সুমিতা নামে মান্নাদের দুটি মেয়ে রয়েছে।
মান্না দে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় মুম্বাইয়ে কাটানোর পর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বেঙ্গালুরুর কালিয়ানগর শহরে বাস করেছেন। এছাড়াও, তিনি কলকাতায়ও বাস করেছেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগেও তিনি বিভিন্ন সঙ্গীত বিষয়ক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছিলেন। ২০১৩ সালের ৮ জুন ফুসফুসের জটিলতা দেখা দেওয়ায় মান্না দে’কে বেঙ্গালুরুর একটি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। পরদিন তাঁর মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। যদিও বিখ্যাত এই গায়কের মহাপ্রয়াণ ঘটে ২৪ অক্টোবর ২০১৩ সালে, বেঙ্গালুরুতেই।
তাঁর ঝুলিতে রয়েছে যে কত খেতাব, তা কার্যত গুনে ওঠা কঠিন। তাঁর মহাপ্রয়াণের ক্ষতপূরণ সম্ভব নয়। যদিও ‘ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে’ তিনি রয়ে গিয়েছেন আজও সম্রাট হিসেবেই। থাকবেন ভবিষ্যতেও। করোনা – সন্ত্রাসের মধ্যেই কেটে গেল তাঁর আরও একটি জন্মদিন। ঘরবন্দি আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ তাঁর জন্মদিনে তাঁর গাওয়া গান শুনেই ভুলতে পেরেছেন কিছুটা দুঃখ -কষ্ট। তিনি হাজার- হাজার মানুষের মনে সম্রাট হয়েই বেঁচে থাকবেন। মানুষ ভুলতে পারবেন না, তাঁর ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা’, ‘আবার হবে তো দেখা’, গানগুলি। সুজিত কুমার রায় মান্না দের ১০০ তম জন্মদিনে মাজদিয়ার নিজ বাড়িতে গানে গানে শ্রদ্ধার্ঘ জানালেন প্রিয় শিল্পীকে।